মতামত

নেতানিয়াহু ভূপাতিত, সটান দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিন

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

ময়দানে যে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে, তাকেই বলা হয় জয়ী। মুষ্টিযুদ্ধের রিংই হোক আর সামরিক সংঘাতই হোক, মার খেয়েও পায়ের নিচের মাটি না হারানোও একধরনের জয়। গাজায় ১১ দিনের ভূমিসাৎ বোমাবৃষ্টির পর হামাস আরও জনপ্রিয়, আরও সক্ষম হিসেবে বেরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে পতন ঘটতে যাচ্ছে ইসরায়েলের একমাত্র ‘প্রহরী’র দাবিদার প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর। পরপর চারটি নির্বাচনে তিনি ও তাঁর দল লিকুদ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে সরকার গঠনের জন্য দরকারিসংখ্যক এমপির সমর্থন পেতে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্ট্যান্ডিং টল’ (গর্বিত ও আত্মবিশ্বাসী আচরণ); সেই ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে ফিলিস্তিনিরা। এই দাঁড়িয়ে থাকার গুরুত্ব পরিমাপ করতে হবে, ইসরায়েল ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো পরাশক্তির বিপক্ষে। কেবল তখনই ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের বীরত্বের ন্যায্য পরিমাপ করা সম্ভব হবে, নচেৎ নয়।

গাজায় হামলার পর ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যেও হতাশা। দেশটির চ্যানেল ১২-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে এক পাইলট স্বীকার করেছেন, ‘আমরা রকেট হামলা ঠেকানো ও ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে ধ্বংসে ব্যর্থ হয়ে তাদের ভবন ধ্বংস করে হতাশা মিটিয়েছি।’

কে কত মারতে পারল, কত ধ্বংসলীলা ঘটাল, তা দিয়ে সব সময় যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় না। তা নির্ধারিত হয় যুদ্ধের পর কে কতটা সবল থাকতে পারল, তা দিয়ে। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরবদের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হলেও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়, ইসরায়েলের অজেয় ভাবমূর্তি নষ্ট করা এবং আরব ঐক্য আনতে পেরেছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত। মিসর, সিরিয়া, ইরাক, মরক্কো, লিবিয়া সেনাবাহিনী সেবার এক কাতারে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সে সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব গোল্ডা মেয়র। তিনি ইসরায়েলের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং দুঃসময়ের কান্ডারি। সেনা ও গোয়েন্দাদের ব্যর্থতায় ইসরায়েল প্রথম দিকে মার খেলেও সামলে ওঠে। ইসরায়েল যদি সেবার আমেরিকান অস্ত্রের বিপুল চালান ও অর্থ না পেত, তাহলে হয়তো অন্য মধ্যপ্রাচ্য দেখা যেত।

আল আকসা মসজিদ চত্তরে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ

১৯৬৮-এর যুদ্ধে দৃঢ় ভূমিকার পরও গোল্ডা মেয়ার প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হন। বিপরীতে মিসর ফিরে পায় অধিকৃত ভূমি। আনোয়ার সাদাতের জনপ্রিয়তা আকাশে ওঠে। ঠিক এবারও গাজাকে ‍ভয়াবহভাবে নিপীড়ন করে, ৬৫টি শিশুসহ আড়াই শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেও মাথা নিচু করে বিদায় নিতে হচ্ছে নেতানিয়াহুকে। পদ হারানোর পর দুর্নীতির বিচারের রায়ে তাঁর জেলে যাওয়ার সম্ভাবনাও ব্যাপক। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইসরায়েলকে কাঠগড়ায় দেখতে আরও বেশি আগ্রহী বলে দেখা যাচ্ছে।

ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল হামাসের প্রতিরোধক্ষমতা ধ্বংস, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভক্তির পাশাপাশি হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লেবাননকে রাজপথে নামানো এবং আসাদ সরকার হটানো। একটিতেও তারা বিজয়ী হয়নি। বরং রাজনৈতিক ফ্রন্টেও তারা পরাজিত হয়েছে। যুদ্ধের আগে ফিলিস্তিনিরা ছিল বহুভাবে বিভক্ত। গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, লেবানন ও জর্ডানের ফিলিস্তিনিরা ছিল হতাশ এবং বিভক্ত।

