নেতা নয়, দরকার নীতির বিকল্প

নরেন্দ্র মোদি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
নরেন্দ্র মোদি                     ও                                           মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

ভোটের দিন-তারিখ এখনো ঘোষণা হয়নি। ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় ‘মুড অব দ্য নেশন’। দেশের মেজাজ বুঝতে সমীক্ষা। ২৪ জানুয়ারি, যদি সেদিনই ভোট হতো, আর বুয়া, ভাতিজা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে হাত মেলাত, তবে উত্তর প্রদেশে ৮০টি আসনের মধ্যে বিজেপির শিকেয় জুটত মাত্র ৫টি আসন। বুয়া মানে বিএসপি সুপ্রিমো মায়াবতী। আর ভাতিজা মুলায়ম-পুত্র এসপি-প্রধান অখিলেশ যাদব। এসপি, বিএসপি আর কংগ্রেস মিলে জিতত ৭৫টি আসন। একেবারে উল্টো পুরাণ। যেখানে, পাঁচ বছর আগে এই তিনটি দল মিলে জিতেছিল সাকল্যে ৫টি আসন। আর জোট না হলে, কংগ্রেস একা লড়লে, এসপি-বিএসপি-আজেডি মিলে পেত ৫৮ আসন। বিজেপি ১৮। কংগ্রেস ৪।

সবে শুরু। আমাদের নেতাদের জন্য বাকি আরও অনেক বিনিদ্র রাত। রক্তশূন্য গ্রামীণ অর্থনীতি। অন্ধকার গ্রাম-ভারত। কৃষি, কৃষক এখন অ্যাজেন্ডা। আলোচনার কেন্দ্রে। মধ্যপ্রদেশের মন্দাসৌরে গুলিতে নিহত হওয়ার পরেও নড়তে সময় লেগেছে করপোরেট সংবাদমাধ্যমের। মহারাষ্ট্রে লংমার্চ। নাসিকে শুরু। ছিল ২৫ হাজার। সাত দিন। ২০০ কিলোমিটার পথ। মুম্বাইয়ে এসে ৫০ হাজার। শেষে টনক নড়ে করপোরেট মিডিয়ার। মুখ ফিরিয়ে থাকা মিডিয়া বাধ্য হয় এই যন্ত্রণাবিদ্ধ বেনজির পদযাত্রার খবর-ছবি ছাপতে। তারপর রাজনৈতিক ধাক্কা।

যাঁরা মোদির ওপর আস্থা রেখেছিলেন, তাঁরা এখন রাস্তায়। গোরখপুরে বিজেপির হারে ছিল আবছা আভাস। উপেক্ষিত কৃষকের মনে জমে থাকা ক্রোধের প্রতিফলন শেষে তিন রাজ্যের বিধানসভার ভোটে। হিন্দিবলয়ে শোচনীয় হার। পালাবদলের স্পষ্ট ইঙ্গিত। ভেঙে পড়েছে সযত্নলালিত নির্মাণ ‘অপ্রতিরোধ্য মোদি’র অতিকথন।

দিল্লি, কলকাতা। দুই সরকার। এক নীতি। এক কৌশল। সেদিন ব্রিগেডে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই। বাংলায় গণতন্ত্র খুন করে দেশে কীভাবে গণতন্ত্র রক্ষা সম্ভব? মোদি দিল্লিতে যা করেছেন, উনি রাজ্যে তা করেছেন। মোদি বিদেশে গিয়ে যুদ্ধবিমানের বরাত পাইয়ে দিয়েছেন পছন্দের শিল্পপতিকে। ঘুরপথে সেই টাকা ঢুকেছে বিজেপির তহবিলে। ধান্দার ধনতন্ত্র। বাংলায় সারদা থেকে রোজ ভ্যালি। টেট থেকে ত্রিফলা। কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারি। সারদায় সর্বস্বান্ত ১৮ লাখের বেশি পরিবার। লুটের রাজনীতির কোনো ফারাক নেই।

মোদি পাঁচ বছর আগে থেকে যা করছেন, মমতা তা করে চলেছেন আট বছর ধরে। সেলস কাউন্টার কেবল আলাদা। প্রোডাক্ট এক। গণতন্ত্র, সংবিধান, বিরোধীদের ওপর আক্রমণ, জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা, জনগণের টাকা লুট। দুই সরকারের জন্যই সমান দস্তুর। বাংলায় বিরোধীদের ওপর যে আক্রমণ ও গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তা নজিরবিহীন। ভোট মানে অবাধ লুট। বিপন্ন ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নামে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা। মিছিল, সমাবেশের পর্যন্ত মেলে না অনুমতি। ধর্মঘটের সময় মিছিল করলেও গ্রেপ্তার। কলকাতায় কার্যত ১৪৪ ধারা। যেন অঘোষিত জরুরি অবস্থা।

ফসলের দাম না পেয়ে ঋণের ভারে কৃষকের আত্মহত্যা। ৩৪ বছরে বাংলায় কখনো হয়নি। পরিবর্তন। গত আট বছরে ১৯১ জন কৃষকের আত্মহত্যা। কিষান মাণ্ডির নামে দালাল, ফড়েদের দৌরাত্ম্য। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করছেন। মাঠের ফসল পড়ে থাকছে মাঠে। কৃষক পাচ্ছেন না ফসলের দাম। সর্বত্র ফড়েরাজ। দিন দিন কমছে খেতমজুরের কাজ, মজুরি। পৌষ ফসল কাটার মাস। নবান্নের ঘ্রাণ। মুখ্যমন্ত্রী এখন নবান্নের চৌদ্দতলা নিবাসী। কিন্তু গ্রামবাংলায় আর উৎসাহ জোগায় না নবান্ন। আলুর দাম নেই। ফুলকপি কৃষক বিক্রি করছেন দুই টাকা দরে। বাজারে ১০ টাকা। দাম নেই পাটেরও। ধানের দাম সরকারি ঘোষণায় কুইন্টালপ্রতি ১ হাজার ৭৭০ টাকা। কৃষক ফড়েদের কাছে বিক্রি করছেন  ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায়।

স্বামীনাথন কমিশন মেনে ফসলের দাম ঠিক করার কোনো উদ্যোগ দিল্লির নেই। কলকাতারও নেই। আছে তিরুবনন্তপুরমে। মোদি বলেছেন, কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করেছেন। পাল্লা দিতে মমতা বলেছেন, তিন গুণ করেছেন। তবে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান ঘোষণা কেন?

বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদি। ২০ লাখও দিতে পারেননি। বছরে ২ লাখ চাকরি দেবেন বলেছিলেন মমতা। রাজ্যে নিয়োগ বন্ধ। কাজ মানে তোলাবাজি আর দুর্নীতি। গ্রাম-শহরে কাজ নেই। কাজের খোঁজে মানুষ ভিনরাজ্যে। চা-বাগান থেকে জঙ্গলমহল। অনাহার, অর্ধাহার। জঙ্গলমহলে শবরদের মৃত্যু। একজন কাজ চাইলে বলছেন, পকোরা ভাজার কথা। আরেকজন চপ ভাজার কথা।

মমতা বলেছেন, রাজ্যে বেকারের সংখ্যা নাকি ৪০ শতাংশ কমে গেছে। কোথায় কমেছে? শিল্প কোথায়? বিনিয়োগ কোথায়? বিনিয়োগ রসাতলে। ২০১৭, চতুর্থ শ্রেণির মাত্র ৬ হাজার পদের জন্য আবেদনপত্র জমা পড়েছিল ২৫ লাখ। আবেদনকারীদের অনেকেই স্নাতক, স্নাতকোত্তর। বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ নেই। সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রায় বন্ধ। লোক দেখানো ঘোষণা হয়। চাকরির পরীক্ষা হয়। প্যানেল হয়। কিন্তু নিয়োগ হয় না। প্রাথমিকে ৯ হাজারের বেশি শূন্যপদ। উচ্চ প্রাথমিকে প্রায় ১৪ হাজার। ভোটের মুখে মুখ্যমন্ত্রীর ‘ইন্টার্নশিপের’ তামাশা। মাসে দু-আড়াই হাজার টাকায় প্রাথমিকে, মাধ্যমিকে নিয়োগের ঘোষণা। যেখানে কেরালায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৮ হাজার টাকা। এমনকি রেগার চেয়েও কম।

মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গাপুর, লন্ডন, জার্মানি, ইতালি গেছেন। বিনিয়োগ আসেনি। ২০০৭-১২, রাজ্যে বিনিয়োগের প্রস্তাব ছিল ৫ লাখ ১১ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা। পরের পাঁচ বছর? বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে সাকল্যে ২৩ হাজার ২৮৯ কোটি টাকার। মোদি ফিতে কাটছেন। উনিও কাটছেন।

সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা দিল্লিতে আছে, কলকাতাতেও। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ওপর নজরদারি রাখতে দিল্লিতে ২০০ সদস্যের ওয়াররুম খুলেছেন মোদি। আর মমতা বলেছেন, ‘সরকারবিরোধী সংবাদপত্র পড়বেন না, নিউজ চ্যানেল দেখবেন না। বরং টিভি সিরিয়াল দেখুন।’ ত্রিপুরায় ক্ষমতায় এসেই দেশের কথা সংবাদপত্রে বেআইনি হস্তক্ষেপ করেছে বিজেপি। বাংলায় গণশক্তিসহ সরকারের সমালোচক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বন্ধ করেছেন মমতা। মোদির অপছন্দের কারণে চাকরি গেছে হিন্দুস্তান টাইমস-এর সম্পাদকের, স্টার নিউজ-এর সাংবাদিকের। বেঙ্গালুরুতে
খুন হয়েছেন সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। বাংলায় ভোটে রিগিংয়ের ছবি তোলায় এক দিনে তৃণমূলের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন ২৪ জন সাংবাদিক। সংবাদমাধ্যমের দখল অভিযানে নেমে একাধিক সাংবাদিক, সম্পাদককে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছেন মমতা।

গত কয়েক বছরে দেশে বেড়েছে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। রাজ্যেও একই ছবি। বসিরহাট, আসানসোল, রানীগঞ্জ, ধুলাগোড় থেকে কাঁকিনাড়া। চলছে হিন্দুত্ব নিয়ে উগ্র প্রতিযোগিতা। কে কত বড় হিন্দু, তার প্রমাণে ব্যস্ত মুখ্যমন্ত্রীসহ দলের নেতা, মন্ত্রীরা। বিজেপি রথযাত্রা করলে তৃণমূল বলছে পাল্টা রথযাত্রার কথা। মোদি রামমন্দির চাইলে, মমতা জগন্নাথ মন্দির। বিজেপি রামনবমী করলে, তৃণমূল হনুমান জয়ন্তী। বুক চিরে হনুমান দেখিয়ে দিচ্ছে ভেতরে রামই আছে। বুকের ভেতরে বিজেপিই আছে। কে কত বেশি রামভক্ত, জাহির করার এক বিশ্রী প্রতিযোগিতা। এক পক্ষ রাম সাজলে, আরেক পক্ষ হনুমান। বাড়ছে সংঘের শাখা। ২০১১-তে ছিল সাড়ে তিন শ। এখন বেড়ে ১ হাজার ৪০০। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ইউনিট। জেলা, ব্লক, অঞ্চল মিলিয়ে ১ হাজার ৫০০-এর কাছাকাছি।

কদিন আগেই কলকাতার ব্রিগেডে এসেছেন কুড়ি দলের ২৩ জন নেতা। বিজেপিকে পরাস্ত করার ডাক দিয়েছেন। কিন্তু তারপর? বিকল্প কী? বিকল্পের কোনো কথা তাঁরা বলেননি।

তিন রাজ্যে বিজেপির গোহারা হারে কংগ্রেস বা কেউ যদি মনে করে এটা ‘নরম হিন্দুত্বে’র জয়, তাহলে হবে বড় ভুল। মানুষ ভোট দিয়েছেন কাজ চেয়ে। কৃষকের দুর্দশার প্রতিবাদ প্রতিফলিত হয়েছে ভোটে। শ্রমজীবী মানুষ চেয়েছেন ন্যূনতম মজুরি। সামাজিক সুরক্ষা। ভোটে প্রতিফলিত হয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রোষ। মানুষ চেয়েছেন গণতান্ত্রিক অধিকার। নতুন নেতা না। এই নির্বাচন চায় বিকল্প নীতি। নেতাদের ভিড়ে নয়। নীতি বদলের লড়াইয়েই বিজেপিকে পরাস্ত করা সম্ভব। বিকল্প নেতা-নেত্রী নয়। চাই জনগণের স্বার্থবাহী বিকল্প নীতি।

বিকল্প কী, বলছেন বামপন্থীরা। এই নির্বাচন জনগণের স্বার্থবাহী বিকল্প নীতির লড়াই।

কৃষকের জন্য কেবল এককালীন ঋণ মওকুফ নয়। সঙ্গে ফসলের দেড় গুণ দাম। ভূমিহীনদের জন্য জমি। শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি। দিনে ৬০০, মাসে ১৮ হাজার। কেরালা পারে। কেন বাংলা পারবে না। কেনই-বা দেশ পারবে না। দেশে-রাজ্যে কাজের হাহাকার। সবার জন্য চাই কর্মসংস্থানের নির্দিষ্ট পদক্ষেপ। সব গ্রামে, সব শহরে রেগা। গ্রাম-ভারতে ১০০ দিনের কাজের নিশ্চয়তা প্রকল্প। শুধু গ্রামে নয়। চাই শহরেও। ১০০ দিন না। ২০০ দিন। ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি। কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা। ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ন্যূনতম পেনশন। মাসে ৬ হাজার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য গরিব-মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। সবার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষার নিশ্চয়তা। দায়িত্ব নিক সরকার। কারখানা থেকে ক্যাম্পাস। চাই ইউনিয়নের অধিকার। গণতন্ত্রের অনুশীলন, চর্চা হোক কলেজ থেকে, যারা নেবে ভবিষ্যতে দেশ-রাজ্যের দায়িত্ব। দেশ চায় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। কেন্দ্রে হোক
বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। শুধু ধর্মনিরপেক্ষ নয়। বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ।

এই বিকল্প নীতির লড়াইয়ে কৃষকেরা লংমার্চে। শ্রমিকেরা ধর্মঘটে। শ্রমিক-কৃষকের যৌথ সংগ্রাম এই লড়াইয়ের পর্বে এক নতুন সূচনা। পরিবর্তন এসেছে জন আন্দোলনের গুণগত উপাদানে। নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রবেশ করেছে এক নতুন অধ্যায়ে। কুড়ি কোটির ওপর শ্রমজীবী মানুষ রাস্তায়। বিকল্পের সন্ধানে। মন্দির-মসজিদ নয়। রুটি–রুজির আন্দোলন বদলে দিয়েছে রাজনৈতিক আলোচনার অ্যাজেন্ডা।

শান্তনু দে কলকাতার সাংবাদিক