মতামত

পরবর্তী নির্বাচন কমিশন কি আরেকটি তামাশা হবে

বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ আছে আরও দুই বছর। এর মধ্যেই বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য দেশে একটি কমিশন আছে। এই কমিশন তামাদি হয়ে যাবে তিন মাস পর। যাঁরা রাজনীতির সদর–অন্দরের খোঁজ রাখেন, তাঁদের নজর এখন নির্বাচন কমিশনের ওপর, কেমন কমিশন হতে যাচ্ছে। কিতাবে লেখা থাকে কিংবা রাজনৈতিক দলের কর্তারা প্রকাশ্যে যেসব কথা বলেন, বাস্তবে কিন্তু ঘটে অন্য রকম। আমরা জানি, নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তিনি তো সরকারের পরামর্শ বা প্রস্তাবের বাইরে যান না, যাওয়ার সুযোগ নেই। গেলে সেটি একটি ‘ক্যু’ হিসেবে বিবেচিত হবে।

আমরা পাকিস্তানের ইতিহাস জানি। এই তো কিছুদিন আগে রাজনীতিবিদেরা সাবেক আমলা গোলাম ইসহাক খানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল রেখেছিলেন। তিনি পরপর দুবার রাজনৈতিক সরকারকে বরখাস্ত করেন। একবার বেনজির ভুট্টোর সরকার, অন্যবার নওয়াজ শরিফের। সরকারকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টকে দিয়েছিল সংবিধান। এটি সামরিক শাসক জিয়াউল হকের তৈরি। পরে আসিফ আলী জারদারি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে উদ্যোগ নিয়ে নিজের ক্ষমতা ছেঁটে দেন।

আমাদের দেশে একবার এমন অবস্থা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী পত্রপাঠ বিদায় নিয়েছিলেন। তাঁর অপরাধ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তাঁর দলের প্রতিষ্ঠাতার কবরে যাননি, ফুল দেননি। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের যাঁরা আইকন, তাঁদের কবর জিয়ারত না করা একটা বড় রকমের অপরাধ। বিএনপি ক্ষুব্ধ হলো। রাষ্ট্রপতিকে ইমপিচমেন্টের ভয় দেখাল। তিনি সুবোধ বালকের মতো পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগ না করলে তাঁর কিছুই হতো না। গুরুতর অসদাচরণ বা রাজনৈতিক স্খলনের অভিযোগ প্রমাণিত না হলে ইমপিচ করা যায় না। বদরুদ্দোজা চৌধুরী একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন, রাষ্ট্রপতি দলনিরপেক্ষ থেকে হিসাব করে পা ফেলবেন। তিনিও তা চেয়েছিলেন। একচেটিয়া দলতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর দাঁড়ানোর সাহস হয়নি।

সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির পদটি আলংকারিক। তারপরও এটি একটি সম্মানিত প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রপতিরা যেভাবে তাঁদের পৃষ্ঠপোষক দলের পক্ষ নেন, তাতে এই পদের কোনো গুরুত্ব থাকে না। একটি ‘সার্চ কমিটি’র মাধ্যমে গতবার নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। এই কমিটি করা নিয়েও জল কম ঘোলা হয়নি। সার্চ কমিটির পরামর্শ কী ছিল, তা আজও জানা যায়নি। আমরা গণমাধ্যমে দেখলাম, যে পাঁচজনকে নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করলেন, তাঁদের মধ্যে চারজন এসেছেন তরীকত ফেডারেশনের প্রস্তাবে, আরেকজনকে প্রস্তাব করেছে বিএনপি। রাজনীতিতে তরীকতওয়ালারা যে এত গুরুত্বপূর্ণ, আগে জানতাম না। আমরা কত অজ্ঞ!

আমরা সবাই জানি ও বুঝি, নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা সবাই ‘হ্যান্ডপিকড’। সরকার ঠিক করে দেয়, রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করেন। নির্বাচন কমিশন যে কত ‘স্বাধীন’, সেটি দেখানোর জন্য হারাধনের একটি ছেলে মাহবুব তালুকদারকে রাখা হলো। তিনি অনেক ব্যাপারেই ভিন্নমত দেন, প্রতিবাদ করেন। কিন্তু সংখ্যাগুরুর কাছে হেরে যান। এই একজন ভিন্নমতাবলম্বীকে নিয়েও সরকার বিব্রত। কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্তব্য করেছেন, মাহবুব তালুকদার একজন মানসিক রোগী। এটি আমরা টেলিভিশনে শুনেছি, পত্রিকায় পড়েছি। ক্ষমতাসীন দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতা যখন এ রকম বলেন, তখন বোঝা যায়, তাঁকে নিয়ে তারা কত ক্ষুব্ধ।

ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকার কারণে মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে প্রায়ই আমার ফোনালাপ হয়। বুঝতে পারি, আমাদের কথোপকথন রাষ্ট্রের অতন্দ্র প্রহরীরা হয়তো রেকর্ড করছেন। সুযোগমতো কোনো টিভি চ্যানেলে দিয়ে দেবেন, তারপর মামলা হবে। মামলায় ভয়ে এখন আমরা অনেকেই ফোনে কথা বলি না। অনেকেই হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করি। সেটিও কত ‘নিরাপদ’, জানি না। মুখ ফুটে মনের কথা বলতে না পারায় দম বন্ধ হয়ে আসে।

মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম:

কেমন আছেন?

আমি অসুস্থ।

কী অসুখ?

কেন জানো না? তুমি পত্রিকা পড়ো না?

পত্রিকায় তো আপনার অসুখের কোনো সংবাদ চোখে পড়েনি।

এই যে বলা হচ্ছে, আমি মানসিক রোগী! আমাকে এখন মানসিক চিকিৎসা নিতে হবে।

দল তো মাত্র দুটি। বাকিগুলো বেশির ভাগই ‘গৃহপালিত’। কেউ আওয়ামী লীগের, কেউ বিএনপির। মোদ্দা কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে একটা সন্ধি হতে হবে। তা না হলে বিষয়টির সুরাহা হবে না। তবে সন্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ। মূল কারণ, চেয়ার একটা, বসতে চান দুজন। একজনকে ধাক্কা মেরে ফেলে না দিলে তো আরেকজন বসতে পারবেন না।

বর্তমান কমিশন মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই নতুন একটি কমিশন নিয়োগ দিতে হবে। এবারও সার্চ কমিটি হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নাগরিক সমাজের অনেকেই বলছেন, কমিশন নিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন থাকা দরকার। তা না হলে সংবিধানের বরখেলাপ হবে। সরকারের মন্ত্রী বলেছেন, কোভিডের ঝামেলায় আইন তৈরির সময় পাচ্ছেন না। তবে এটি হবে সরকারের এই মেয়াদেই। আইন তৈরি করব না—এমন কথা যেহেতু তাঁরা বলছেন না, সুতরাং কোনোভাবেই সংবিধানের বরখেলাপ হচ্ছে না।

নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি বেশ উচ্চকণ্ঠ। তারাও বলছে আইন তৈরির কথা। ক্ষমতায় থাকাকালে এটি তাদের মনে ছিল না বা তারা সময় পায়নি। এ ধরনের কিছু কিছু বিষয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরল ঐকমত্য দেখা যায়। তারা সবাই চায় একটি ‘গৃহপালিত’ নির্বাচন কমিশন। আগামী তিন মাস নির্বাচন কমিশন তৈরি করা নিয়ে হাওয়া গরম থাকবে। শুনতে পাচ্ছি, দেশে নাকি নিরপেক্ষ লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা তো একটা মারাত্মক সমস্যা। কমিশন তো বিদেশ থেকে আমদানি করা যায় না! নির্বাচনে সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কোনো সংলাপ বা মতবিনিময় হচ্ছে না। এটা জরুরি। সবাই মিলে তো একটা সমঝোতায় আসতে পারেন। এখানেও সমস্যা।

দল তো মাত্র দুটি। বাকিগুলো বেশির ভাগই ‘গৃহপালিত’। কেউ আওয়ামী লীগের, কেউ বিএনপির। মোদ্দা কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে একটা সন্ধি হতে হবে। তা না হলে বিষয়টির সুরাহা হবে না। তবে সন্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ। মূল কারণ, চেয়ার একটা, বসতে চান দুজন। একজনকে ধাক্কা মেরে ফেলে না দিলে তো আরেকজন বসতে পারবেন না।

এর বাইরে আছে দুটি স্রোতোধারা, কমিউনিস্ট পার্টিগুলো এবং ইসলামি দলগুলো। কমিউনিস্টরা অনেক দিন ধরে বলে আসছেন—নির্বাচনে মুক্তি নেই, বিপ্লব করতে হবে। দেশে তো একের পর এক বিপ্লব হয়েই যাচ্ছে—সবুজ বিপ্লব, আইটি বিপ্লব, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, মাছ উৎপাদনে বিপ্লব। এটি তাঁদের নজরে পড়ে না।

ইসলামি দলগুলোর মতিগতি বোঝা ভার। কখনো তারা ‘গৃহপালিত’ হয়ে যায়, কখনোবা এককাট্টা হয়ে তাণ্ডব শুরু করে। তাদের লক্ষ্য একটাই—শরিয়াহ আইনে দেশ চলবে। তো ক্ষমতাসীনেরা শরিয়াহ আইনের বিরোধিতা করতে পারছে না। বেশির ভাগ মানুষ মুসলমান। তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে, এমন কাজ কি সরকার করতে পারে?

আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছিল—পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন এ দেশে হবে না। দলটি তার কথা রেখেছে। কোনো নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না—হাইকোর্ট এই রায় দিয়েছেন। এই রায়ের ভিত্তি হলো শরিয়াহ। সরকার কি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে?

রাজনীতির এই মন্দা বাজারে জন্ম নিল আরেকটি দল—গণ অধিকার পরিষদ। এর নিউক্লিয়াস হলেন ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি নুরুল হক। আহ্বায়ক হিসেবে পেয়েছেন রেজা কিবরিয়াকে। রেজা সাহেবের কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। পিতার পরিচয়ে আওয়ামী লীগে ঢুকেছিলেন। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট না পেয়ে কামাল হোসেনের গণফোরাম থেকে নির্বাচন করেছিলেন। হেরে গেছেন। এই সংসদে আওয়ামী লীগের বাইরে বিরোধী পক্ষের যাঁরা ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন, তাঁরা সবাই ‘হ্যান্ডপিকড’। গণ অধিকার পরিষদকে ঘিরে নতুন কোনো স্রোতোধারা তৈরি হবে কি না, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

আমাদের নজর এখন পরবর্তী নির্বাচন কমিশন নিয়ে। এটা কি আরেকটা তামাশা হতে যাচ্ছে? ফুটবল মাঠের পাতানো খেলার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে রাজনীতির ময়দানে।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

    mohi2005@gmail.com