চারটি আরব দেশ প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ঘোষণা করল। ট্রাম্পের আব্রাহাম অ্যাকর্ডের চালাকিতে পূর্ব জেরুজালেমে ফিরে পাওয়ার স্বপ্নও ধোঁয়ার মতো উবে যাচ্ছিল। মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ আমেরিকান ডলার আর ইসরায়েলি চাপে জাতির বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছিল। আরাফাতের ফাতাহ দল ছিল তিন ভাগে বিভক্ত। কিন্তু পূর্ব জেরুজালেমে আরব বসতি উচ্ছেদ, পবিত্র আল-আকসা মসজিদকে অপবিত্রকরণে ঘুরে দাঁড়ায় ইসরায়েলি আরবেরা। গাজা থেকে তাদের পাশে দাঁড়ায় হামাসের যোদ্ধারা। ইসরায়েলের এক-পঞ্চমাংশ আরব নাগরিক তাদের ফিলিস্তিনি পরিচয় নিয়ে রাস্তায় সংঘর্ষে জড়ায় উগ্র ও দাঙ্গাবাজ ইহুদিবাদী ত্রাসের বিরুদ্ধে। এই চিত্রের বিপরীতে ইসরায়েলপন্থী মাহমুদ আব্বাস আরও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। ফিলিস্তিনের স্থগিত নির্বাচন অচিরেই অনুষ্ঠিত হবে এবং দেখা যাবে, হামাস শুধু গাজায় নয়, আবারও পশ্চিম তীরেও বিজয়ী হবে। ইসরায়েল-আমেরিকার মদদে পশ্চিম তীরের সুবাদারি করা ফাতাহর পক্ষেও আর সম্ভব হবে না।

সামরিক দিক থেকে হামাস পৃথিবীর অন্যতম সেরা ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে শত বছর এগোনো ইসরায়েলি সমরযন্ত্রকে উড়িয়ে দিতে না পারলেও পিছু হটতে বাধ্য করেছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিজয় হলো, তাদের এই প্রতিরোধ অধিকৃত ফিলিস্তিনসহ, ইসরায়েল, লেবানন ও জর্ডানের ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। তারা দেখাতে পেরেছে তারা সন্ত্রাসী নয়, সন্ত্রাসী হলো ইসরায়েল। বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে ইসরায়েলবিরোধী যে বিক্ষোভ দেখা গেছে, তা-ও ছিল অভূতপূর্ব। বয়কট ইসরায়েল আন্দোলন আরও চাঙা হয়েছে। সম্প্রতি ৬০০ শিল্পী ইসরায়েলে অনুষ্ঠান করা বয়কট করেছেন। আয়ারল্যান্ড ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বাতিল করে রাষ্ট্রটিকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়েছে। বাংলাদেশিদের পাসপোর্টে ইসরায়েল সফরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া দেশে-বিদেশে সমালোচিত হচ্ছে। বাইডেনসহ ন্যাটো নেতারা জনমতের চাপে ইসরায়েল-নীতি সংশোধন করতে বসেছেন। ইসরায়েলিরা আরও বেশি ডানপন্থী হলেও আমেরিকান ইহুদিরা বামে সরছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট এমপিদের মধ্যেও ইসরায়েলি দখলদারি বিরোধিতা আগের চাইতে বেশি বলে জানাচ্ছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও পিউ রিসার্চের জরিপ।

এদিকে সিরিয়ায় আসাদ সরকার বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় থেকে সিরিয়ার পুনর্গঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। হিজবুল্লাহ ও ইরান আগের চেয়ে শক্তিশালী। ইরানের নতুন নির্বাচনে জাতীয়তাবাদীরাই ক্ষমতাসীন হবে বলে মনে হচ্ছে। প্রায় একই সময়ে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধের মেয়াদও শেষ হয়েছে (৩১ জুলাই ২০২১)। নতুন প্রেসিডেন্ট পরমাণুকেন্দ্র চালু করলেও ইরানকে নতুনভাবে অবরোধে ফেলা চীন-রাশিয়ার বিরোধিতার জন্য কঠিন হবে। অবরোধ হলেও ওই একই মিত্রদের জন্য তা তত কার্যকর হবে না। ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীরা প্রযুক্তিগতভাবে সৌদিদের মোকাবিলায় সক্ষমতা ইরানের হাতকে আরও শক্তিশালী ও প্রসারিত করে দেখাচ্ছে।

এই সবকিছুর স্নায়ুকেন্দ্র হলো ফিলিস্তিন। ইসরায়েল অ্যাংলো-আমেরিকান-জায়নিস্ট সাম্রাজ্যের প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছিল। এই প্রাণভোমরা মধ্যপ্রাচ্যের মরুতে আর সুরক্ষিত থাকতে পারছে না। বিপরীতে ফিলিস্তিনিরা ছোট্ট গাজা ভূখণ্ড রক্ষা করে হয়ে উঠেছে আরব মুক্তির প্রাণভোমরা। ফিলিস্তিনিরা যদি কোনো দিন মুক্ত হয়, তাহলে আরবের রাজনীতি আবারও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হয়ে উঠবে।

সুতরাং দিনের শেষে দেখা যাচ্ছে, হামাস-হিজবুল্লাহ-হুতি-ইরান-সিরিয়ার জোট আক্রমণ সামলে ‘স্ট্যান্ড টল’ অবস্থানে। বিপরীতে ইসরায়েল ভেতরে-বাইরে পরিবর্তনের চাপের মুখে। নতুন ইসরায়েলি সরকার আরও ডানপন্থী হলেও কী, না হলেও কী। তাদের আচরণ ডান-বাম দিয়ে ঠিক হয় না। কিন্তু ইসরায়েল বিরোধী শিবির আরও সংহত হতে থাকাটাই আসল। ইসরায়েল যদি না-ও বদলায় আমেরিকা বদলাচ্ছে, আরবও বদলাচ্ছে।

এখানে বলা দরকার, সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো আরবের স্বাধীনতার বাধা হলেও কখনোই আরব জনতার হৃদয়ের লাগাম তারা হাতে পায়নি। সেই ক্রুসেডের সময় থেকেই আরবদের প্রতিরোধ তখনই সফল হয়, যখন নাকি তিনটি অ-বেদুইন দেশ মিসর, সিরিয়া ও ইরাক (এখনকার সময়ে ইরান) ঐক্যবদ্ধ হয়। সালাদিন আইয়ুবি মিসর-সিরিয়ার যৌথ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়ে ইরাকিদের সঙ্গে নিয়েই

ক্রুসেডারদের বর্বর দখলদারি থেকে জেরুজালেমসহ আরব ভূমি মুক্ত করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে অনেক ব্যর্থতা সত্ত্বেও মিসর-সিরিয়া-ইরাক ইসরায়েলের অজেয় ভাবমূর্তি নস্যাৎ করে দিতে পেরেছিল। এই কালেও ইসরায়েলকে সংযত করতে মিসরের কোনো বিকল্প নেই। গাজার প্রতিরোধ মিসরের জনপরিসর ও সেনাপরিসরেও অস্থিরতা তৈরি করেছে। এভাবে সিরিয়ার সংহতি, মিসরের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনের মুক্তির জরুরি শর্ত।

তবে গত কয়েক সপ্তাহে ফিলিস্তিনিরা ঐক্যের নজির দেখালেও একটা ঘাটতি তাদের ভোগাবে। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে আরাফাতের মতো কোনো ঐক্যের প্রতীক ও আধার তৈরি করতে হবে। ফিলিস্তিন তথা আরবের সর্বজনীন কোনো জাতীয় ‘মুখ’ নেই; যিনি সবাইকে এক করবেন, যিনি সামরিক পোশাকে নয়, বেসমারিক বেশে উগ্র ও নরমপন্থী উভয়কেই এক কর্মসূচি ধরে রাখবেন।

আগামী দশক ইসরায়েলের জন্য ভালো যাওয়ার কথা নয়। ইরানের সঙ্গে মিসরের সংলাপ, দৃশ্যপটে চীন-রাশিয়ার উপস্থিতি, তুরস্কের বল বৃদ্ধির সঙ্গে ফিলিস্তিনি ঐক্য ও আন্তর্জাতিক সমর্থন যোগ করলে এই সমীকরণই দাঁড়ায়। ইতিহাস কখনো সরীসৃপের মতো বুকে হাঁটে। তখন পরিবর্তনের জন্য শতাব্দী লেগে যায়। কখনো ঝোড়ো হাওয়ায় ইতিহাসের উইন্ডমিল এত দ্রুত ঘোরে যে শতাব্দীর অপেক্ষা এক দশকে শেষ হয়। মহামারি ও আঞ্চলিক সংঘাতের ধাক্কায় পরিবর্তনের পাথর ঢাল বেয়ে গড়াতে শুরু করেছে।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
faruk. wasif@prothomalo. com