প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কথা। সে সময় ‘মহিলারোপ্য’ নামে দক্ষিণ ভারতে একটি রাজ্য ছিল, যে রাজ্যের রাজা অমরশক্তি ছিলেন খুব বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ। কিন্তু রাজার মনে কোনো শান্তি ছিল না। কেননা, তাঁর তিনটি ছেলেই ছিল অকাট মূর্খ ও অপোগণ্ড। পণ্ডিতেরা বলে গেছেন, অপুত্রক, ভূমিষ্ঠ হয়ে মারা যায় এমন পুত্রও ভালো। কারণ, এরা স্বল্প দুঃখের কারণ হয়; কিন্তু মূর্খ পুত্র কখনো ভালো নয়। কারণ, তারা যত দিন জীবিত থাকবে তত দিন শুধুই কষ্ট দেয়। যা হোক রাজ্যের প্রধান সচিবের পরামর্শে রাজা তাঁর অপোগণ্ড পুত্রদের পড়ানোর জন্য বিষ্ণুকর্মা নামের এই নীতিশাস্ত্রবিদ পণ্ডিতকে নিয়োগ করেন। বিষ্ণুকর্মা সেই রাজপুত্রদের লেখাপড়াকে সহজ করার উদ্দেশ্যে মিত্রভেদ, মিত্রপ্রাপ্তি, কাকোলুকীয়, লব্ধ-প্রণাশ ও অপরীক্ষিতকারক নামে পাঁচটি উপদেশমূলক পুস্তক রচনা করেছিলেন, যেগুলোর সম্মিলিত নাম পঞ্চতন্ত্র। আর এগুলোর সাহায্যে বিষ্ণুকর্মা অতি অল্পকালের মধ্যেই অমরশক্তির তিন পুত্রকে নীতিশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন।
তা শিশুমনের উপযোগী এ কাহিনি ভারতবর্ষে তো বটেই, সারা পৃথিবীতেই সমাদৃত হয়েছে। মধ্যযুগ পঞ্চতন্ত্রের কাহিনি পারস্য হয়ে আরব দেশে পৌঁছায় এবং ওখানে ওটার নামকরণ করা হয় কালিলা ওয়া দামনা। পঞ্চতন্ত্রে বিবৃত কাহিনির অন্যতম কুশীলব হচ্ছে দমনক ও করটক নামের দুটো বুদ্ধিমান শিয়াল এবং বলাই বাহুল্য, কালিলা ও দামনা হচ্ছে যথাক্রমে করটক ও দমনকের আরব্য সংস্করণ। প্রফেসর হিট্টি তাঁর হিস্ট্রি অব দ্য সারাসেনস (History of the Saracens) গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, গুটি কয়েক গীতিগল্পও উদ্ধৃত করেছেন; আর আমাদের সৈয়দজাদা মুজতবা আলী সাহেবও দেশ পত্রিকায় রম্য সিরিয়াল লেখার সময় ‘পঞ্চতন্ত্র’ শিরোনামটি বেছে নিয়েছিলেন।
সে যাকগে। এস্থলে আমি পঞ্চতন্ত্রের বিভিন্ন তন্ত্রে বিবৃত কাহিনিগুলোর অন্তর্নিহিত কতিপয় হিতোপদেশ পরিবেশন করছি—
(১) বিষমিশ্রিত অন্ন, শিথিল দন্ত এবং দুষ্টু মন্ত্রীকে পরিত্যাগ করাই উচিত।
(২) প্রভুর সামনে ভৃত্য নীরব থাকলে সে মূর্খ, বেশি কথা বললে বাতুলতা, সহনশীল হলে ভীরু, অসহিষ্ণু হলে সদ্বংশজাত নয়, সব সময় কাছে থাকলে ধৃষ্ট আর দূরে থাকলে অযোগ্য।
(৩) দুশ্চরিত্রা ভার্যা, মুখের ওপর জবাব দেওয়া ভৃত্য আর ঘরে সাপ নিয়ে বাস মৃত্যুতুল্য।
(৪) ধর্মে আটটি পথ আছে। তা হচ্ছে যজ্ঞ, তপস্যা, দান, অধ্যয়ন, সত্য বাক্য, সন্তোষ, ক্ষমা ও লোভশূন্যতা। প্রথম চারটির জন্য মানুষ গর্ব করে আর শেষের চারটি থাকে ধার্মিকদের জন্য।
(৫) উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষের সময়ে, রাষ্ট্রবিপ্লব উপস্থিত হলে এবং শ্মশানে (গোরস্থানে) যে উপস্থিত থাকে, সেই তো প্রকৃত বন্ধু।
(৬) যে দেশে সম্মান নেই, জীবিকা নির্বাহের উপায় নেই, বন্ধু নেই, বিদ্যাশিক্ষার কোনো উপায় নেই, সে দেশ ত্যাগ করাই ভালো।
(৭) পরশ্রীকাতর (এবং পরস্ত্রীকাতরও বটে), অত্যন্ত দয়ালু, অসন্তুষ্ট, ক্রোধী, অন্যের অন্নে জীবনধারণকারী ও সর্বদা শঙ্কামুক্ত—এরা সব সময়ই দুঃখ ভোগ করে থাকে।
(৮) অর্থনাশ, মনস্তাপ, গৃহ কলঙ্ক, বঞ্চনা ও অপমান বুদ্ধিমান মানুষ কখনো প্রকাশ করে না।
(৯) যুদ্ধের সময় বীরকে, ঋণ পরিশোধের সময় সজ্জনকে, ধর্মকর্মের সময় স্ত্রীকে আর বিপদের সময় বন্ধুবান্ধবদের ব্যবহারেই প্রকৃত স্বরূপ জানতে পারা যায়।
(১০) কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ ও মাৎসর্য—এই ছয় রিপু ত্যাগ করলে মানুষ সুখী হয়।
(১১) প্রণয় দ্বারা স্ত্রীকে, সম্ভ্রমের দ্বারা আত্মীয়-জ্ঞাতিবর্গকে, স্ত্রী এবং ভৃত্যদের অর্থ ও সরল ব্যবহার দ্বারা বশীভূত করবে।
(১২) যে স্ত্রী গৃহকর্মে নিপুণা, পুত্রবতী, পতিপ্রাণা এবং পতিব্রতা, সেই হচ্ছে প্রকৃত স্ত্রী।
পরিশেষে পরিবেশন করছি পঞ্চতন্ত্রের অন্তর্গত হরিণ ও কাকের বন্ধুত্ব-সংক্রান্ত সরস নীতি গল্পটি:
মগধ দেশে চম্পকবতী নামক বনে একটি হরিণ ও একটি কাক বন্ধুভাবে বাস করত। এক দিন হরিণকে দেখে এক শিয়ালের মনে খুব লোভ হলো। সে হরিণের মাংস খাওয়ার জন্য মনে মনে ফন্দি-ফিকির করতে লাগল। হরিণের বিশ্বাস অর্জন করতে সে হরিণের কাছে গিয়ে তার কুশল-সংবাদ জিজ্ঞেস করতেই হরিণ জিজ্ঞাসুনেত্রে তাকানোয় বলে উঠল, ‘আমি হচ্ছি শিয়াল। আমি বন্ধুহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সারা বনে একজনও প্রকৃত বন্ধু খুঁজে পেলাম না। তোমাকে দেখে আমার মনে হলো, তুমি বুঝি আমার প্রকৃত বন্ধু।’ শিয়ালের কথায় হরিণের মন গলে গেল। বলল, ‘ঠিক আছে, আজ থেকে আমরা দুজনে বন্ধু হলাম।’ শিয়াল মনে মনে খুব খুশি। অতঃপর ওরা দুজনে মিলে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সন্ধ্যা হয়ে এলে হরিণ শিয়ালকে তার নিজের বাসায় নিয়ে গেল, সেখানে তার বন্ধু কাকও চম্পকগাছে থাকত। তো শিয়ালকে দেখে ও বৃত্তান্ত শুনে কাক হরিণকে বলল, অজ্ঞাত কুলশীলের সঙ্গে বন্ধুত্ব! না-না, এ কাজটা তুমি মোটেই ভালো করোনি বন্ধু। অজ্ঞাতকুলশীলদের কখনো বাসস্থান দেওয়া ঠিক নয়। বৃদ্ধ শকুনও তো বিড়ালকে বাসস্থান দিয়েই নিহত হয়েছিল। বলেই সে শকুন ও বিড়ালের কাহিনি শোনাল।
ভাগীরথী নদীর তীরে পাহাড়ের চূড়ায় একটা পাকুড়গাছে অনেক পাখি একসঙ্গে বাস করত এবং তাদের সঙ্গে একটা বুড়ো শকুনিও ছিল। শকুনি বয়সের কারণে নিজে খাবার জোগাড় করতে পারত না বিধায় অন্যান্য পাখি খাবারের খোঁজে বেরিয়ে গেলে সে তাদের বাচ্চাগুলো পাহারা দিত আর পাখিগুলো ওর খাবার জোগাত। এভাবেই ওদের সুখের দিনগুলো যাচ্ছিল। কিন্তু একদিন অশনিসংকেতস্বরূপ এক বিড়ালের আগমন ঘটল। বিড়ালের ইচ্ছা পাখির বাচ্চাদের ধরে খাবে; কিন্তু তাকে দেখেই শকুনি তেড়ে এল। বিড়াল তখন বলল, ‘আমি নিরামিষভোজী। পাখিদের কাছে আপনার প্রশংসা শুনে আপনার কাছে ধর্মকথা জানতে এসেছি, আর আপনি অতিথি সৎকার না করে আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন?’ তার কথায় বিশ্বাস করে শকুনি বিড়ালকে থাকতে দিল; আর বিড়াল রোজই একটা করে পাখির বাচ্চা ধরে আহার করতে লাগল। কিন্তু এক দিন ব্যাপারটা ধরা পড়তেই বিড়াল বিপদ বুঝে পালিয়ে গেল এবং পাখিরা শকুনিকে ভুল বুঝে তাকে মেরে ফেলল।
কিন্তু শিয়াল তর্কাতর্কিতে ওস্তাদ। সে কাকের সঙ্গে তর্ক করে হরিণকে আশ্বস্ত করে ফেলল এবং অতঃপর তিনজনে মিলে বন্ধুর মতো বাস করতে লাগল। একদিন শিয়াল বুদ্ধি করে হরিণকে শিকারিদের পাতা ফাঁদে আটকিয়ে দিল। ওর ধারণা, শিকারিরা যখন হরিণকে কাটবে তখন ওর ভাগ্যে দু-একটা হাড় অবশ্যই জুটবে। হরিণ ফাঁদে আটকা পড়ে শিয়ালকে ডেকে বলল, ‘উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষের সময়ে এবং শ্মশানে যে উপস্থিত থাকে, সে-ই তো প্রকৃত বন্ধু। তুমি বুদ্ধি করে আমাকে বাঁচাও।’ কিন্তু ধূর্ত শিয়াল হরিণের কথায় কর্ণপাত না করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল।
শেষাবধি কাক বিষয়টা জানতে পেরে অনেক বুদ্ধি করে বন্ধুর প্রাণ বাঁচিয়েছিল, আর শিকারির ছুড়ে মারা লাঠির আঘাতে লুকিয়ে থাকা শিয়ালকে প্রাণ দিতে হলো। ওর উচিত শিক্ষাই হয়ে গেল।
আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