মতামত

পদ্মা সেতু যেভাবে আমাদের হলো

শুভ উদ্বোধন উপলক্ষে পদ্মা বহুমুখী সেতুর চারদিকে এখন সাজসাজ রব। গতকাল দুপুরে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি প্রান্তে
 ছবি: সাজিদ হোসেন

পেছনে ফিরে তাকানো যাক। আশির দশকে যখন যমুনা সেতুর (বঙ্গবন্ধু সেতু) পরিকল্পনা শুরু হয়। বিশ্বের মাপদণ্ডে ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা বড় নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা—এ তিন অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এল। কিন্তু তাদের নিজস্ব বিশেষজ্ঞরা যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা যাবে বলে বিশ্বাস করতে পারেননি। তাঁরা বিশ্বের আরও কিছু বিশেষজ্ঞকে নিয়ে এলেন। তাঁরাও সন্দেহ পোষণ করলেন—এত বড় ও শক্তিশালী নদীর ওপর সেতু বানানো সম্ভব কি না। কারণ, নদীর তলদেশে পাথর নেই।

পৃথিবীতে যমুনা ও পদ্মার চেয়েও বড় দৈর্ঘ্যের অনেক সেতু আছে। সেতুর দৈর্ঘ্য বাড়লে খরচ বাড়ে, কিন্তু কারিগরি জটিলতা তেমন বাড়ে না। যমুনার ক্ষেত্রে এর গভীরতা এবং সে সময়ে যা প্রযুক্তি ছিল, তাতে করে বিশ্বের খ্যাতনামা অধ্যাপকদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল সেতুর ব্যাপারে খুব একটা সায় দিতে চেষ্টা করেনি। বিশ্বব্যাংক তখন চাপ দিচ্ছিল উন্নত ফেরিব্যবস্থা তৈরি করতে। আমাদের তখন যুক্তি ছিল, ফেরিগুলো সরাসরি এপাড় থেকে ওপাড়ে যেতে পারে না, অনেক ঘুরে যেতে হয়। দ্বিতীয়ত, নদীভাঙনের কারণে নিয়মিত ফেরিঘাট স্থানান্তর করতে হয়। আমরা তখন বললাম, ফেরিব্যবস্থা থাকতে হলে নদী ব্যবস্থাপনাও (শাসন) থাকতে হবে। সেতু কিংবা ফেরি—যেটাই হোক, অত্যন্ত ব্যয়বহুল নদী ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে। ফলে সেতুর বিষয়টা যৌক্তিক হলো।

পৃথিবীতে সব দেশেই, বিশেষ করে অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে একটা আঞ্চলিক পরিকল্পনা করতে হয়। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উপকারটা কী ধরনের হবে। একই ধরনের সমীক্ষা পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও করা হয়েছে। এর পরের ধাপটা হলো প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা যাচাই। অর্থাৎ যতগুলো কারিগরি সম্ভাব্যতা আছে, সেগুলোর মধ্যে সামাজিক কারণে, অর্থনৈতিক কারণে, রাজনৈতিক কারণে, কারিগরি কারণে কোনটি সর্বোত্তম। তখন যমুনা সেতুর জন্য ছয়টি স্থান বিবেচনা করা হয়েছিল। রাজনৈতিক ও কারিগরি দিক থেকে সিরাজগঞ্জ-ভূঞাপুর অংশে সেতু করাটা ছিল সর্বোত্তম।

