সাংবিধানিক পদসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য অতি উঁচু পদে যাঁরা নিযুক্ত হন, ওই সব পদে তাঁদের যোগ্যতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং একই রকম গুরুত্বপূর্ণ ওই সব পদে নিযুক্তির পর তার মর্যাদা রক্ষার বিষয়। যোগ্যতর ব্যক্তি নিযুক্তি পেয়ে সেই পদের মর্যাদা যদি রক্ষা করতে পারেন, সেটাই সবচেয়ে আদর্শ ও সুন্দর অবস্থা। অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ব্যক্তির পক্ষে পদের মর্যাদা রক্ষা করতে না পারা স্বাভাবিক। তবে মানুষটি যোগ্য, কিন্তু কোনো কারণে তিনি পদটির মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ, তা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা।
মানুষ মরণশীল প্রাণী হওয়ায় সে রোগ-শোক-জরার ঊর্ধ্বে নয়। যিনি যে পদ যে মেয়াদের জন্যই অলংকৃত করুন না কেন, তাঁকে তাঁর নিয়োগদাতার চেয়ে তাঁর জীবনদেবতার ইচ্ছার কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হয়। কঠিন কোনো অসুখ হলে দায়িত্ব পালন সম্ভব হয় না, মেয়াদ পূরণ করাও অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। তখন তাঁকে ছুটিতে যেতে হয়, এমনকি পদত্যাগও করতে হতে পারে। এর কোনোটাই অস্বাভাবিক নয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। সেটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। দেশান্তরি হয়ে তাঁর মনে হয়েছে ইস্তফা দেওয়াই শ্রেয়, তাই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি বরাবর। তাঁর অনুপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। সেটাই সংবিধানসম্মত ব্যবস্থা।
নতুন প্রধান বিচারপতি কবে কে হচ্ছেন এমন জিজ্ঞাসার জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আরেকজন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমানে যিনি দায়িত্বে আছেন তিনিই থাকবেন। সেটা এক বছর হলেও, উনিই দায়িত্বে থাকবেন।
প্রধান বিচারপতির নিয়োগসংক্রান্ত আইনমন্ত্রীর মতামত দেশবাসীর শিরোধার্য। তাঁর এই বক্তব্য যখন গ্রামের চা-দোকানে বসে কেউ পত্রিকায় পড়েছেন অথবা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কেউ টিভিতে শুনেছে, তাদের তা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আগামীর কোনো পাবলিক পরীক্ষায় যদি প্রশ্ন হয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির মেয়াদ কত দিন, ক. এক মাস, খ. ছয় মাস, গ. এক বছর এবং ঘ. অনির্দিষ্টকাল। কোনো পরীক্ষার্থী যদি ‘গ’-তে টিক চিহ্ন দেয়, তাকে নম্বর দিতে হবে; কেউ যদি ‘ঘ’-তে টিক চিহ্ন দেয়, তাকেও নম্বর দিতে হবে।
কবে নিয়োগ পেতে পারেন প্রধান বিচারপতি, এমন প্রশ্নের উত্তরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘এটা একান্তভাবেই রাষ্ট্রপতির ওপর নির্ভরশীল। এ বিষয়ে সংবিধানে নির্দিষ্ট করা কিছু নেই।’ তাঁর এই বক্তব্যেও ভুল নেই। তবে খ্যাতিমান আইনজীবী সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, সাময়িকভাবে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালনরত বিচারক দীর্ঘ মেয়াদ পূরণ করতে পারেন না। কারণ, প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি শপথ গ্রহণ করেননি, তাই তাঁর পক্ষে অন্য বিচারকদের শপথ পাঠ করানো সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত অতি মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। আইন ও ন্যায়বিচার–সংক্রান্ত যত গুরুতর বিষয়, সবই ফয়সালা হয় সেখানে। সেখানকার যেকোনো আদেশ ও দণ্ডাদেশ নাগরিক ও সরকার মানতে বাধ্য। বিরল হলেও কোনো কোনো দেশে উচ্চতম আদালতেও সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমন বছর দুই আগে হয়েছিল শ্রীলঙ্কায়। প্রধান বিচারপতি শিরানি বন্দরনায়েককে ইমপিচ করেছিল পার্লামেন্ট। পক্ষে ভোট পড়েছিল ১৫৫ এবং বিপক্ষে ৪৯ ভোট। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ অভিযোগ ছিল ১৪টি। তুলকালাম ব্যাপার ঘটেছিল। সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট বিচারপতি শিরানির অভিশংসন বেআইনি ঘোষণা করে রায় দেয়। পার্লামেন্ট ও উচ্চতম আদালতের মধ্যে দ্বন্দ্ব। আদালত নতুন বিচারপতিকে মেনে না নিতে আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানান। একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবেও উদ্বেগের সৃষ্টি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ উদ্বেগ জানিয়ে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ মীমাংসা চায়। (রাজনৈতিক পালাবদলের পর তাঁর সেই অভিশংসনও বাতিল হয়ে যায়।)
আগের দিনে রাষ্ট্রের গুরুতর ব্যাপার নিয়ে সাধারণ মানুষের মাথা ঘামানোর সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের হাতের মুঠোয় চলে যাওয়ায় রাষ্ট্রের কোথায় কী হচ্ছে তা তৎক্ষণাৎ মানুষ জেনে যাচ্ছে এবং তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও বিশ্লেষণ হচ্ছে। চৌরাস্তার বটতলায় যে লোকটি ফ্লাস্কে চা ও কলা-বিস্কুট বিক্রি করে, সেও সব খবর রাখে। তার খদ্দেরের সঙ্গে সে নানা বিষয়ে আলোচনা করে। ফলে কোনো ব্যাপারে রাষ্ট্র যদি তার দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করে বা ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, তা তার দৃষ্টি এড়ায় না। প্রধান বিচারপতির দেশান্তরি হওয়া ও নতুন প্রধান বিচারপতি কে কবে নিযুক্ত হচ্ছেন তা নিয়ে ঢাকার বাইরে রাস্তাঘাটে আলোচনা করতে শুনেছি।
