অভিযোগটি গুরুতর এবং উদ্বেগজনক। যিনি এই অভিযোগটি করছেন বা আশঙ্কার কথা বলেছেন, তাঁর পদমর্যাদা বিবেচনা করলে কোনোভাবেই একে হেলাফেলার বিষয় মনে করার কারণ নেই। যে জায়গায় এই ধরনের ঘটনার বিষয় বলা হয়েছে, সেখানে এই ধরনের ঘটনা–দুর্ঘটনার আশঙ্কাও যেকোনো বিবেচনায় একজন নাগরিককে উদ্বিগ্ন ও সক্রিয় করে তোলার কথা। কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি। উপরন্তু যা ঘটেছে, তা হচ্ছে উল্টো।
গত রোববার ডাকসু কার্যালয়ে ভিপি নুরুল হক এবং তাঁর সংগঠন ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কর্মীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীরা দুই দফা হামলা চালিয়ে তাঁকে এবং তাঁর সহযোগীদের গুরুতরভাবে আহত করেছেন। এরপর হাসপাতালে তাঁদের দেখতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান নুরুলকে বলেন, ‘তোমাকে এক ঘণ্টা আটকে রাখছে কেন? ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছো মনে হয়। তোমাকে আটকে রেখে একটি লাশ চেয়েছিল বোধ হয়।’
আক্রান্তদের দেখতে গিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুরুলের সঙ্গে তিনি কেবল যে বিতর্কেই জড়িয়ে পড়েছেন তা নয়, তিনি কার্যত আক্রমণকারীদের ভাষায় ‘বহিরাগতদের’ বিষয়েই বেশি উৎসাহী হয়েছেন, যেন আক্রান্তদের দোষারোপ করতেই সেখানে তিনি হাজির হয়েছেন। নুরুলকে কেন ‘এক ঘণ্টা আটকে’ রেখেছে, সেই প্রশ্নের উত্তর তিনি দাবি করেছেন আহত নুরুলের কাছে।
এই প্রশ্ন উপাচার্য তাঁর সঙ্গী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রব্বানীকে করেননি। প্রক্টরের অফিসের ১০০ গজের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে নির্বাচিত ডাকসু ভিপিকে আটকে রাখার সময় তিনি কী করছিলেন, সেই প্রশ্ন উপাচার্য প্রক্টরকে করেননি। আক্রান্ত ছাত্রদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাঁরা ওই সময়ে তিনবার প্রক্টরকে ফোন করেছেন, কিন্তু প্রক্টর আসেননি, উপরন্তু যাঁরা এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের সেখানে যেতে নিষেধ করেছেন। ছাত্রদের এই অভিযোগ মিথ্যা নয়, কেননা উপাচার্যের উপস্থিতিতেই প্রক্টর বলেছেন, ‘তোমাদের নিষেধ করেছি যেতে। তোমরা গেছ কেন?’ নিরুদ্বিগ্ন উপাচার্য মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ষড়যন্ত্র করে দিনেদুপুরে হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটতে গিয়েছিল, আর প্রক্টর ১০০ গজ দূরে বসে পৌনে দুই ঘণ্টা নিষ্ক্রিয় থেকেছেন, সেই হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে যাঁরা এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের সেখানে না যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই তথ্যগুলো আমাদের বিবেচনায় রাখা জরুরি। কেননা, উপাচার্যের ‘মনে হওয়া’ মোটেই ভিত্তিহীন নয়। নুরুল তাঁর ওপর উপর্যুপরি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ করে রোববারের হামলার পরে বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে মেরে ফেলারই পরিকল্পনা করছে’ (প্রথম আলো, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯)।
উপাচার্যের এই ধরনের ‘বোধ হয়’ যে হত্যাকাণ্ড ঘটার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এই বোধোদয় হয় না যে এই জন্য অন্ততপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটা মামলা করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘অভিভাবক’ হিসেবে এই দায়িত্ব তাঁর ওপরে বর্তায়—এ কথা বলা নিরর্থক, কেননা উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গত কয়েক বছরে তাঁদের আচরণ দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁরা এখন আর সেই জায়গায় নেই। তাঁদের কাজ হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের রক্ষা করা। তিনি যে এই আনুষ্ঠানিকতাটি পর্যন্ত করতে চাইলেন না, সেটা নিশ্চয় এ ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি যা–ই বলুন না কেন, এই হামলা নিয়ে তিনি আসলে খুব উদ্বিগ্ন নন।
ঘটনার দুই দিন পরে প্রথম মামলাটির বাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়; পুলিশ। মঙ্গলবার শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রইচ উদ্দীন বাদী হয়ে এ মামলা করেন। পুলিশ বলেছে, ভুক্তভোগীরা এসে মামলা করেন কি না, সে অপেক্ষায় ছিল তারা। কিন্তু কেউ না আসায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। সেই মামলায় সাত-আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছেন (প্রথম আলো, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯)। কিন্তু এই মামলার আসামিরা কথিত ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের’ নেতা-কর্মী, তাঁদের কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় হামলা যাঁরা করেছেন, সেই ছাত্রলীগ কর্মীদের বাদ দিয়েই মামলা করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় পুলিশের এই মামলার উদ্দেশ্য যতটা না অপরাধীদের আটক করা, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাদের রক্ষা করা।
নুরুল হকের পক্ষে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনসহ ৩৭ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৪০-৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
শুধু পুলিশের মামলাই নয়, ঘটনার পরে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা একই সুরে অভিযুক্ত করছেন কথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে। হামলার ঘটনাকে ‘বর্বর ও পৈশাচিক’ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক (যুগান্তর, ২২ ডিসেম্বর ২০১৯); ডাকসুর সাবেক ভিপি তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, এই হামলা ‘অন্যায় ও গ্রহণযোগ্য নয়। একজন ডাকসুর ভিপির গায়ে হাত তোলা, সমস্ত ছাত্রসমাজের জন্য কলঙ্ক’ (প্রথম আলো, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯)। কিন্তু এই নিয়ে ডাকসু ভিপির ওপরে হামলা হয়েছে সাতবার। এর মধ্যে দুইবার হামলা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের’ নামে। বাকি পাঁচবার আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নামেই হামলা চালানো হয়েছে। কেবল যে নুরুলই এই হামলার শিকার হয়েছেন, তা–ও নয়, গত কয়েক বছরে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের, ভিন্নমতের মানুষের ওপর মামলা-হামলা-নির্যাতন স্বাভাবিক বলেই ক্ষমতাসীনেরা প্রচার করেছেন, গর্ব করেই বলেছেন।
আজকে একটি ঘটনার মুখে কথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে দোষারোপ করার মধ্য দিয়ে আর সব হামলাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টাই বরং সুস্পষ্ট। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও উপাচার্য ‘বহিরাগতদের’ নিয়েই ব্যস্ত আছেন। এখন এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ আর ছাত্রলীগ দুটি আলাদা বিষয়। কিন্তু এর প্রতিষ্ঠা থেকে রোববারের হামলা পর্যন্ত যে ছাত্রলীগের কর্মীরাই এর সদস্য, সেটা সবার জানা। এঁরাই যখন অন্য সময়ে অন্যত্র অন্যদের ওপরে হামলা চালিয়েছে, তাতে বাহবা দেওয়ার লোকের অভাব হয়নি। তাঁদের আচরণকে উসকে দেওয়া, সমর্থন করা, বৈধতা দেওয়ার ঘটনার সূচনা আজকে হয়নি; যাঁরা তা করেন তাঁদের পরিচয় কারোরই অচেনা নয়। ১৭ ডিসেম্বর যখন এঁরাই নুরুলের ওপরে হামলা করেছিল, সেই সময়েও নুরুল ডাকসু ভিপিই ছিলেন। কিন্তু সেই হামলাকে কেন ‘ছাত্রসমাজের জন্য কলঙ্ক’ বলার মতো লোক পাওয়া যায়নি, সেটা নিশ্চয় আমরা প্রশ্ন করতে পারি। হামলাকারী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নামই এখন বলা হচ্ছে কিন্তু ছাত্রলীগের নাম বলা হচ্ছে না কেন, সেটাও বোঝা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ধরনের একটা পেটোয়া বাহিনীর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কী করে যুক্ত থাকেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা জরুরি। এই সংগঠনের একাংশের উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি এই বিষয়ে কোনো বক্তব্য রেখেছেন বলে চোখে পড়েনি।
‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নাম ধারণ করে সংঘটিত এই ন্যক্কারজনক অপরাধ যে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চরম অবমাননাকর, এই নিয়ে অবশ্যই দ্বিমত নেই। দুর্ভাগ্যজনক যে মুক্তিযুদ্ধের নামে এই ধরনের আচরণ কেবল এরাই করেনি, আজকেই তার সূচনা হয়নি। রাজনীতির অঙ্গনে এবং ক্ষমতাসীনদের দ্বারা এই ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটেছে ও ঘটছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁদের গোষ্ঠীস্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নকে ব্যবহার করতে কুণ্ঠিত হন না। ২০১৫ সালে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য এবং তাঁর বিরোধীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন করেছেন ও ছাত্রলীগের কর্মীদের ব্যবহার করেছেন, তখন তাঁদের দুই পক্ষের নাম ছিল ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’ এবং ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তার চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’ (আলী রীয়াজ, ‘আকাশ ভেঙে পড়েনি’, প্রথম আলো, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। প্রতিবছর শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ কথাটা যতবার উচ্চারিত হয়, সারা বছর এই নিয়ে স্বাধীন গবেষণায় শিক্ষকেরা তার কত অংশ উৎসাহী? মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বিতর্কিত তালিকা প্রকাশের দায়িত্বহীন আচরণে যতটা উৎসাহী, গবেষণায় তার কিয়দংশও নয় (রোজিনা ইসলাম, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় কাজ ও গবেষণা নেই’, প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১৯)।
ডাকসু ভিপির ওপরে সর্বশেষ হামলার প্রেক্ষাপটও আমাদের বিবেচনায় নেওয়া দরকার। ১৭ ডিসেম্বর থেকে উপর্যুপরি এই সব হামলার সূত্রপাত হয়েছে; তার কারণ হিসেবে নুরুল হক বলেছেন, ‘১৭ ডিসেম্বর তাঁরা ভারতের নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিক পঞ্জির প্রতিবাদে কর্মসূচি পালন করেন। ওই দিনই কিছু ঝামেলা হয়। ১৮ ডিসেম্বরও হামলা হয়। এসবের জের ধরে (রোববারের) হামলা হয়েছে’ (প্রথম আলো, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯)। এই ধরনের ঘটনা এই প্রথম ঘটল, তা নয়, অক্টোবর মাসে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে হত্যা করার পেছনেও ছিল ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অসম চুক্তি বিষয়ে ফেসবুকের পোস্ট। এটা স্পষ্ট যে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সমালোচনা সহ্য করতে অনীহ। বিবিসি জানাচ্ছে যে সর্বশেষ হামলায় অভিযুক্তরা বলেছেন, ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ নিয়ে আন্দোলন করার এখতিয়ার নেই ডাকসু ভিপির। তাঁদের এই অবস্থান যে একেবারেই তাঁদের নিজস্ব পছন্দের ব্যাপার, তা নয়।
রোববারের হামলার ঘটনা বহুমাত্রিক, এর প্রতিক্রিয়া বুঝতে হলে এর বিভিন্ন মাত্রা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর