পশ্চিমবঙ্গে 'বিয়াল্লিশ'-এর লড়াই

পশ্চিমবঙ্গে কোচবিহারে নির্বাচনী জনসভায় নেতা–কর্মী সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়েন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারত, ০৭ এপ্রিল। ছবি: এএফপি
পশ্চিমবঙ্গে কোচবিহারে নির্বাচনী জনসভায় নেতা–কর্মী সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়েন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারত, ০৭ এপ্রিল। ছবি: এএফপি

বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার প্রধানতম এক তাত্ত্বিক শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু স্থানীয় বিধানসভায় সরাসরি নির্বাচিত ২৯৪ সদস্যের মধ্যে বিজেপির হিস্যা মাত্র ৩। ভারতজুড়ে যখন দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পালে তীব্র হাওয়া, তখনো পশ্চিমবঙ্গের এই প্রতিরোধশক্তিতে রাজ্যের অনেকে গর্ব করেন। তবে লক্ষণে মনে হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-বিদ্যাসাগরের জন্মভূমি ক্রমে শ্যামাপ্রসাদ অনুসারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চলেছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ২৩টি পেতে চাইছে বিজেপি। গত নির্বাচনে পেয়েছিল মাত্র ২টি।

মমতার পক্ষে গতবারের ৩৪ আসন ধরে রাখা কঠিন

ভারতের জনসংখ্যার মাত্র সাড়ে সাত শতাংশের বাস পশ্চিমবঙ্গে। লোকসভার আসনের ক্ষেত্রেও এই রাজ্যের হিস্যা অনুরূপ। তবে বরাবরই এই প্রদেশ পৃথক এক শ্রদ্ধাভরা চরিত্র নিয়ে সর্বভারতীয় মনোযোগে থেকেছে। ভারতজুড়ে যখন কংগ্রেস দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে, সেকালেও প্রায় ৩৪ বছর একনাগাড়ে এখানে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় ছিল। আবার বিজেপির ঢেউয়ের সময়ও স্থানীয় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালিদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছেন। এবার ২০১৯-এ ভারতজুড়ে মোদি বনাম রাহুলের মধ্যে মহানির্বাচনী যুদ্ধ চললেও কলকাতায় আলোচনার কেন্দ্রে কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসই। যে প্রশ্নটি জোরেশোরে উঠেছে, মমতা কি পারবেন আরএসএস-বিজেপি পরিবারকে ঠেকিয়ে রাখতে? পারলেও কতটা পারবেন? বুধবার শিলিগুড়ির কাওয়াখালীর মাঠে মোদির জনসভার পর এই প্রশ্ন এবং শঙ্কা আরও তীব্র হলো। মোদি সরাসরি ব্যক্তি মমতাকে আক্রমণ করে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সম্ভাব্য নির্বাচনী কৌশলের কথা জানিয়ে দিলেন।

যদিও গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি মাত্র ২টিতে প্রথম এবং ৩টিতে দ্বিতীয় হয়েছিল। কিন্তু দলটির দাবি, এই রাজ্যে তাদের ৪০ লাখ সদস্য রয়েছে। সংখ্যার হেরফের হলেও এটা মিথ্যা নয়, গত দুই দশক ধরে আরএসএস-বিজেপি পরিবার তিল তিল করে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে সংগঠন বিস্তার করছে। এবার তার একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য ফলাফল দেখতে চায় দলটি। বিজেপি সংগঠকেরা প্রকাশ্যেই বলছেন, অন্তত ২৩ আসন পেতে তাঁরা মাঠে নেমেছেন। দলের সভাপতি অমিত শাহ এই টার্গেট বেঁধে দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় বিজেপি মনে করছে, নির্বাচনে উত্তর ভারতে তারা কিছু আসন হারাতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে সেটা পুষিয়ে নেওয়া হবে। তবে ২৩টা না হলেও তারা যে পশ্চিমবঙ্গে আগের চেয়ে ভালো করবে, তা মেঠো আলামতে স্পষ্ট। হিন্দুত্ববাদের প্রাথমিক সাংগঠনিক ইউনিট হিসেবে আরএসএসের প্রায় ১ হাজার ৫০০ ‘শাখা’ সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ বাংলাজুড়ে এ মুহূর্তে খাটছে অমিত শাহের বেঁধে দেওয়া ‘লক্ষ্য’ হাসিল করতে। অথচ ২০১১ সালেও তাদের এ রকম ‘শাখা’র সংখ্যা ছিল ৫০০ মাত্র।

অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের সমাজে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে ধর্মবাদী রাজনীতির বাড়তি একটা আবেদন তৈরি হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী পরিচয়ের মধ্যে আশ্রয় খোঁজার প্রবণতা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর মধ্যে মৃদু হলেও অস্পষ্ট নয়। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে গত নির্বাচনের ৩৪টি আসন ধরে রাখা কঠিন। কয়টা কমবে, পাঁচটা না দশটা, সেটা নিয়ে আঁচ-অনুমান চলছে কেবল। তবে নির্বাচনী জনসভাগুলোতে ‘বিয়াল্লিশ বিয়াল্লিশ’ বলে স্লোগান ধরে কর্মীদের মনোবল চাঙা রাখছেন মমতা।

পশ্চিমবঙ্গের ফলাকাটা এলাকায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতা–কর্মী সমর্থকেরা শোভাযাত্রা বের করেন। ভারত, ০৭ এপ্রিল। ছবি: এএফপি

বিজেপিবিরোধী শিবির জোটবদ্ধ হতে পারেনি

বিজেপির ঘোষিত আদর্শিক ভিত্তি মুসলমান, খ্রিষ্টান ও কমিউনিস্ট ঘৃণা হলেও পশ্চিমবঙ্গে তার সাংগঠনিক বিস্তারে ‘বাংলাদেশি’ বিরোধিতাও বড় রাজনৈতিক পণ্য। একই ধারাবাহিকতা চলছে এবারও। বিজেপির নির্বাচনী প্রচারের বড় অ্যাজেন্ডা পশ্চিমবঙ্গে বৈধ-অবৈধ বাসিন্দা চিহ্নিত করতে ‘নাগরিকপঞ্জি’ করা। যেমনটি হয়েছে আসামে। এও বলা হয়েছে, নাগরিকপঞ্জিতে অ-মুসলমানরা অবৈধ হলেও তাদের তাড়ানো হবে না, তবে মুসলমানদের জন্য সেটাই ঘটবে। বিজেপির প্রচারকদের কাছে এ রকম ‘অবৈধ’ মুসলমান মানেই বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া ‘অনুপ্রবেশকারী’। মমতা অবশ্য জোরের সঙ্গেই এনআরসির বিরোধী। বিজেপির এনআরসি অ্যাজেন্ডা এককালের উদ্বাস্তু নমশূদ্রদেরও উদ্বেগে ফেলেছে, যাঁরা মমতাকে রক্ষাকবচ ভাবতে পারেন। তবে এরূপ ভোট তাঁর জন্য নতুন নয়, আগেও তিনি এই গোষ্ঠীর ভোট পেতেন।

এবার নির্বাচনে বিজেপির জন্য পশ্চিমবঙ্গে প্রধান সুবিধার দিক ভোটে তার বিরোধীদের কোনো জোট নেই। তৃণমূল ছাড়াও বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস পৃথকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। হেভিওয়েট কয়েকজন নেতা আসন ছাড়তে নারাজ হওয়ায় কংগ্রেসের সঙ্গে বামফ্রন্টের আসন সমঝোতা হতে হতেও ভেঙে গেছে। যদিও উভয় দলের কর্মী পর্যায়ে সমঝোতার তাগিদ ছিল। কিছু এলাকায় বিজেপির জন্য এটা স্বস্তির হয়েছে। কিছু আসনে তৃণমূলের জন্যও সুবিধাজনক হয়েছে। বিস্ময়করভাবে কংগ্রেস এ রকম নির্বাচনী সমঝোতা থেকে সরিয়ে নিয়েছে নিজেকে উত্তর প্রদেশ, দিল্লিসহ অনেক স্থানে। কংগ্রেস নেতৃত্বের এ রকম কৌশল বিজেপির জন্য উৎসাহব্যঞ্জক হয়েছে।

