বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ মূলত বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে প্রতিনিয়ত তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও নীতির মাধ্যমে একটি নিরন্তর প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে পরিচালনা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়ে থাকে। বাংলাদেশও এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের বা উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে, প্রতিটা দেশ মূলত সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে থাকে আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে নিজস্ব ছাঁচে ফেলে বাস্তবধর্মী কৌশল অবলম্বন করে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না, এটি আমদানি-রপ্তানির ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষা–স্বাস্থ্য জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন তথা মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করে।
উন্নয়ন বলতে মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে জনসাধারণের জীবনযাপনের মানের ক্রমান্বয়ে উন্নয়ন প্রক্রিয়া বা টেকসই উন্নয়ন বা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নকে বোঝায়, যে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সমাজের সব স্তরের মানুষের সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ বা ‘সোশ্যাল ইক্যুইটি ও ইকু৵য়ালিটি’ নিশ্চিত হয়। যে উন্নয়নের সুবিধাগুলোর সুষম বণ্টনের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস ও সব মানুষের জীবনযাপনের আদর্শ মান রক্ষায় মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয়। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের মতে, একটা দেশের জনসাধারণের জীবনযাপনে স্থায়ীভাবে মানোন্নয়ন ঘটলে সেটিকে উন্নয়ন বলা যাবে, যা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তা টেকসইভাবে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। উন্নয়নকে টেকসই করার জন্য আর্থসামাজিক বাধাগুলো অতিক্রম করে জাতি, ধর্ম, বয়স বা অক্ষমতানির্বিশেষে সবার পরিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা ও সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করে সবার মানবিক (মানসিক ও দৈহিক) সক্ষমতার উন্নয়ন একান্ত আবশ্যক।
মানবজীবন একটি অখণ্ড ধারা, যা জলধারা বা নদীর মতো, তার চেতনাও অখণ্ড। শিশুকালে সে বাবা–মা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হয়, অভিজ্ঞতা অর্জন করে। শিশুর মস্তিষ্ক কাদামাটির মতো। বিভিন্ন উদ্দীপকে সাড়া দিয়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতাজনিত উপলব্ধির ফলে তার মননের পরিবর্তন ঘটতে থাকে, শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে উপনীত হয়। এভাবে বিভিন্ন ধাপের ক্রম–পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতা নিয়ে সে অগ্রসর হয়; কিন্তু মনের গহিনে অপরিবর্তিতই থাকে। তাই শিশুকাল প্রতিটি মানুষের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুকাল থেকে উন্নত মননশীলতা এবং মূল্যবোধের ভিত্তি তৈরি হলে, তা পরবর্তীকালে নিজের ও সমাজজীবনে ভূমিকা রাখে। কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালে মানুষের জীবন সবচেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ, কৌতূহলী ও জয় করার প্রবল ইচ্ছাপূর্ণ থাকে। এ সময় প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষা এবং দিকনির্দেশনার অভাবে জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সঠিক ও ন্যায়ের পথটি হয়ে পড়ে কঠিন, তারা সহজেই অন্যায়, অসদুপায় অবলম্বন করে।
এশিয়ার মধ্যম বা উন্নত দেশ যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান বা চীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচনালগ্ন থেকেই রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি সর্বজনীন সাক্ষরতা অর্জনসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছে। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে একটি দেশের মাথাপিছু উৎপাদন বা আয়ের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নতির সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির গতিধারা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। সর্বোচ্চ মানব উন্নয়ন সূচক এবং বিশ্বশান্তি সূচকে প্রথম স্থানে থাকা এশিয়ার উন্নত টেকসই অর্থনীতির দেশ জাপান।
জাপানিদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সর্বজনবিদিত। শক্তিশালী আইনশৃঙ্খলা নয়, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লালিত পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল, যা তারা মনেপ্রাণে ধারণ করে। বিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি গুরুত্বের সঙ্গে শিশুদের আচার-আচরণ শেখানো হয়। বয়স্কদের সম্মান, রাস্তা পারাপারে সহায়তা, মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেওয়া, সবাই মিলে কাজ করার শিক্ষা শিশুদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়। একসঙ্গে শ্রেণিকক্ষ ও ক্যাফেটেরিয়া পরিষ্কার করা, কোনো কাজকেই ছোট করে না দেখার মানসিকতা জাপানের শিশুদের মধ্যে গড়ে ওঠে। এভাবে শিক্ষার পাশাপাশি শৃঙ্খলাবোধ ও দৃঢ়বন্ধন তাদের পরিবার, সমাজ আর মানুষের প্রতি উদার ও দায়িত্বশীল করে তোলে। ‘আমি নই আমরা’ অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বা শুধু নিজের জন্য নয় বরং পুরো সমাজের জন্য চিন্তার চর্চা করে তারা। তাই জাপানিরা অন্যের অলক্ষেও অপরাধ বা অনৈতিক কাজ করে না, যা অপরের বা সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
শিশুকাল থেকে উন্নত মননশীলতা এবং মূল্যবোধের ভিত্তি তৈরি হলে, তা পরবর্তীকালে নিজের ও সমাজজীবনে ভূমিকা রাখে। কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালে মানুষের জীবন সবচেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ, কৌতূহলী ও জয় করার প্রবল ইচ্ছাপূর্ণ থাকে। এ সময় প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষা এবং দিকনির্দেশনার অভাবে জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সঠিক ও ন্যায়ের পথটি হয়ে পড়ে কঠিন, তারা সহজেই অন্যায়, অসদুপায় অবলম্বন করে।
বর্তমানে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও আমাদের দেশে অনেক মানুষ আর্থসামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সমাজজীবনে পরিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নানান বাধার সম্মুখীন হয়ে সুস্থ–স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া গোষ্ঠীগুলোর মানুষ বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধিগ্রস্ত বা চাপের সম্মুখীন হয়, মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকে পরিচালিত হয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে সমাজে নানা সমস্যা বা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে দেশের টেকসই উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষা বা সচেতনতা অথবা সময়ের অভাবে বাবা–মা শিশু-কিশোরদের সঠিক যত্ন বা পরিচর্যা করেন না। তারা দৃঢ় বন্ধনযুক্ত যৌথ পরিবারের বদলে একক ছোট পরিবারে বেড়ে উঠছে, মাঠে-ময়দানে খেলাধুলা, বিভিন্ন উৎসবে অংশগ্রহণ, সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা, সমবয়সীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষের সঙ্গে সম্মিলনের সুযোগের অভাবে একাকী অসংগতিপূর্ণ জগতে বেড়ে উঠছে। শিশু-কিশোররা মুঠোফোন বা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে চরমভাবে আসক্ত হয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। মানসম্মত শিক্ষা শিশুর অধিকার; আর এ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো চরিত্র গঠন। তাই শিশু-কিশোরদের জ্ঞানমূলক বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা দেওয়া উচিত।
দেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয়ে উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সমীক্ষায় প্রকাশ পায়, ৩৭ শতাংশ শিক্ষক (৩৯ শতাংশ ইংরেজির, ৩৩ শতাংশ গণিতের ও ২৩ শতাংশ বিজ্ঞানের) বিশেষত সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের জন্য অননুমোদিত গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল। তার ওপর মাধ্যমিকে শিক্ষক–ছাত্র অনুপাত ১: ৪৬, যার আদর্শ অনুপাত শিক্ষানীতি অনুযায়ী ১: ৩০। মাধ্যমিকে ১১ দশমিক ১ শতাংশ শিশু-কিশোর ঝরে পড়ে। এ সবই মানুষের ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন ও নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি সুদৃঢ় হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়স্বরূপ।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ (৩ দশমিক ৬ কোটি) কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল কিশোর-কিশোরী, যাদের দক্ষতা ও নৈতিক মূল্যবোধ উন্নয়নের মাধ্যমে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড/লভ্যাংশের সুদূরপ্রসারী সুফল অর্জন সম্ভব। সরকার শিশুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, বিনা মূল্যে বই দেওয়া ও পড়াশোনার সুযোগসহ শিক্ষাবৃত্তি, অপুষ্টি রোধে সয়াপ্রোটিনযুক্ত খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে। এ ছাড়া সরকার প্রতিষ্ঠিত শীর্ষ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পিকেএসএফ দেশের বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি ছাড়াও সামাজিক পুঁজিনির্ভর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সামাজিক সমন্বয়ের লক্ষ্যে মূলত কিশোর-কিশোরী ক্লাব গঠনের মাধ্যমে অ-আর্থিক সেবা, যেমন পাঠাগার স্থাপন, পাঠচক্র ও পাঠ প্রস্তুত, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, যৌন হয়রানি, মাদকাসক্তি রোধে র্যালি, মানববন্ধন, অভিভাবকদের অংশগ্রহণে উঠান বৈঠকসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য।
সামাজিক পুঁজি বা পারস্পরিক যোগাযোগ, সহযোগিতা ও মিথস্ক্রিয়ার সুফল হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে কিশোরদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এসব কর্মসূচি আমাদের দেশে অপ্রতুল হলেও এর কারণে নবজন্ম হয় অনেকের, বাল্যবিবাহের পিঁড়িতে ভর দিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কাকে রোধ করে কেউ–বা সুযোগ পেয়ে যান শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার, মাদকাসক্তি থেকে ফিরে আসেন কেউ, অনেক পাড়া-মহল্লা হয় ইভটিজিং–মুক্ত। ব্যাপক আকারে কমিউনিটি–ভিত্তিক কিশোর ক্লাব গঠন করে দলগতভাবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পাদনের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা, সাহস বৃদ্ধি, উৎসাহ-আনন্দে মিলেমিশে ভালো কিছু করার আগ্রহ, নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, সহমর্মিতা, সৃজনশীলতা, সামাজিক রীতিনীতি ও দায়িত্ববোধ বাড়ানোর মাধ্যমে সুসভ্য ও প্রাগ্রসর জাতি গঠন সম্ভব।
নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়তে এসব কর্মসূচিতে শিশু-কিশোরদের ফলপ্রসূ অংশগ্রহণের জন্য স্থানীয় সরকার, অভিভাবক, জনসাধারণ, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য ব্যক্তির সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতাসহ প্রত্যেকের দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। দারিদ্র্য এবং সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগগুলোয় ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক সমৃদ্ধি প্রত্যাশা করা যায়।
ড. সৈয়দা খালেদা টিম লিডার কৈশোর কর্মসূচি, পিকেএসএফ