আইনমন্ত্রী যে বলেছেন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার এবং অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির মেয়াদ এক বছরও হতে পারে—এই বক্তব্য মানুষের এখন আলোচনার বিষয়। সংবিধানমতে, রাষ্ট্রপতি দুটি পদে নিয়োগ স্বয়ং দেন—কারও পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই পদ দুটি হলো প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি। অন্যান্য নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করেন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে—এমন কোনো বিধান না থাকলেও অভিজ্ঞতা বলে, বাস্তবে সবাই প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, মেধা ও প্রজ্ঞার দিক থেকে দেশের প্রধান বিচারপতি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবেন, সেটাই মানুষের প্রত্যাশা। হাইকোর্টের রায়-আদেশ ও দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি করেন প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। তা ছাড়া সহকারী জজ থেকে জেলা পর্যায়ের সব আদালতের বিচারক বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালের প্রধানদের কাজের তদারকিও করেন প্রধান বিচারপতি। সুতরাং প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারকদের যোগ্যতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও নৈতিকতার মান অতি উঁচু হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
স্বাধীনতার আগে প্রাদেশিক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ বিচারকদের অনেকেই ছিলেন দক্ষ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী তাঁদের নির্দেশ মানেননি, যাঁরা তাঁকে নিয়োগ দিয়েছিলেন; তিনি মূল্য দিয়েছিলেন দেশের মানুষের আবেগকে। সেটা খুব সামান্য কাজ ছিল না। শামসুজ্জামান খানের অনুরোধে আমি বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের একটি ছোট জীবনী লিখেছিলাম, যা বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে। তাঁর কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখেছি অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। সরকারের অনাগ্রহ সত্ত্বেও রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে তাঁর ভূমিকা সবারই জানা। বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেনকে দেখেছি আইনশাস্ত্রের বাইরে সাহিত্য ও শিল্পকলা বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। গবেষণামূলক বইও লিখেছেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের পেশা ও জীবিকা যা-ই হোক, তাঁর প্রধান পরিচয় লেখক। অবসরজীবনের প্রায় সমস্ত সময়ই সারা দিন বই ঘাঁটাঘাঁটি করতেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে হাবিবুর রহমানই প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগে সবচেয়ে বেশি দিন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন ১০ মাসের মতো। তবে তা অস্বাভাবিক একটি বিশেষ অবস্থায় এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতে। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করায় বিচারপতি হাবিবুর রহমান তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রধান বিচারপতির পদ এক বেলার জন্যও শূন্য থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
সংসদীয় গণতন্ত্রে এক মাসে তিনবার সরকার বদল হতে পারে। রাষ্ট্রের তাতে কোনো ক্ষতি হয় না। ইতালিতে, জাপানে তেমন হতে দেখা গেছে, পূর্ব বাংলায়ও পঞ্চাশের দশকে হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সংগত কারণে সংসদও মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে দিতে পারেন এবং নতুন নির্বাচন দিতে পারেন। প্রশাসন স্থায়ী। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানেরা যথাপূর্ব থাকেন। সরকার পরিবর্তনে কিছু আসে-যায় না।
কাগজে দেখলাম, দাবি উঠেছে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠন করা হোক। এ কী একটা কথা! তা ছাড়া সার্চ কমিটি দিয়ে কী হয় তা মানুষ দেখেছে। সাংবিধানিক পদে নিয়োগের বিধান সংবিধানেই দেওয়া আছে এবং সেটিই অনুসৃত হওয়া কাম্য। তার বাইরে রাজনৈতিক বিবেচনায় বা গোপনে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। জাতিসংঘ ও তার অঙ্গ সংস্থার প্রধানদের নিয়োগের প্রক্রিয়ায় কোনো গোপনীয়তা নেই। যিনি নিয়োজিত হচ্ছেন, যোগ দেওয়ার বেশ আগেই তিনি জেনে যান। বিদায়ীর থেকে তিনি ধীরে-সুস্থে কাজ বুঝে নেন। আমাদের দেশে সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা দেখা যায়। তাতে সম্ভাব্য প্রার্থী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যের উৎকণ্ঠায় কাটে বিনিদ্র রাত।
উঁচু পদে যোগ্যতম ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া যেমন নিয়োগকর্তার দায়িত্ব, তেমনি পদের মর্যাদা রক্ষা করাও ব্যক্তির কর্তব্য। আগের দিনে দেখেছি যিনি যত উঁচু পদে থাকতেন, তিনি তত কম কথা বলতেন। বেশি কথা বললে অপ্রয়োজনীয় কথা বেশি বলা হয়, যা কখনো ব্যক্তির চাকরিকে শুধু নয়, জীবনকেই বিপন্ন করে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন নগ্নভাবে দলীয়করণ হলে রাষ্ট্রেরও ক্ষতি, সরকারি দলেরও ক্ষতি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা আতঙ্কে থাকেন। চাকরি খোয়ানোর ভয়, অবমানিত হওয়ার ভয়। স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। ফলে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবার বিবেচনায় থাকা বাঞ্ছনীয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।