সংখ্যালঘু ভোট বিভক্ত রাখতে চাইছে বিজেপি

দুই দশক আগে পশ্চিমবঙ্গের ভোটে বিজেপির ছিল মাত্র ১০-১২ শতাংশ হিস্যা। এখন সেটা ২০ শতাংশ ছাড়াচ্ছে। চতুর্থমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেসব আসনে ১০ শতাংশ ভাসমান ভোট নিজেদের দিকে টেনে আনতে পারবে, সেখানেই বিজেপির সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। ভোটারদের প্রায় ৮০ শতাংশ এই রাজ্যে ভোট দেন, যা ভারতের জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। রাজ্যবাসীর রাজনৈতিক সচেতনতার বড় স্মারক এটা। তবে ভোটের দিনগুলোতে এখানে সহিংসতাও হয় বেশি। অন্তত ২৫ শতাংশ কেন্দ্র ‘স্পর্শকাতর’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে এবং উত্তেজনাও ক্রমে বাড়ছে। স্বভাবত বিজেপির চেষ্টা আছে সহিংসতাকে ধর্মীয় রং দিতে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে মমতা নানান কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন। প্রায় ৪০ শতাংশ আসনে নারীদের প্রার্থী করেছেন। ১৬টি আসনে নতুন মুখ এনেছেন। মুসলমান প্রার্থী করেছেন সাতজন। জনপ্রিয় নায়িকাদের দাঁড় করিয়েছেন তরুণ ভোটারদের বিজেপিমুখিতা ঠেকাতে।

নরেন্দ্র মোদি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

তবে গত ১০ বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভোটের হিস্যাই ক্রমে বাড়ছেই। একই সময়ে তৃণমূলের ভোট কমেনি। স্বাভাবিকভাবেই বিজেপির ভোট আসছে সাবেক বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস সমর্থকদের তরফ থেকে। এই প্রবণতার শেষ কথা দাঁড়াচ্ছে, ১১ এপ্রিল যতই কাছে আসছে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী এই রাজ্যে ভোটের হাওয়া ক্রমে দ্বিমুখী রূপ নিচ্ছে। মমতার তরফ থেকে প্রতিনিয়ত মোদির শক্ত বিরোধিতার কারণে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস বিরোধী দল হিসেবে এই রাজ্যে অনেক ম্লান।

মমতার প্রায় অর্ধযুগের শাসনে তৃণমূলবিরোধী একটা ভোটব্যাংকও তৈরি হয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘুরা বিজেপিকে রুখতে মমতার শক্ত বিকল্প খুঁজে পাচ্ছেন না। আবার মুসলমানবিরোধিতা প্রধান এক রাজনৈতিক পুঁজি হলেও বিজেপি চাইছে রাজ্যের মুসলমান ভোট যেন তার বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে কারও বাক্স না ভরে। বরং কংগ্রেস-বামফ্রন্ট-তৃণমূলের মধ্যে যেন তিন ভাগ হয়ে যায় সেটা। আর হিন্দুর পছন্দে তার হিস্যাটা হোক সর্বোচ্চ।

পশ্চিমবঙ্গের ১৬ থেকে ১৮টি আসনে মুসলমানদের ভোট জয়-পরাজয়ে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে বলে কথিত আছে। ষাটের দশকে এই মুসলমানরা কংগ্রেসের সমর্থক থাকলেও পরে দীর্ঘসময়ের জন্য বামফ্রন্টের ভোটব্যাংকে পরিণত হয়। কিন্তু বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান তৃণমূলের দিকে সরে আসে। এই অবস্থায় ইতিমধ্যে চিড় ধরেছে বলে প্রচার আছে। যার সত্য-মিথ্যা যাচাই হবে আসন্ন ভোটে। নিজের মুসলমানবিরোধী ইমেজ কিছুটা খাটো করতেই জঙ্গিপুর আসনে মাফফুজা খাতুন নামে একজন মুসলমান নারীকে মনোনয়ন দিয়েছে এবার বিজেপি। কেবল এটুকুতে অবশ্য দেশজুড়ে গত পাঁচ বছরের মুসলমানবিরোধী নিপীড়ন-নির্যাতনের স্মৃতি ভুলিয়ে দেওয়া কঠিন। রাজ্যের সংখ্যালঘু নেতারা তাই চেষ্টা করছেন প্রতি আসনে বিজেপিবিরোধী সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রার্থীকে যেন নিজ সমাজের সবাই ভোট দেয়। আবার সংখ্যাগুরু একাংশের মধ্যে বিজেপির প্রতি সহানুভূতি থাকা স্পষ্ট। এ রকম সহানুভূতি–ভোটের ওপর দাঁড়িয়ে করা জরিপগুলো ইতিমধ্যে অন্তত ১০টি আসনে বিজেপির বিজয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক