শহরের বিল্ডিংগুলোকে নতুনভাবে রং করা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ কারণে হয়তো শহরটাকে সাময়িক ঝকঝকে দেখাবে, কিন্তু যাঁরা নির্মাণকাজে নিয়োজিত, সুপরিকল্পিত নগরায়ণে তাঁদের পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে সব থেকে আগে। সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির তথ্যমতে, ২০১৪ সালে ২৬০ জনের অধিক শ্রমিক মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার জন্য, যার মধ্যে শুধু ঢাকাতেই এর সংখ্যা ৭২ জনের বেশি এবং বিগত পাঁচ বছরে প্রায় তিন হাজারেরও অধিক শ্রমিকের পেশাগত বিপত্তির কারণে প্রাণহানি ঘটেছে।
এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নির্মাণাধীন প্রকল্পে ছাদ থেকে পড়ে, ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট, আর্থিং, দেয়াল ভেঙে, সিঁড়ি থেকে পড়ে, নামা-ওঠার দড়ি ছিঁড়ে ইত্যাদি কারণে অযাচিতভাবে সাধারণ শ্রমিকসহ প্রকল্পের সান্নিধ্যে থাকা সাধারণ জনগণ প্রতিনিয়ত জীবন ধ্বংসকারী দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, যার মূল্য কেবল ভুক্তভোগীদের পরিবারই অনুধাবন করতে পারে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের পর প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরে প্রায় ৩০১টি ভবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী খোদ রাজধানীতেই ৭২ হাজার বাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ভূমিকম্পের সময় নির্মাণাধীন প্রকল্পের দেয়াল ভেঙে পড়াসহ প্রাণহানির ঘটনাও মোটেই সুখকর বিষয় নয়, যাকে প্রতিরোধ অসম্ভব।
এ কথা প্রমাণিত যে প্রতিবছর স্থাপনা নির্মাণকল্পে আমাদের দেশে ঘটে চলেছে বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা, তথাপি এর নিরসনে তেমন কোনো নিয়মনীতির বাস্তবায়ন চোখে পড়ার মতো নয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বড় শহরের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় জনসাধারণকে অনেকটাই আতঙ্কগ্রস্ত থাকতে হয়। কারণ পাশের নির্মাণাধীন প্রকল্পের ছাদ থেকে যেকোনো সময় মাথার ওপর পড়তে পারে শক্ত ইট, রড, পাথরসহ ভারী কোনো বস্তু, যার আঘাতে যেকোনো সময় প্রাণহানি খুবই সাধারণ। এমনকি দড়ি বেয়ে ঝুলে থাকা সাধারণ লুঙ্গি অথবা শাড়ি পরিহিত নির্মাণকাজে কর্মরত শ্রমিকের পড়ে গিয়ে প্রাণহানির ঘটনা প্রতিনিয়তই খবরে আসে। অথচ এটি হচ্ছে শুধু আমাদের দায়িত্বহীনতা ও অসাবধানতা এবং সঠিক নিয়ম বাস্তবায়নের অভাবে। এ বিষয়ে কার্যকর তদারকির ব্যবস্থা না থাকায় এমন দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হয় সাধারণ অনেককেই, যা অত্যন্ত পরিতাপের।
>মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আজ যাঁরা বিনির্মাণে ব্যস্ত, কাল তার মূল্য হাজারো কোটি, যার সুফল ভোগ করবে সাধারণত সবাই। তাই তাঁদের নিরাপত্তার দিকটা আমাদেরই ভাবতে হবে
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথের তথ্য অনুযায়ী, দেশগুলোতে যখন কোনো স্থাপনা নির্মাণাধীন থাকে, সেখানে শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বেশ কিছু পদক্ষেপ অবশ্যই কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে এবং একে প্রথম প্রধান শর্ত হিসেবে কার্যকর করাকে বাধ্যতামূলক ধরা হয়। যেমন নির্মাণাধীন স্থাপনায় শ্রমিকের পোশাকের ধরন, সার্বক্ষণিকভাবে শ্রমিকের নিকট সাধারণ জীবনরক্ষাকারী কিছু যন্ত্রপাতি, হেলমেট, তাপ প্রতিরোধক জুতা, হাতমোজা, মাস্ক এমনকি নির্মাণাধীন স্থাপনায় অধিক শব্দদূষণ হলে শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনাকে প্রধান শর্ত হিসেবে পালন করতে হয়। এ ছাড়া নির্মাণাধীন স্থাপনা থেকে যেন কোনো ধরনের উপাদান (ইট, রড, কাচ, বালু, সিমেন্টসহ অন্যান্য) বাইরে ছিটকে না পড়ে, সে জন্য বিভিন্ন স্তরের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এ ক্ষেত্রে জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যেকোনো নির্মাণাধীন স্থাপনার বহির্ভাগে শক্ত নেটিং করা হয়, তারপর বিভিন্ন স্তরে স্টিলের লেয়ারিং করা হয় এবং শ্রমিকদের ওঠানামা ও চলাফেরার জন্য অস্থায়ী টেকসই সিঁড়ি, ল্যাডার, লিফট স্থাপন করা হয়। অথচ আমাদের দেশের শহরগুলোতে বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে দড়ি কোমরে পেঁচিয়ে সুউচ্চে নির্মাণকাজ করতে দেখা যায়। এমনকি নির্মাণাধীন স্থাপনায় ধারালো মরিচা ধরা লোহার রড কোনো রাবার ক্যাপ ছাড়াই পড়ে থাকে বছরের পর বছর। তা ছাড়া নিরাপত্তার জন্য কোনো বিশেষ ধরনের পার্শ্ব রেলিংও খুব বেশি দেখা যায় না। যত্রতত্র ধূমপান করা—যা বড় অগ্নিকাণ্ডের কারণ—খুবই সাধারণ ব্যাপার আমাদের দেশে।
আমাদের দেশে নিয়মকানুন থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের নাকের ডগায় নির্মাণপ্রতিষ্ঠানগুলো এসব ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য এসব ব্যবস্থা সঠিক উপায়ে গ্রহণ করছে না। এ ছাড়া বর্তমানে প্রণীত আন্তর্জাতিক পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা নীতিমালায় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা হয়েছে। আমাদের দেশে বর্তমানে বিপুলসংখ্যক নির্মাণপ্রতিষ্ঠান থাকলেও সেগুলোর প্রায় বেশির ভাগেরই নিরাপত্তাবিষয়ক নিজস্ব অভিজ্ঞ পরামর্শক নেই। অথচ এ ধরনের পরামর্শক থাকা প্রয়োজন। যাদের দায়িত্ব নির্মাণশ্রমিকদের নির্মাণ-সংক্রান্ত কাজে পর্যাপ্ত সতর্কতাবিষয়ক পরামর্শ প্রদান এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিরাপত্তাবিষয়ক ট্রেনিং প্রদানের মাধ্যমে অযাচিত দুর্ঘটনা থেকে তাঁদের রক্ষা করা।
নির্মাণকাজে ব্যবহৃত সব যন্ত্রাংশের পর্যায়ক্রমিক পর্যবেক্ষণ বিষয়টিকে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহারের অনুপযোগী নির্মাণ যন্ত্রাংশ ভেঙে গিয়ে কিংবা বিকল হয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা যেকোনো সময় ঘটাতে সক্ষম। অন্ততপক্ষে প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ও প্রাথমিক চিকিৎসাসামগ্রী যথাস্থানে রাখাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে। শ্রমিকদের জানতে হবে তাঁদের অধিকার সম্পর্কে, তাঁদের মালিকদের বুঝতে হবে শ্রমের মূল্য ও দায়িত্ব, আর সরকারকে হতে হবে আইনের দিক থেকে আরও কঠোর শ্রমিকদের স্বার্থে। কারণ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আজ যাঁরা বিনির্মাণে ব্যস্ত, কাল তার মূল্য হাজারো কোটি, যার সুফল ভোগ করবে সাধারণত সবাই। তাই তাঁদের নিরাপত্তার দিকটা আমাদেরই ভাবতে হবে।
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। (বর্তমানে জাপানে গবেষণারত)
sajal_c@yahoo.com