মতামত

পদ্মা সেতু করতে পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন কেন নয়

গত সপ্তাহে প্রথম আলোয় অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, ‘আমরা পারি কিন্তু আমরা পারি না।’ তিনি বলেছেন, বিদেশি প্রযুক্তিজ্ঞান, দক্ষতা ও জনবল কাজে লাগিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব রেখেও যে বৃহৎ প্রকল্প করা যায়, পদ্মা সেতু তার প্রমাণ। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সরকার এই স্বনির্ভরতা দেখাতে পারেনি বা দেখাতে চায়ওনি। তাই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা গেলেও বাংলাদেশ পরনির্ভর অর্থনৈতিক নীতি থেকে সরে আসতে পারেনি।

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের শেষ দিনও দুটি বিষয় নিয়ে বেশ উত্তপ্ত ছিল—নির্বাচন ও পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন। এতে দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা কেবল সরাসরি যুক্ত হলো না, ওই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে, নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে, মানুষের কর্মসংস্থান হবে। যাঁরা একসময় পদ্মা সেতু নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, তাঁরাও সরকারের এই সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। এখন সরকারের উচিত সামনের দিকে তাকানো; অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে, যাতে এই সেতু থেকে জনগণ সর্বাধিক সুবিধা পেতে পারে।

নির্বাচন নিয়ে সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা যে উত্তাপ ছড়িয়েছেন, তার লক্ষ্য যদি হয় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু তাঁরা যদি অতীতের মতো পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে পাঁচ বছর পার করে দেন, কোনো মীমাংসায় না আসেন, তাহলে আবার হয়তো বাংলাদেশ হরতাল-অবরোধ–নির্বাচনী সহিংসতার যুগে ফিরে যাবে।

সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের কথায় মনে হয়, তাঁরা বিএনপিকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে চান। বিএনপিকে কীভাবে নির্বাচনে আনবেন? বিএনপির নেতারা বলে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অন্যদিকে সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের ভাষ্য হলো, নির্বাচন বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই হবে। আওয়ামী লীগের নেতারা যদি মনে করেন, বিএনপির মতো বড় দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না, তাহলে তাঁরা বিএনপির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করছেন না কেন? বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে ধরনা দেওয়ার চেয়ে দেশের ভেতরে ওই দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করাই কি যুক্তিসংগত নয়? এর আগে আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছিল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাতকে বাত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কথা বলেছেন। পরে দেখা গেল পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রতিনিধিদলও একই কথা বলেছে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠককালে।

আওয়ামী লীগ সাড়ে ১৩ বছর একটানা ক্ষমতায়। তাদের দাবি, ক্ষমতার ধারাবাহিকতা থাকায় দেশের অনেক উন্নতি করেছে। মানুষের গড় আয় ও আয়ু দুটোই বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজস্ব অর্থায়নে তারা পদ্মা সেতু করে দেখিয়ে দিয়েছে, ‘আমরাও পারি।’ একইভাবে আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জটি নিয়ে দেখাক, তাদের আমলে সুষ্ঠু নির্বাচনও সম্ভব।

শৈশবে পাকিস্তানে আমরা সত্যিকার ভোট দেখিনি, দেখেছি বেসিক ডেমোক্রেসি। এখন আমাদের উত্তর প্রজন্মও ভোটাধিকার থেকে অনেকটা বঞ্চিত। আইয়ুব খান বেসিক ডেমোক্রেসি নামে এমন এক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যেখানে প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য—সবাই নির্বাচিত হতেন বেসিক ডেমোক্র্যাটদের ভোটে। এরপর আইয়ুবের জমানা শেষ হলো। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সামরিক ও বেসামরিক চক্র নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছয় দফা এক দফায় পরিণত হয়। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এরপর আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানও পেলাম।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালে। সেই নির্বাচনে বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসবে, এটা কেউ ভাবেননি। ধারণা ছিল, বিরোধী দল ৩০ থেকে ৪০টি আসন পাবে। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল বিরোধী দল মাত্র ৭টি আসন পেয়েছে। বিরোধী দলের অনেক নেতাকে গায়ের জোরে হারানো হয়েছে। সেই নির্বাচনে খন্দকার মোশতাকসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে জবরদস্তিভাবে জিতিয়ে আনা না হলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত। অন্তত মোশতাক ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সুযোগ পেতেন না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সমর্থন দিয়েছেন বলেই পদ্মা সেতু নির্মাণে সমর্থ হয়েছি। যারা বাধা দিয়েছিল, তাদের একটা উপযুক্ত জবাব দিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু করে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী করেছেন, সন্দেহ নেই। স্বাভাবিকভাবে মানুষ চাইবে গণতন্ত্রের ভিতটিও শক্তিশালী হোক।

কীভাবে সেটা সম্ভব? একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। সংবিধান অনুযায়ী জনগণ বাংলাদেশের মালিক। নির্বাচনই হলো সেই মালিকানা নির্ধারণের প্রধান অবলম্বন। বাজেট অধিবেশনের সমাপনী দিনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নির্বাচন প্রশ্নে সরকার সংবিধানের এক সুতাও বাইরে যাবে না। প্রশ্নটি বাইরে বা ভেতরে যাওয়ার নয়। প্রশ্নটি হলো একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে সরকারের সদিচ্ছা আছে কি না। ১৯৯৫-৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল, তখন বিএনপির নেতারাও একই কথা বলতেন। অন্যদিকে বিএনপির যে নেতারা এখন তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না বলে সভা–সমাবেশে জোর আওয়াজ তুলছেন, ২০০৬-২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটি নষ্ট করতেও তাঁরা কম কসরত করেননি।

রাজনীতিকেরা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী সংবিধান, নির্বাচন, গণতন্ত্র, সংসদীয় ব্যবস্থা ইত্যাদির ব্যাখ্যা দেন। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কোনো আদর্শ উপায় নয়, চোর ঠেকানো। আমরা যখন সত্যিকারভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে পারব, তত্ত্বাবধায়কের প্রয়োজন হবে না। যেখানে দলীয় সরকার প্রশাসন থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে ইভিএম—সবকিছু নিজের দখলে নেন, সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া বিকল্প কী। উচ্চ আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে (যদিও সেই রায়ে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছিল) তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করার পর আওয়ামী লীগেরই দায়িত্ব ছিল দলীয় সরকারের অধীন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেখানো। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তারা সেটি পারেনি। এক মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপির জবরদস্তি যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করে, এখন তো ঘরে ঘরে মাগুরা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সাড়ে ১৩ বছর একটানা ক্ষমতায়। তাদের দাবি, ক্ষমতার ধারাবাহিকতা থাকায় দেশের অনেক উন্নতি করেছে। স্বল্প আয়ের দেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাচ্ছে। মানুষের গড় আয় ও আয়ু দুটোই বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজস্ব অর্থায়নে তারা পদ্মা সেতু করে দেখিয়ে দিয়েছে, ‘আমরাও পারি।’ একইভাবে আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জটি নিয়ে দেখাক, তাদের আমলে সুষ্ঠু নির্বাচনও সম্ভব।

যে দল বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতা সত্ত্বেও পদ্মা সেতু করতে পারে, সেই দল কেন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে না?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com