নীতিমালার চাপে সেবা যেন ব্যাহত না হয়

দেশে যেকোনো নতুন সেবা চালু হওয়ার পরই নীতিমালা হয়, এটাই রীতি। এই প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সেবাদাতাদের দ্বিমত হওয়া প্রায় অনিবার্য। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেয় যা বাস্তবসম্মত নয়। তখন উভয় পক্ষের লড়াই-সংগ্রামের পর শেষমেশ তার একটি রূপ দাঁড়ায়। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল নীতিমালার ক্ষেত্রেও ছয় বছর এ রকম লড়াই-সংগ্রাম চলেছে। এখন রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা নিয়েও প্রায় একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এর কিছু ধারা বিশ্লেষণ করলে অসংগতিগুলো পরিষ্কার হবে। রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা-২০১৭-এর ‘ক’ অনুচ্ছেদের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, একজন মোটরযান মালিক মাত্র একটি মোটরযান রাইড শেয়ারিংয়ে দিতে পারবেন। সেবাদাতারা বলছেন, দেশে যেখানে একাধিক গাড়ি বা যান কেনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ নেই, সেখানে এই নিয়ম করা অযৌক্তিক। এতে গাড়ির সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে না। অথচ রাইড শেয়ারিংয়ের মূল বিষয় হলো ব্যক্তিগত যানবাহনের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এই ধারাসহ নীতিমালার অনেক ধারা নিয়েই সেবাদাতাদের আপত্তি আছে। তাঁরা বলছেন, নীতিমালা বাস্তবায়নের আগে সেবাদাতাদের উদ্বেগ আমলে নেওয়া দরকার।

নীতিমালার ‘খ’ অনুচ্ছেদের ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিআরটিএর ওয়েবসাইট এবং রাইড শেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের অ্যাপসে অভিযোগ দায়ের ও নিষ্পত্তির গতিবিধি অনুসরণের সুবিধাসহ সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিআরটিএ ও রাইড শেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান অনলাইনে প্রাপ্ত অভিযোগ প্রচলিত বিধি মোতাবেক নিষ্পত্তিপূর্বক অভিযোগকারীকে অনলাইনে অবহিত করবে। কোনো ব্যক্তি মিথ্যা অভিযোগ করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সেবাদাতাদের বক্তব্য হলো অভিযোগ জানানোর জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আছে, এ কাজ বিআরটিএর নয়। এ ছাড়া বিআরটিএর ওয়েবসাইট খুবই দুর্বল এবং তাদের প্রয়োজনীয় লোকবলও নেই, তাই তাদের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করা এ মুহূর্তে সম্ভব নয়।

নীতিমালার অনুচ্ছেদ ‘ঘ’-এর ৫ নম্বর ধারায় রাইড শেয়ারিং মোটরযানও আলাদাভাবে তালিকাভুক্তকরণের কথা বলা হয়েছে। যেখানে মোটরযানের সব কাগজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো রাইডারদের কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে, সেখানে আলাদা করে মোটরযান এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেটের কী প্রয়োজন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি হলো বিআরটিএ বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের এমনিতেই লোকবল ও দক্ষতার ঘাটতি থাকে। সেখানে সরকারি সংস্থা নিজে কেন এত দায়িত্ব নিতে চায়, তা বোধগম্য নয়। এ ক্ষেত্রে বরং যানের ফিটনেস পরীক্ষার দায়িত্ব সেবাদাতাদেরই দেওয়া হোক। তারা নিয়মের ব্যত্যয় করলে বিআরটিএ তাদের জবাবদিহি চাইতে পারে।

অনুচ্ছেদ ‘ঘ’-এর ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, মোটরযান তালিকাভুক্তির জন্য অন্যান্য কাগজের সঙ্গে মালিকের টিআইএন সার্টিফিকেটও জমা দিতে হবে। কিন্তু সেবাদাতারা বলছে, বেকার মানুষ ও ছাত্ররা অনেক কষ্টেসৃষ্টে টাকা জমিয়ে মোটরসাইকেল কিনে থাকেন। তাঁদের তো টিআইএন থাকার কথা নয়, আর মোটরসাইকেল কেনার সময়ও টিআইএন প্রয়োজন হয় না। তাই নীতিমালায় এই বিধান থাকলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বাড়বে বলেই ধারণা করা যায়।

অন্যদিকে নিরাপত্তার ব্যাপারে নীতিমালায় এমন কিছু বিধান যুক্ত করা হয়েছে, যা রীতিমতো অবাস্তব। অনুচ্ছেদ ‘খ’-এর ১১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রতিটি যাত্রা পুলিশ কন্ট্রোল রুম প্রয়োজনে সরাসরি অবলোকন করতে পারে—তার ব্যবস্থা রাখতে হবে।’ সেবাদাতারা বলছেন, একসঙ্গে প্রতিটি কোম্পানির হাজার হাজার যাত্রা নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়। এটি পর্যবেক্ষণের জন্য কত বড় পর্দা দরকার, তা আমাদের পক্ষে ধারণা করাও অসম্ভব। প্রযুক্তিবিদেরা বলছেন, এটা কার্যত অসম্ভব। আর তাতে গ্রাহকের ব্যক্তিগত চলাচল সার্বক্ষণিক পুলিশের নজরদারিতে চলে আসবে, যা তাঁর অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।

সেবাদাতারা বলছেন, এটার প্রয়োজন নেই, কারণ পুলিশ চাইলে যেকোনো যাত্রার তথ্য চাইতে পারে। এ দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে কোম্পানি তা দিতে বাধ্য। প্রযুক্তিগতভাবেও এই শর্ত পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে যাত্রার সময় সমস্যা হলে রাইডার বা যাত্রী ৯৯৯ নম্বরে ফোন করতে পারেন।

নীতিমালার অনুচ্ছেদ ‘চ’-এর ১ ও ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, বিআরটিএর ওয়েবসাইটে এই গাইডলাইনের আওতায় কাজের জন্য ওয়েব পোর্টাল স্থাপন ও তার তথ্য বিআরটিএর ডেটাবেইজে সংরক্ষণসহ যাবতীয় কারিগরি সহায়তা রাইড শেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নিজ খরচে দেবে এবং তা বিআরটিএর নিজস্ব সম্পত্তি হবে। আর তার নিরাপত্তাব্যবস্থা বিআরটিএর কাছে হস্তান্তর করতে হবে।

কিন্তু বিষয় হলো, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানোর দায়িত্ব সরকারের। এ ছাড়া একটি কোম্পানির শক্তি হচ্ছে তার তথ্য, তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সেটা কেন দেবে। সেখান থেকে একজনের তথ্য যে আরেকজন হাতিয়ে নেবে না, সেটাই বা কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব। ফলে এসব বিষয় নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার আগে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তার দরকার ছিল।

এ প্রসঙ্গে রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো বলছে, সরকার এই খাতকে আইনি কাঠামোয় নিয়ে আসতে দ্রুত উদ্যোগ নিয়েছে, যদিও অনেক দেশেই আইনি কাঠামো তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। তাই সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও দ্রুত প্রক্রিয়া শুরুর চেষ্টা করেছে। তবে নীতিমালা নিয়ে তাদের কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তারা সেটা পেশ করেছে। তারা বলছে, আইন মেনে তারা দ্রুত লাইসেন্স পেতে চায়।

রাইড শেয়ারিং প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসা। স্বাভাবিকভাবেই দেশ এটি নতুন। তাই নীতিমালা করার সময় অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা আমলে নেওয়া দরকার। মানুষের প্রয়োজনেই এর উদ্ভব, যাতে নীতিমালা তৈরি করা ছাড়া সরকারের বিশেষ ভূমিকা নেই। সরকারের কাজ বেসরকারি খাতকে নীতি সহায়তা দেওয়া। তাই নীতিমালা প্রণয়নে সেবাদাতাদের উদ্বেগ আমলে নেওয়া দরকার। নীতিমালার জটিলতার কারণে সেবা যেন ব্যাহত না হয়, তা স্মরণে রাখতে হবে। এসব দ্রুত নিরসন করে কোম্পানিগুলোকে আইনি কাঠামোয় আনা প্রয়োজন।

প্রতীক বর্ধন : প্রথম আলোর সহসম্পাদক

bardhanprotik@gmail.com