ইউক্রেনে একজন কৌতুক অভিনেতা প্রেসিডেন্ট হওয়ায় অনেকে বিস্মিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানে ইমরান খান এবং ফিলিপাইনে রদ্রিগো দুতার্তে ভোটে জিতেও একই রকম বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিলেন একদা। এগুলো ছিল প্রচলিত রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে লাল সতর্কতার মতো। জেলেনস্কি, ইমরান বা দুতার্তের সঙ্গে তুলনা করলে নেপালের বালেন (বালেন্দ্র) শাহা চরিত্র হিসেবে হয়তো অনেক ছোট, কিন্তু তিনি রাজনৈতিক যে আলোড়ন তুলেছেন, সেটা একরকম সামাজিক ভূমিকম্পের মতোই।
দক্ষিণ এশিয়ায় নেপালের একটা গৌরবের দিক হলো দেশটিতে শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা আছে। সবকিছুর জন্য রাজধানীতে ছুটতে হয় না তাদের। গত শুক্রবার সেখানকার ওই স্থানীয় সরকারের ভোট হলো। রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে পৌঁছানোর জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের বড় এক অর্জন নেপালের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা। এবার ছিল তার দ্বিতীয় ভোট। আগের ভোট হয় ২০১৭ সালে।
নেপালের মানুষ জাতীয় রাজনীতি নিয়ে হতাশ হলেও স্থানীয় সরকার নিয়ে আশা ছাড়েনি। কারণ, এর আছে ক্ষমতা; আছে সম্পদের উৎস। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার পেলেও পূর্ব-অভিজ্ঞতার অভাবে গত পাঁচ বছর তাতে প্রত্যাশামতো কাজ হয়নি। কিন্তু হওয়ার যে সুযোগ আছে, সেটা বুঝেছে নেপালিরা। সে কারণেই এবারও উৎসাহের সঙ্গে এই নির্বাচনে ভোট হয়েছে। প্রার্থীরা রাজনৈতিক পরিচয়েই ভোটে নেমেছিলেন। ফলে এই ভোটকে নেপালের জাতীয় নির্বাচনও বলা যায়। ১ কোটি ৭৭ লাখ ভোটারের কিছু অংশকে কাঠমান্ডু থেকে যাঁর যাঁর জেলায় পৌঁছে দিতে নিজ খরচে যানবাহনেরও ব্যবস্থা করেছে বিভিন্ন জাতীয় দল। এতেও এই ভোটের গুরুত্ব বোঝা যায়।
৭৭ জেলাজুড়ে প্রায় ৩৫ হাজার ২২১ আসনের এই নির্বাচনে কংগ্রেস ও দুটি কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতাসীন জোট তুলনামূলকভাবে এগিয়ে আছে ফলাফলে। বিরোধী ইউএমএলও খুব খারাপ করেনি। যদিও গত নির্বাচনের প্রথম স্থান হারাচ্ছে তারা। ক্ষমতাসীন জোটে কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা। তাঁর সঙ্গে আছে ‘সিপিএন’ নামের দুই কমিউনিস্ট উপদল, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুষ্পকুমার দাহাল ও মাধবকুমার নেপাল। এদের প্রতিপক্ষ ইউএমএলও কমিউনিস্ট আদর্শের দল, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি।
নেপালের স্থানীয় সরকারকাঠামোতে গ্রাম থেকে বড় শহর পর্যন্ত চারটি স্তর। সাংবিধানিকভাবেই সব স্তরে কিছু না কিছু প্রশাসনিক ক্ষমতা আছে। ফলে স্থানীয় মানুষ স্থানীয় সরকার নিয়ে আগ্রহী। সব মিলে এ রকম ৭৬৩টি জায়গার ভোট হলো এবার। কিন্তু প্রচার শুরুর পর থেকে সবার মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল কাঠমান্ডু মিউনিসিপ্যালটির ভোট। সেখানে সাধারণ নেপালিদের পছন্দের ‘প্রতীক’ হয়ে উঠেছিলেন একজন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী। সেই প্রার্থীই হলেন বালেন শাহা। নেপালে গান-বাজনার জগতে যিনি ‘বালেন’ নামেই পরিচিত।
বালেন মূলত ‘র্যাপার’। যাঁরা কেবল গান নয়, গানের সঙ্গে ছন্দে ছন্দে গল্পও শোনান। কাঠমান্ডু নেপালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিউনিসিপ্যালটি। এর ভোটের দিকে পুরো দেশের বাড়তি নজর থাকে বরাবরই। এবার র্যাপার বালেনের প্রার্থিতার কারণে সেটা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
নেপালে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের একটা ভালো অর্জন সেখানে নিয়মিত ভোট হচ্ছে। তবে এই ভোট দেশটিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিতে পারেনি। ব্যর্থতাটুকু দেশটিকে ভোগাচ্ছে এবং তার দায় সেখানকার রাজনীতিবিদদের। দেশটির অর্থনীতিও ভালো নেই। বেকারের সংখ্যা বিস্তর। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি এখন। অনেকে বলছে, এসব ‘শ্রীলঙ্কা সিনড্রোম’।
বর্তমান এবং আসন্ন সংকটের জন্য মানুষ রাজনীতিবিদদের দায়ী করছেন। এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নেপালিদের সেই হতাশারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বালেনের প্রচারে। এটা স্পষ্ট এক প্রতীকী ঘটনা ছিল। মানুষ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে উৎসাহের সঙ্গে অংশ নিয়েও জাতীয় রাজনীতিবিদদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশের একটা রাস্তা খুঁজছিল। সেই সুযোগ করে দেন বালেন। ৭০টির বেশি দল এবারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে নেপালে। অথচ দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটিতে মানুষ বেছে নিল ৩২ বছর বয়সী স্বতন্ত্র এক প্রার্থীকে। যিনি মূলত গান গান। সেটাও ঐতিহ্যবাহী সংগীতের কোনো ধারা নয়।
বালেন প্রকৌশলবিদ। কিন্তু ক্রমে ঝুঁকে পড়েন গান ও রাজনীতিতে। র্যাপ গানে জনপ্রিয় হওয়ার মুখেই জানিয়ে রেখেছিলেন রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছার কথা। স্থানীয় নির্বাচন শুরুর অনেক আগে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন কাঠমান্ডুতে মেয়র পদে দাঁড়াবেন। তাঁর কারণে নির্বাচনের সময় নেপালের সোশ্যাল মিডিয়ার প্রায় পুরো পরিসর দখল করে নেয় কাঠমান্ডুর রাজনৈতিক খবর। এ লেখার সময় প্রতিপক্ষের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভোটে বালেন এগিয়ে ছিলেন। এই ধারা বজায় না থাকলেও বালেন ইতিমধ্যে নেপালে বড় রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছেন।
কাঠমান্ডুতে ক্ষমতাসীন নেপালি কংগ্রেস এবং সাবেক শাসক দল ইউএমএলের প্রার্থী যথাক্রমে সিরজানা সিং ও কেশব স্থপিতের বিপরীতে বালেনের বিপুল ভোট পাওয়া বিস্ময়ের হলেও নেপালের সমাজে তার উত্তর রয়েছে। সবাই নতুন আইডিয়াসহ নতুন মানুষ দেখতে চাইছে। বিশেষ করে তরুণেরা—পুরোনো নেতৃত্বের চোখে যারা ‘রাজনীতি বোঝে না’!
কোনো সন্দেহ নেই, নেপালের এবারের স্থানীয় নির্বাচনে প্রধান দলগুলোর মধ্যে কংগ্রেস, ইউএমএল, মাওবাদী সিপিএনই এক থেকে তিন নম্বর জায়গায় থাকছে। কিন্তু নেপালজুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখে স্পষ্ট বালেনই নির্বাচনের প্রধান হিরো। তিনি ভোটে ভালো করায় সাধারণ মানুষ দেশজুড়ে বিশেষভাবে তৃপ্ত। এই দৃশ্যটি বিশেষভাবে শনাক্ত হওয়ার মতো তাৎপর্যবহ।
২০১৫ সালে নেপালে নতুন সংবিধান এবং নতুন রাজনৈতিক কাঠামোর সূচনার পর থেকে রাজনীতিবিদেরা সেখানে দেশটিকে আর সামনে এগিয়ে নিতে পারেননি। চীন ও ভারতের প্রভাববলয়ে লেপ্টে থেকে সরকার ভাঙাগড়া ছাড়া মূলধারার রাজনীতিবিদেরা গুরুত্ববহ আর কোনো অবদান রাখতে পারছেন না নেপালে। বালেন নেপালবাসীর সেই হতাশারই প্রকাশ্য এক ইশতেহার। আমরা দেখেছি, শ্রীলঙ্কার সর্বশেষ গণ-আন্দোলনকালে মানুষ প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতাদের বাড়ির সামনেও প্রতিবাদ করেছে ব্যর্থতা ও অকর্মণ্যতার জন্য। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও মানুষের মাঝে এ রকম প্রবণতা আছে। বালেনরা হয়তো এসব প্রবণতারই পরবর্তী পর্বের নায়ক কিংবা প্রতিনায়ক!
কাঠমান্ডুর নির্বাচনকালে বালেন অনন্য যে নজির গড়েছেন, তা হলো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো কটুকথা না বলা। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভোটযুদ্ধ মানেই প্রতিপক্ষের ওপর সত্য-মিথ্যার মিশেলে চড়াও হওয়া। এ রকম পাল্টাপাল্টিতে হারিয়ে যায় সমাজের জন্য জরুরি অ্যাজেন্ডাগুলো। বালেন নির্বাচনকালে কেবল নিজের প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনায় সীমিত থেকেছেন। প্রতিপক্ষদের গুষ্টি উদ্ধার না করে তাঁর পুরো নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ছিল স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও ময়লা পরিষ্কারের মতো কাজগুলোতে কাঠমান্ডুতে তিনি কী করতে চান, সেসব নিয়ে। সব সাক্ষাৎকারে বালেন কেবল তাঁর পরিকল্পনাই শুনিয়েছেন। যে পরিকল্পনাগুলো তিনি তৈরি করেছেন এ রকম খাতগুলোর জানা-বোঝা লোকদের নিয়ে।
রাস্তায় নেমে এমনকি ভোটও চাননি বালেন। দল না থাকায় তাঁর হাতে কোনো দলীয় পতাকাও ছিল না। জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে বুড়োদের সালাম দিয়ে আর তরুণদের সঙ্গে সেলফি তুলেই সময় গেছে বেশি। মাঝে মাঝে বিভিন্নজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে তাঁর পরিকল্পনাগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। এ রকম শ্রোতারাই অধিকাংশ সময় বালেনের ‘পরিকল্পনা’গুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের মতামতসহ ছড়িয়েছে। ভোটাররা হয়তো মনে করেছেন পুরোনোদের অনেক দেখা হলো, এবার এই তরুণকে সুযোগ দেওয়া যাক। অনেক ভোটার বালেনের মধ্যে দেখেছে নেপালের আরেক বিখ্যাত নগরবিদ মেয়র চিরি বাবু মহারাজের ছায়া। ললিতপুরের মেয়র হিসেবে চিরি বাবু নাগরিক কাজের এমন কিছু মডেল দেখিয়েছেন, যা নেপালে সুনাম কুড়িয়েছে। কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা হলো চিরি বাবুও ললিতপুর মিউনিসিপ্যালে প্রতিপক্ষ ইউএমএল দলের প্রার্থীর চেয়ে এগিয়ে আছেন দ্বিগুণের বেশি ভোটে। ললিতপুরে এই মেয়রের একটা দারুণ উদ্যোগ ছিল, সেখানকার ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে পুনরুদ্ধার ও সংস্কার এবং ছয়টি পার্ক তৈরি। যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়নে অনেক বাস নামিয়েছিলেন তিনি ।
নেপাল একসময় দক্ষিণ এশিয়ায় আশাবাদের বড় এক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল সমাজতন্ত্রীদের উত্থানের কারণে। কিন্তু সেই সম্ভাবনাও বেশ ম্লান হয়েছে দেশটির সমাজতন্ত্রীদের উপদলীয় কোন্দল ও দ্বিধাবিভক্তির মধ্য দিয়ে। এবারের নির্বাচনে পুরোনো ‘শ্রেণিশত্রু’ কংগ্রেসের সঙ্গে মাওবাদী বড় উপদলের ঐক্য ছিল বেশ বিস্ময়কর। আবার সাম্যবাদী যেসব উপদল এখনো শ্রেণিসংগ্রামে আছে (যেমন, নেত্র বিক্রম চান্দের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী), তারাও নির্বাচনে খারাপ ফল করেছে। দেশটির শহুরে সুশীল সমাজের মধ্যে আশাজাগানো গণতন্ত্রপন্থী অ্যাকটিভিস্টদের ‘বিবেকশীল সাজা’ দলও এই নির্বাচনে প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। অথচ ২০১৭ সালে এরা প্রায় ৪৫ হাজার ভোট পেয়েছিল। সব ধারার কথিত পরিবর্তনবাদীদের এ রকম ফল এবং তার বিপরীতে বালেনের উত্থান দেখে নেপালে পুষ্পকুমার দাহাল, মাধবকুমার নেপাল, কে পি শর্মা অলি কিংবা দেউবা কি সতর্ক হবেন? কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর রাজনীতিবিদদের কি এটা থেকে কিছু শেখার আছে? পুরোনো ধাঁচের রাজনীতির শেষ অধ্যায় চলে এল কি তবে উপমহাদেশে? বলা মুশকিল। তবে গণতন্ত্রে ব্যালট পেপারই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বার্তাবাহক।
আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।