পদ্মা নদীর তল থেকে ৪২ তলা গভীর কূপে নামতেন যাঁরা, সেই নির্মাণশ্রমিকদের কথা কি আপনাদের মনে আছে? ২০১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় তাঁদের কথা লিখেছিলেন প্রতিবেদক কমল জোহা খান। পদ্মা সেতুর ৪২টা পিলারের নিচে আছে পাইল। সেই পাইল বসানোর জন্য প্রতিটি পিলারের স্থানে প্রথমে ৬টা করে স্টিলের বেড় দেওয়া কূপ বসানো হয়। ১০ ফুট ব্যাসের কূপ। তারপর সেই কূপের ভেতরে মাটি-পানি অপসারণ করা হয় পাম্প করে। তখন ৪২০ ফুট গভীর সেই অন্ধকার কূপের মধ্যে নামতে হতো বাংলার নির্মাণবীরদের।
২০১৭ সালের সেই প্রতিবেদন থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘কথাগুলো পড়লে আপনার চোখও হয়তো অজান্তেই ভিজে উঠবে, “অন্ধকার পাইলের মধ্যে নামতে ভয় করে না?” এমন প্রশ্ন শুনে অনেকটা অবাক হলেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, “ভয় কিসের! কাজ করতে এসে ভয় কিসের! অন্যরা যেমন কাজ করে, আমরাও তেমনই কাজ করি।” এর সঙ্গে যুক্ত করেন, “ভয় করে না, কারণ পাইলের মুখের চারপাশ ঘিরে রাখা হয়। তবে পাইলের মধ্যে নামলে ভীষণ গরম লাগে। এত গরম যে বলার মতো না। ঘামে শরীর ভিজে যায়। তাই পাতলা কাপড় পরে নামতে হয়।”
পাইলে নামার সময় সব ধরনের নিরাপত্তাই থাকে বলে জানান রাজু নামে আরেক শ্রমিক। তিনি বলেন, পাইলের নিচের জায়গা বেশ ফাঁকা। তবে গরমে বেশি সময় পাইলের মধ্যে থাকা যায় না। শীতকাল, গরমকাল সব সময়ই পাইলের ভেতর গরম লাগে।
তাজুল, জাকির, মোস্তফার মতো তিন হাজার শ্রমিকের বিন্দু বিন্দু ঘামে গড়ে উঠছে পদ্মা সেতু। সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে ছাড়তে হবে পদ্মার পাড়। তবু কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ, পদ্মা সেতু দেখিয়ে দিচ্ছে বড় পথ। যেখানে বুক ফুলিয়ে আরও গভীরে নামতে হবে তাঁদের।’
আগামীকাল ২৫ জুন ২০২২ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। গৌরব আর আত্মমর্যাদার প্রতীক এই পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে যখন অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনন্য সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। নিজেদের টাকায়ই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, জনগণের উপার্জিত টাকায় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়েছে! ‘মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না’—বঙ্গবন্ধুর এই কথা তো আমাদের আবারও উদ্বুদ্ধ করবেই।
পদ্মা সেতু রাজনৈতিক মর্যাদা, স্বনির্ভরতা, সাহস, দৃঢ়তা, সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাসের প্রতীক; তা যেমন আমরা বারবার বলব, তার পাশাপাশি যেন আমরা গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করি, এই পদ্মা সেতু নির্মাণ সারা পৃথিবীর সামনেই একটা ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ান্ডার’, প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আদর্শ উদাহরণ।
২২ জুন ২০২২ সংবাদ সম্মেলনে বারবার করে প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করছিলেন বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের অবদানের কথা, বিশেষজ্ঞদের কথা। স্মরণ করছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর কথা। প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন, জামিলুর রেজা চৌধুরী দেখে যেতে পারলেন না! গত ২৮ এপ্রিল ২০২০ আমরা তাঁকে হারিয়েছি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম আলোয় ‘পদ্মা সেতু: স্বপ্ন আজ সত্যের পথে’ শিরোনামে একটা অনলাইন আলোচনা সঞ্চালনার সুযোগ পেয়েছিলাম। অংশ নিয়েছিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান অধ্যাপক এম শামীম জেড বসুনিয়া, প্যানেল সদস্য অধ্যাপক আইনুন নিশাত, অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদ, অধ্যাপক ড. এ এম এম সফিউল্লাহ। আরও অংশ নেন অধ্যাপক ড. শামসুল হক। ক্লাসরুমে আমার সরাসরি শিক্ষক এসব কৃতী মানুষের কথা শুনছি বারবার; স্যাররা সেদিনের আলোচনায় বারবার বলছিলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রত্যাখ্যানের পর জামিলুর রেজা চৌধুরী আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু করেছি; ইঞ্জিনিয়ারিং দিকটা বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ প্যানেল সুষ্ঠুভাবে সামলাতে পারবে; আপনারা অর্থের দিকটা দেখুন।’ যমুনা সেতুতে জামিলুর রেজা চৌধুরী, আইনুন নিশাত, ফিরোজ আহমেদ স্যার যুক্ত ছিলেন।
পদ্মা সেতু রাজনৈতিক মর্যাদা, স্বনির্ভরতা, সাহস, দৃঢ়তা, সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাসের প্রতীক; তা যেমন আমরা বারবার বলব, তার পাশাপাশি যেন আমরা গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করি, এই পদ্মা সেতু নির্মাণ সারা পৃথিবীর সামনেই একটা ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ান্ডার’, প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আদর্শ উদাহরণ।
আমার আরেক শিক্ষক ড. মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল সান ফ্রান্সিসকো থেকে যুক্ত ছিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পে। প্রথম আলো ইংরেজি অনলাইনে তিনি লিখেছেন ‘চ্যালেঞ্জেস ডিউরিং কনস্ট্রাকশন অব আইকনিক পদ্মা ব্রিজ’ (২০ জুন ২০২২)। পদ্মা প্রমত্ত নদী, আমাজনের পরেই পৃথিবীতে এটা হলো সবচেয়ে খরস্রোতা নদী। এই যে ৪২টা পিলার সমুদয় ওজন বহন করবে, পিলারগুলো থাকবে কিসের ওপর? স্রোত পদ্মার তলদেশে ১৬০ ফুট পর্যন্ত মাটি ক্ষয়ে নিয়ে যায়। ১৬ তলা ভবনের সমান গভীর বললে কথাটা খানিক বোঝা যাবে। ভূমিকম্প হলে আরও ৪২ ফুট গভীরের মাটি তরল হয়ে চাপ নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। সে কারণেই ৪২ তলা গভীর করে পাইল বসানো হয়েছে। গুচ্ছ পাইল। তারপরও দেখা দিল সমস্যা। ৪২টা পিলারের নিচের মাটি পরীক্ষা করে দেখা গেল, অনেকগুলোর নিচে মাটির শক্ত স্তর নেই। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নদীর অনেক গভীরের স্তর শক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। ছয়টার জায়গায় সাতটা পাইল বসানো হয়েছে ২২টা পিলারের নিচে। এই পাইল বসানোর জন্য একাধিক হ্যামার ব্যবহার করা হয়েছে। আউয়াল স্যার লিখেছেন, ‘একটা হ্যামার হলো মেঙ্ক ৩৫০০ কেজে, জার্মান কোম্পানি মেঙ্কের তৈরি, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার।’
ইস্পাতের ওপরের কাঠামো আর পিলারের মাঝখানে বিয়ারিং বসানো হয়েছে। এটা অনেক বড় ভূমিকম্প থেকে এই সেতুকে রক্ষা করবে। ড. আউয়াল জানাচ্ছেন, বিয়ারিং বসাতে গিয়েও একটা সমস্যা দেখা দিল। এই বিয়ারিং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিয়ারিং। স্থাপন করা সহজ নয়। ২০০২ সালে সান ফ্রান্সিসকোর বেনিসিয়া মার্টিনেজ সেতুতে এই ধরনের বিয়ারিং প্রথম ব্যবহার করা হয়। চীনের উহানে তৈরি এই বিয়ারিং পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, এর ক্ষমতা একেবারে নিখুঁত মানসম্পন্ন আছে কি না। কিন্তু পদ্মা সেতুতে বসাতে গিয়ে একটা বিয়ারিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন প্যানেল কোয়ালিটিতে একবিন্দু ছাড় দিতে রাজি নন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্যানডিয়েগোর শ্রেষ্ঠতম ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে কোয়ালিটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল ওই বিয়ারিং বসানো হয়েছে।
আমেরিকার এইসিওম পদ্মা সেতুর নকশা করেছে। স্ট্রাকচার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এইসিওমের পরিচালক ড. রবিন স্যামের লেখা থেকে এই সেতুর নকশার চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। চায়না মেজর ব্রিজ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি নির্মাণকাজ করেছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই কাজের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। এর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান, মানুষ, দেশ এই সেতুর সঙ্গে যুক্ত। প্রধানমন্ত্রী ২২ জুনের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সব মিলে পদ্মা সেতুর প্রকল্প ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২১ জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা।
ড. মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল জানাচ্ছেন, সান ফ্রান্সিসকোর বে ব্রিজের খরচ ১৯৯৯ সালে ধরা হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলার, ২০০২ সালে শুরু করে ২০১৩ সালে নির্মাণকাজ শেষে এর খরচ দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। আউয়াল স্যারের মতে, পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ লাইন, ভূমিকম্পসহ করা, বিয়ারিং জটিলতা আর ১৬ বছরের মুদ্রাস্ফীতি মিলিয়ে আনুমানিক ৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় রিজনেবল বা যৌক্তিক।
তাহলে আমরা আবারও একবার আমাদের প্রকৌশলী, নির্মাণ কারিগর, বিশেষজ্ঞ, কর্তা, শ্রমিকসহ দেশ-বিদেশের প্রকৌশল এবং ব্যবস্থাপনা-কর্মীদের স্যালুট জানাই। আর প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, সেটাই আবার বলি, এই সেতুর গৌরব বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের। দেশের মানুষকে সালাম। অন্ধকার খনির ভেতর নামা সেই তাজুলেরা এখন কোথায় আছেন জানতে ফোন করেছিলাম পদ্মা সেতুর একজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে। তিনি বললেন, কাজ শেষে নির্মাণশ্রমিকেরা কোথায় গেছেন, তা আমরা জানি না। তবে বেশির ভাগই বিদেশে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন।
তাজুল ভাইয়েরা, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন; আপনারা আমাদের সালাম গ্রহণ করুন।
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক