মতামত

পঞ্চগড়ে পৌঁছে গেছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ

রাশিয়া শেষপর্যন্ত ইউক্রেনে হামলা চালাবে না, অনেকেই এমনটি ধারনা করলেও সেটি ভুল প্রমাণিত হলো এবং এই যুদ্ধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশেও
ফাইল ছবি: এএফপি

সবাই বিশ্বাস করছিল যুদ্ধটা হবে না। ঐতিহাসিকভাবে ইউক্রেনীয় আর রুশরা পরস্পরের জ্ঞাতি। ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতির বন্ধনও খুব দৃঢ়। কালজয়ী লেখক নিকোলাই গোগল রুশ না ইউক্রেনীয়—এ নিয়ে বাহাসও চলমান। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেঝনেভের জন্ম ইউক্রেনে। রুশ আত্মীয়, বন্ধু নেই এমন ইউক্রেনীয় নিতান্ত বিরল। ইউক্রেন সীমান্তে পুতিন যখন সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র জড়ো করছিলেন, সবাই তখনো ভাবছিল এর সবই চাপ সৃষ্টির জন্য। পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করবেন, পুনঃপুনঃ উচ্চারিত মার্কিনদের এমন হুঁশিয়ারিকেও কেউ অতটা গুরুত্ব দেয়নি।

যুদ্ধ বাধলই তবু। এর বিভিন্ন নাম দেওয়ার চেষ্টা করেছে বিভিন্ন দেশ, তবে বাস্তবতা হচ্ছে এটি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নিখাদ ও নগ্ন রুশ আগ্রাসন। কোনো যুক্তিতেই শান্তিপূর্ণ সার্বভৌম একটি দেশের বিরুদ্ধে এ আগ্রাসন সমর্থন করা যায় না এবং রাশিয়ার (বা পুতিনের) এ কর্ম নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। তবে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুতে পশ্চিমের ভূমিকাকেও খাটো করে দেখার উপায় নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ওয়ারশ জোট ভেঙে যাওয়ার পর ন্যাটোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দুরবস্থায় নাকাল রাশিয়া তখন অনেকটা যেন পশ্চিমের করুণার পাত্র। একটা সুস্থ অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির যে প্রত্যাশা রুশ জনগণের মধ্যে ছিল, পশ্চিম সেটাকে সহায়তা করতে পারত। তা না করে ওয়ারশ জোটভুক্ত দেশগুলোতে বটেই, এমনকি বাল্টিক অঞ্চলের তিন সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে রাশিয়ার নিরাপত্তাবোধের অভাবকে আরও উসকে দেয় পশ্চিমা শক্তি। রাশিয়ার গভীরে প্রসারিত ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা ও আশঙ্কা—রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন, পশ্চিমের তা বুঝতে পারা উচিত।

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে রাশিয়ার ওপর, যার প্রভাব ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের অন্যতম জোগানদার রাশিয়া। ইউরোপে পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ চালু আছে এখনো কিন্তু রুশ তেল-গ্যাসের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং তাতেই বিশ্ববাজারে এ পণ্য দুটির দাম হু হু করে বাড়ছে। প্রতি ব্যারেল তেলের দাম এরই মাঝে ১০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ইউরোপের কয়লা আমদানিরও ৪৭ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। বিশ্ববাজারে ১৫ শতাংশ কয়লার জোগান দেয় রাশিয়া। যুদ্ধ নিয়ে পঞ্চগড়ের সমস্যা এখানেই।

২.

একসময় দেশের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল ছিল পঞ্চগড়। এক–দেড় একর জমি থেকে দুবেলা অন্নসংস্থান দুষ্কর ছিল প্রান্তিক চাষিদের জন্য। সে চাষি এখন তাঁর জমিতে ছোট চা–বাগানের মালিক। পাতা বিক্রির আয় থেকে ইট–সিমেন্টের ঘর উঠেছে, মোটরসাইকেল কিনেছেন অনেকেই। খেতমজুরদের কর্মের সুযোগ ও আয় বেড়েছে। এ সাফল্যের পিতৃত্ব দাবি করতে অনেকেই পছন্দ করেন, তবে সত্য হচ্ছে আর্থসামাজিক এ বিপুল পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে মোশাররফ হোসেন নামের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার উদ্যোগে।

দেশের চা–শিল্পে ক্ষুদ্র বাগানের ধারণা চালু করেন মোশাররফ হোসেন। চা–এর ক্ষেত্রে তাঁর তিন দশকের অভিজ্ঞতা আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কার্যক্রম অবলোকন করে তিনি এবং তাঁর সহযোগীরা নিশ্চিত হন পঞ্চগড়ে চা উৎপাদন সম্ভব। তাঁর নেতৃত্বে জোটবদ্ধ শতাধিক উৎসাহী টি প্লান্টারের বিনিয়োগে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি যাত্রা শুরু করে ২০০০ সালে নার্সারিতে চারা রোপণের মাধ্যমে। চার বছর পর ২০০৪ সালে পাতা থেকে চা উৎপাদনের কারখানা চালু করে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি। পঞ্চগড় এরপর আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। পঞ্চগড়ের সীমানা ছাড়িয়ে এখন এ উদ্যোগ বিস্তৃত হয়েছে ঠাকুরগাঁও জেলায়। ২০২১ সালে উত্তরবঙ্গের ২২টি ফ্যাক্টরিতে ২ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। সরকারের রাজস্ব যেমন বেড়েছে, চা উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে এর ফলে।

দূরবর্তী এ যুদ্ধ শুধু পঞ্চগড়কেই নয়, স্পর্শ করবে সারা দেশকে। দ্রব্যমূল্য এমনিতেই বাড়ছিল, যুদ্ধ সে আগুনে ঘৃতাহুতি দেবে। প্রান্তিক মানুষ হিমশিম খাবে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে। জ্বালানির উচ্চ মূল্য, পরিবহন, শিল্পোৎপাদন— সব ক্ষেত্রেই চাপ সৃষ্টি করবে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানি বাণিজ্যেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশ তো যুদ্ধের উপকরণ তৈরি করে না।

চা–বাগানে উৎপাদিত পাতা নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে প্রক্রিয়াজাত করে চা উৎপাদনই সনাতন পদ্ধতি। এর অর্থনীতির স্বাভাবিক কার্যক্রম এ রকম: এক কেজি চায়ের যা নিলাম মূল্য তার কমবেশি ৬০ শতাংশ পাবেন পাতা উৎপাদনকারী চাষি, ২০ শতাংশ হবে ফ্যাক্টরির খরচ, ২০ শতাংশ থাকবে গ্রস লাভ। চায়ের দাম ২০০ টাকা কেজি থাকলে এ ব্যবস্থা মসৃণভাবে চলে। সমস্যা দেখা দেয় দাম কমে গেলে, কারণ, পাতা থেকে চা প্রক্রিয়াকরণের ব্যয় তো কমে না।

বেশ কিছুদিন ধরে চায়ের দাম কম। সাধারণ মানের চা ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি চা বানাতে ৮০০ গ্রাম কয়লা লাগে জ্বালানি হিসেবে। যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম দ্বিগুণের বেশি হয়ে প্রতি টন এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ ডলারে। প্রতি কেজি চা বানাতে শুধু কয়লা বাবদ ব্যয় ৯ বা ১০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২১ টাকা। নিলামে চায়ের দাম বাড়েনি, কারণ, সিলেট অঞ্চলে জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহৃত হয়, ব্যয় প্রতি কেজিতে ছয় টাকা। পঞ্চগড়ের চা উৎপাদকদের লাভের গুড় পুরোটাই খেয়ে নিচ্ছে যুদ্ধের পিঁপড়া।

৩.

দূরবর্তী এ যুদ্ধ শুধু পঞ্চগড়কেই নয়, স্পর্শ করবে সারা দেশকে। দ্রব্যমূল্য এমনিতেই বাড়ছিল, যুদ্ধ সে আগুনে ঘৃতাহুতি দেবে। প্রান্তিক মানুষ হিমশিম খাবে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে। জ্বালানির উচ্চ মূল্য, পরিবহন, শিল্পোৎপাদন— সব ক্ষেত্রেই চাপ সৃষ্টি করবে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানি বাণিজ্যেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশ তো যুদ্ধের উপকরণ তৈরি করে না।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ৩ মার্চ রুশ আগ্রাসনের নিন্দা করে এবং অবিলম্বে ইউক্রেন থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয় ১৪১-৫ ভোটে। বাংলাদেশসহ ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। বাংলাদেশের এ অবস্থানের সঠিকতা নিয়ে মতভিন্নতা আছে। অনেকে মনে করেন, এ রকম নিরপেক্ষতা অবলম্বন বাংলাদেশের জন্য যথাযথ। আবার শক্তিমান একটি দেশ কর্তৃক দুর্বল প্রতিবেশীর ওপর হামলার বিরোধিতা না করা দীর্ঘ মেয়াদে কতটা বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল, সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে।

৪.

ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান যুক্তিসংগত বলে মন্তব্য করেন। বাংলাদেশের মতো চীনও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল। বেইজিংয়ে আমাদের রাষ্ট্রদূত এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেছেন বলে শুনিনি। চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যও অপ্রয়োজনীয় বলেই মনে হয়। আমাদের কোনো নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়ে বড় প্রতিবেশীদের পৃষ্ঠপোষকতামূলক মন্তব্য অনভিপ্রেত। চীনা পৃষ্ঠপোষকতা উপযোগী হতে পারত রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে। সেখানে কিন্তু ‘পরীক্ষিত বন্ধু’ চীনকে কোনো ইতিবাচক ভূমিকায় আমরা দেখতে পাইনি।

  • মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব