পাকিস্তানের শাসক হিসেবে কেমন হবেন শাহবাজ শরিফ

পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ
ছবি : রয়টার্স

তিনি একজন অধ্যবসায়ী প্রশাসক। কবিতার প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। তিনি প্রায়ই বিখ্যাত বিপ্লবী উর্দু কবিদের কবিতা আবৃত্তি করে অফিশিয়াল মিটিং শুরু করেন। তিনি শাহবাজ শরিফ। সোমবার পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর পার্লামেন্টে তাঁর প্রথম কথাগুলো ছিল আধুনিক পাকিস্তানি কবি ও ভাষ্যকার আতা-উল-হক কাসমির একটি কবিতার লাইন। লাইনটি ছিল, ‘সব লালসার শৃঙ্খল ছিঁড়ে নিজেকে আজাদ করতেই হবে আজ।’

শাহবাজের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসা পাকিস্তানের অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক ‘রাজবংশ’ হিসেবে ধনী শরিফ পরিবারের প্রত্যাবর্তনকে নিশ্চিত করে। তাঁর ভাই নওয়াজ শরিফ ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সময়টাতে শাহবাজ পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নওয়াজকে এমন একজন নেতা হিসেবে সাধারণত দেখা হয়ে থাকে, যিনি নিজের দিকে ভিড় টানতে পারেন এবং দ্রুত ভোটারদের মন জয় করতে পারেন। আর শাহবাজ নীতি এবং উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহারিক দক্ষতা দেখানোর জন্য বেশ পরিচিত।

সাংবাদিক ও বিশ্লেষক সিরিল আলমেইদা শাহবাজের ব্যাপারে যথার্থ বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসা শাহবাজ শরিফের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন অনেক দিনেরই ছিল। তিনি ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ভাই নওয়াজ তাঁকে তখন পাঞ্জাবে রেখেছিলেন।’ ৭০ বছর বয়সী শাহবাজ শরিফ প্রথম জীবনে পারিবারিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সামলাতেন। তারপর ১৯৮৮ সালে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৯৭ সালে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু ১৯৯৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁর ভাই ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর শরিফ পরিবার সৌদি আরবে নির্বাসনে চলে যায়। এরপর শাহবাজ ২০০৭ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং আবার পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হন।

তবে ২০১৭ সালে ফাঁস হওয়া প্যান্ডোরা পেপারসে বিদেশে বিপুল অর্থ পাচার করা ব্যক্তিদের নামের তালিকায় শরিফ পরিবারের নাম থাকায় এই পরিবার কেলেঙ্কারিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। নওয়াজকে পদ থেকে অপসারণ করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। তাঁকে এবং তাঁর মেয়ে মরিয়মকে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং যথাক্রমে ১০ ও ৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনার পেছনে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্য ছিল। কারণ, নওয়াজের সঙ্গে পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সামরিক সংস্থার সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা তখন বেশ খোলাখুলি বিষয় ছিল। সেনাবাহিনীর সঙ্গে নওয়াজ শরিফের সেই শীতল সম্পর্কের রেশ এখনো পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখছে।

শাহবাজ শরিফ ক্ষমতায় থাকলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে ইমরান খান প্রায়ই পাশ্চাত্যবিরোধী কড়া বক্তব্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কে যে তিক্ততার জন্ম দিয়েছেন, তা হয়তো শাহবাজ কাটিয়ে ফেলতে পারবেন। শরিফ পাঞ্জাবে থাকাকালীন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্যও পরিচিতি পেয়েছেন।

নওয়াজের সঙ্গে শাহবাজের তফাত হলো, শাহবাজ বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য দুর্নীতির মামলা খেয়েছেন। এসব মামলায় তদন্ত হয়েছে। কিন্তু আদালত তাঁকে কখনোই দোষী সাব্যস্ত করেননি। ধারণা করা হয়ে থাকে, তৎকালীন বিরোধী নেতা ইমরান খানের পেছনে তখন সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছিল এবং সে সুবাদেই ইমরান ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দৈনিক ডন-এর সাবেক সম্পাদক ও প্রখ্যাত বিশ্লেষক ফাহাদ হুসাইন বলেছেন, শাহবাজ শরিফ প্রশাসন চালানোর ক্ষেত্রে ‘হ্যান্ডস-অন পদ্ধতি’ অনুসরণ করে থাকেন। অর্থাৎ প্রশাসনের প্রাত্যহিক কাজে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকেন। এ কারণে তাঁর শাসনপদ্ধতি ইমরান খানের শাসনপদ্ধতি থেকে আলাদা হবে বলে মনে হয়।

ইমরান খান তাঁর ব্যক্তিগত গ্ল্যামার আর ক্যারিশমার জন্য পরিচিত। অন্যদিকে নিজস্ব সক্ষমতার জন্য শাহবাজ শরিফের খ্যাতি আছে। হুসাইন বলেছেন, শরিফের নেতৃত্বের শৈলী সম্ভবত সেই লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির সমাপ্তি ঘটাবে, যা অনুসরণের বদৌলতে ইমরান খান পরিচিতি হয়ে উঠেছিলেন। শাহবাজ প্রতিহিংসামূলক কোনো আচরণ করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সমাবেশে তিনি বলেছেন, তিনি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী হবেন, যিনি ‘কথা কম কাজ বেশি’ নীতিতে বিশ্বাসী। হুসাইনের অনুমান ঠিক হলে আমরা প্রধানমন্ত্রীর অফিসে এমন একজন ‘ওয়ার্কোহোলিক’ (অ্যালকোহলে আসক্ত লোকের মতো নিরবচ্ছিন্ন কাজে আসক্ত হয়ে পড়া লোক) লোককে দেখতে পাব, যিনি গোটা শাসনব্যবস্থায় দৃশ্যমান পরিবর্তন আনবেন।

শাহবাজ শরিফ ক্ষমতায় থাকলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে ইমরান খান প্রায়ই পাশ্চাত্যবিরোধী কড়া বক্তব্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কে যে তিক্ততার জন্ম দিয়েছেন, তা হয়তো শাহবাজ কাটিয়ে ফেলতে পারবেন। শরিফ পাঞ্জাবে থাকাকালীন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্যও পরিচিতি পেয়েছেন।

সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খান এবং ভাই নওয়াজের যেমন সম্পর্ক ছিল, শাহবাজের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক আলাদা হবে বলে মনে হয়। নওয়াজ ও সামরিক সংস্থার মধ্যে সম্পর্কের বেশ অবনতি হয়েছিল। নওয়াজের তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সম্পর্কটি ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের দিকে চলে যায়। ইমরানের সঙ্গেও সেনাবাহিনীর সম্পর্কে চিড় ধরেছিল। তবে শাহবাজ এই সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভালো বোঝাপড়া করে চলতে পারবেন বলে আপাতত মনে হচ্ছে। লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ হুসাইন বলেছেন, ‘সামরিক বাহিনী তার প্রশাসনে ততটা জড়িত থাকবে না, যেমনটা ইমরান খানের সরকারের সময় জড়িত ছিল।’ তিনি মনে করেন, ইমরানের সরকার সম্পূর্ণরূপে সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিল।

এখন পর্যন্ত এটি পরিষ্কার, শাহবাজ এবং সেনাবাহিনী একসঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। তাদের মধ্যে সে ধরনের লক্ষণই দেখা যাচ্ছে।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

হান্নাহ এলিস প্যাটারসন দ্য গার্ডিয়ান–এর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা এবং

শাহ মির বালুচদ্য গার্ডিয়ান–এর বালুচ প্রতিনিধি