এর পরের ধাপের কাজ হলো সম্ভাব্যতা যাচাই। এটি অনুমোদিত হওয়ার পর, ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং অর্থাৎ কারিগরিভাবে সেতু কীভাবে নির্মিত হবে এবং বিস্তারিত নকশা করা হয়। (এখানে এগুলো বলার কারণ হচ্ছে, দেশে এত মেগা প্রকল্প হচ্ছে, সব কি যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে হচ্ছে? হচ্ছে না বলেই এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প শেষ হয় তিন হাজার কোটি টাকায়।) এর পরের ধাপ হচ্ছে ঠিকাদার ও উপদেষ্টাদের প্রাক্‌-নির্বাচন। এরপরে চূড়ান্তভাবে ঠিকাদার ও উপদেষ্টা নির্বাচন। প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা, সম্ভাব্যতা, প্রাক্‌-ঠিকাদার নির্বাচন, ঠিকাদার নির্বাচন, প্রাক্‌–উপদেষ্টা নির্বাচন ও উপদেষ্টা নির্বাচন। এসব ধাপ পেরিয়েই শুরু হতে পারে নির্মাণকাজ। যমুনা ও পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সব কটি ধাপই মেনে চলা হয়েছে।

পদ্মা সেতুর প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়েছিল যমুনার সঙ্গেই। প্রাক্‌-সম্ভাব্যতায় দেখা গেল, মাওয়া হচ্ছে সবচেয়ে ভালো জায়গা। কিন্তু কারিগরি দিক থেকে সেখানে সেতু নির্মাণ কতটা সম্ভব, হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই গেল। নানা কারণেই পদ্মা সেতুর প্রকৌশল ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। যমুনা সেতু সার্থকভাবে নির্মাণ করতে পারা আমাদের জন্য একটা বড় ব্যাপার ছিল। কারণ, প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্বাস জন্মাল, একটা শক্তিশালী বড় নদীর ক্ষেত্রে সেতু নির্মাণ ও নদী ব্যবস্থাপনা সম্ভব। পরবর্তী সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পদ্মা সেতুর ওপর সেতু নির্মাণে ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ শুরু হয়। তখন অনেক নতুন চ্যালেঞ্জ চলে এল। প্রথমত, যমুনা সেতুতে রেল নির্মাণে অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান রাজি হয়নি। উদ্বোধনের আগে আগে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তড়িঘড়ি করে হালকা ধরনের রেললাইন স্থাপনার কাজ করা হয়। কিন্তু পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে প্রথম দিন থেকেই সেতুতে রেল স্থাপিত হবে বলে ঠিক হয়। সেতুর ওপর রেললাইন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী করে করা হচ্ছে। কারণ এ রেললাইন দিয়ে দোতলা কনটেইনার যাবে। এ জন্য নকশায় রেললাইনকে নিচের তলায় রাখা হয়েছে।

এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক জড়িত থাকলে পরিবেশগত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে যে মান বজায় রাখা হতো, বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের অধীন একই মান বজায় রাখা হয়েছে। এখানে ৮০ হাজারের বেশি লোককে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে কারও কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। পরিবেশের ক্ষেত্রে অনেকে খুঁত খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনো খুঁত তাঁরা পাননি।

দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে যমুনার তুলনায় পদ্মা অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ, গঙ্গা নদী যেটা ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর স্থানীয়ভাবে পদ্মা নদী বলা হয়, কারিগরিভাবে আরিচা পর্যন্ত এটা গঙ্গা। ভারত থেকে প্রবেশ করার পর যে নদীটাকে আমরা যমুনা বলি, কারিগরিভাবে সেটা হলো ব্রহ্মপুত্র। দুটোই পৃথিবীর ১০টা শক্তিশালী নদীর মধ্যে অন্যতম। আর ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার যোগফল হচ্ছে পদ্মা। বর্ষার সময় প্রতি সেকেন্ডে ৩৫ লাখের চেয়ে বেশি ঘনফুট পানি প্রবাহিত হয়। এ ছাড়া মাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে দুই-তিন কিলোমিটার প্রশস্ততা দিয়ে প্রবাহিত হয়। সিরাজগঞ্জে যে নদী ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার, রাজশাহীতে যে নদী ৪ থেকে ৬ কিলোমিটার, অর্থাৎ ২০ কিলোমিটার দিয়ে যে পানি প্রবাহিত হয়, মাওয়াতে ২ থেকে ৩ কিলোমিটারের মধ্য সেই পানি প্রবাহিত হয়। কাজেই নদী সেখানে অত্যন্ত গভীর। শুকনো মৌসুমে ১০০ ফুটের বেশি গভীর। আবার নদী এখানে নড়াচড়াও করে। একবার পূর্ব দিকে আসে। তারপর নড়তে নড়তে মধ্যখান দিয়ে যায়। তারপর আসতে আসতে সেটা পশ্চিম দিকে পৌঁছায়। আমরা সমীক্ষা করে দেখেছি, পূর্ব থেকে পশ্চিমে নদীর নড়াচড়া করার জন্য ৬ কিলোমিটার জায়গা দরকার হয়। সে জন্য আমরা সেতুর দৈর্ঘ্য ঠিক করলাম ৬ কিলোমিটার। তবে নদীর গভীরতা ও শক্তি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই শক্তিশালী নদীতে সেতু নির্মাণ করা যাবে তো? আমার উত্তর ছিল, আমরা প্রকৌশলীরা গাণিতিক সূত্র ব্যবহার করে কী ধরনের নকশা করতে পারি সেটা ঠিক করতে পারি, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তার নির্মাণকৌশলে। শেষ পর্যন্ত সব প্রকৌশল চ্যালেঞ্জ সফলভাবেই মোকাবিলা করা গেছে। জামিলুর রেজা চৌধুরী, আমিসহ পাঁচজনের একটি কমিটি পদ্মা সেতুর ঠিকাদারদের প্রাক্‌–নির্বাচন, উপদেষ্টাদের প্রাক্‌-নির্বাচন এবং ডিজাইন চূড়ান্তকরণের কাজগুলো সম্পন্ন করি। সে সময় পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িত ছিল। বিশেষজ্ঞ প্যানেলে বিশ্বব্যাংকের মনোনীত কয়েকজন উপদেষ্টা ছিলেন। বিশ্বব্যাংক থাকাকালীনই পদ্মা সেতুর নকশা চূড়ান্ত করা হয়। ঠিকাদার ও উপদেষ্টা চূড়ান্ত করার সময়েই বিশ্বব্যাংক চলে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আরেকটি নির্দেশ জারি করেন, বিশ্বব্যাংক জড়িত থাকলে যে গুণগত মান রক্ষা করা হতো, পদ্মা সেতুতে যেন সেই গুণগত মান রক্ষা করা হয়। বিশ্বব্যাংকের নিয়োগ করা উপদেষ্টাদের পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়।

এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক জড়িত থাকলে পরিবেশগত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে যে মান বজায় রাখা হতো, বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের অধীন একই মান বজায় রাখা হয়েছে। এখানে ৮০ হাজারের বেশি লোককে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে কারও কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। পরিবেশের ক্ষেত্রে অনেকে খুঁত খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনো খুঁত তাঁরা পাননি।

ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত গর্বিত যমুনা ও পদ্মা সেতুর মতো দুটি জটিল প্রকল্পে জড়িত থাকতে পেরেছি। ঠিকাদার নির্বাচনসহ অন্যান্য কাজে জটিলতা হতে পারত। সেখানে দৃঢ়তার সঙ্গে সরকারের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে কাজ করতে পেরেছি। আজ সেতুর একটি অংশ অর্থাৎ সড়ক সেতুর উদ্বোধন হচ্ছে। রেলের কাজ শেষ হতে কিছুটা সময় লাগছে। এই কাজ যত দ্রুত শেষ করা যাবে, তত বেশি মানুষকে উপকার দেওয়া যাবে।

নদীশাসনের কাজটা এখনো শেষ হয়নি। ২০২৩ সালের জুন নাগাদ এটা শেষ হবে বলে আশা করছি। তবে শেষ হওয়ার পরও সেতু ও নদী ব্যবস্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আশা করব যতটা দক্ষতার সঙ্গে সরকার সেতু নির্মাণকাজে সমর্থন দিচ্ছে, সেতু রক্ষণাবেক্ষণেও একই ধরনের দক্ষতা বজায় রাখবে।

আইনুন নিশাত পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক