নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই বিশ্বকে অগণতান্ত্রিক করে তুলছেন!

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

পৃথিবীটা আসলেই লড়াইয়ের স্থান। লড়াই করেই টিকতে হয়, সে অস্তিত্বশীল কোনো প্রাণ, বস্তু কিংবা ধারণাই হোক। প্রাণ ও বস্তুর পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ যেহেতু আবার ধারণার হাতে, তাই এর লড়াইটাও বেশ জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ। এই লড়াই এমন যে সেখানে নেই কোনো বিরতির সুযোগ; যুদ্ধে যেমনটা থাকে। ধবধবে সাদা পতাকা তুলে দিলেই তাই এ চিরন্তন লড়াই থামে না। থামতে পারে না। কারণ, ওই সফেদ পতাকার উত্তোলনটিও কোনো না কোনো পক্ষে গিয়েই দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত। আজকের পৃথিবীতে এ ধারণার লড়াইটা বেশ ভালোভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য সংবেদনশীল ব্যক্তিমাত্রই চোরাস্রোতে বয়ে চলা এ লড়াই সব সময় বুঝতে পারে।

বর্তমান শতকের শুরু থেকেই বিশ্বরাজনীতিতে ছড়ি ঘোরানো ধারণা ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। তা–ও অনেক দিন হলো। বলা হচ্ছে, চলতি দশকেই বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক সূচকে বেশ অবনমন হয়েছে। তবে অবশ্য একেবারে তিরোহিত হয়নি। অর্থাৎ বিশ্বের দেশে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গলদ দেখা দিয়েছে। ভুলভাল বিষয়কে গণতন্ত্র বলে সামনে হাজির করা হচ্ছে। বহু দেশের শাসকগোষ্ঠী গণতন্ত্রের নিজস্ব ব্যাখ্যা তৈরি করে জনগণকে বলতে শুরু করেছে, ‘ইহাই প্রকৃত গণতন্ত্র, বাকিটা কল্পনা’। নিদেনপক্ষে যারা তুলনামূলক ভালো, তারা বলছে, ‘গণতন্ত্রের মতো পুরোপুরি দেখতে না হলেও ইহাই স্বাস্থ্যকর’। অর্থাৎ ধারণাটির মূলে একটি আরোপিত পরিবর্তন নিয়ে আসা হচ্ছে। আর এটি আনছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব পাস হয়েছে জনগণের ভোটে, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনবিরোধী ও নানামাত্রিক বিদ্বেষ ছড়িয়েও ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসতে পেরেছেন জনগণের ভোটে, ফিলিপাইনে ‘অনুদার গণতন্ত্র’–এর দাওয়াই দিয়ে জনগণের ভোটেই ক্ষমতা পেয়েছেন দুতার্তে—এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যাবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, ভেনেজুয়েলাসহ এমন বহু দেশ রয়েছে, যেখানে কর্তৃত্ববাদ প্রকাশ্যেই তার বিজয় পতাকা তুলে ধরছে। বলা যেতে পারে ভারতের কথাও, যেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অতীত নিয়েও জনগণের ভোটে ক্ষমতায় বসেছে বিজেপি সরকার।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই যদি এ ধরনের দিকনির্দেশনা দেন, তবে ক্ষতি কোথায়? ভোটাররাই তো এই প্রবণতায় সায় দিয়েছে। কথাটা আংশিক সত্য; পুরোপুরি নয়। কারণ, সব নির্বাচন এক রকম নয়। ফলে অবধারিতভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিমাত্রই জনগণের প্রশ্নহীন সায় নয়। হাঙ্গেরি, রাশিয়া, তুরস্ক, ভেনেজুয়েলাসহ এমন বহু দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে, যেখানে ভোটারের মতামত নিরপেক্ষভাবেই ফলাফল নির্ধারিত থাকে। এই সব দেশের নেতাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ইতিহাস পুরোনো ও সর্বজনবিদিত। এ ছাড়া এমন বহু দেশ পাওয়া যাবে, যেখানে একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার শুরুতেই জবাবদিহির বিভিন্ন ক্ষেত্রকে সংকুচিত করতে শুরু করে। অর্থাৎ ভেতর থেকেই গণতন্ত্রকে খেয়ে ফেলে। ফলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া এবং গণতন্ত্র দুর্বল হওয়া একসঙ্গেই চলতে থাকে।

ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে

ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসির (ভি–ডেম) সূচক বলছে, সারা বিশ্বেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা গণতন্ত্রের আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে। আরও ভালো করে বললে বলতে হয়, উদারনৈতিক গণতন্ত্রই আক্রান্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। উদারনৈতিক গণতন্ত্র কথাটা জুড়তে হচ্ছে, কারণ এ দুয়ের মধ্যকার বন্ধনটি অনেক দিন হলো আলগা হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ভোট। কিন্তু ভোট মানেই আর স্বাধীনতা নয়। কারণ, সব ভোট নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলকভাবে হচ্ছে না। আবার ভোটে কারা প্রার্থী হবেন, তার এখতিয়ারও জনগণের হাতে থাকছে না অনেক ক্ষেত্রে। ফলে জনগণ আদতে ভোটের দিন এমন কিছু বিকল্পের সামনে হাজির হয়, যাদের হয়তো কোনো বিচারেই তারা সমর্থন করে না। ফলে সে ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ভোটও আর গণতন্ত্রের ভিতকে শক্ত করছে না। গণতন্ত্রের গুণগত মান বিবেচনায় নাগরিক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জাতি–বর্ণ ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারসহ আরও নানা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বহু দেশই এখন এই সব সূচকে ক্রমাগত পিছু হটছে।

কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। তুরস্কের সর্বশেষ নির্বাচনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জয়ী হবেন, তা ভোটের অনেক আগে থেকেই জানা ছিল। এটা এমনভাবেই যে জনগণের ভিন্ন অবস্থানও একে পাল্টাতে পারত না। একই অবস্থা ছিল গত এপ্রিলে হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে, যেখানে প্রেসিডেন্ট ভিক্টর অরবানের নির্বাচিত হওয়াটা একটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছিল। ২০১০ সালে ক্ষমতায় বসার পর থেকেই সংবিধান সংশোধন করে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে, বিরোধী পক্ষকে বিভাজিত করে তিনি তাঁর ক্ষমতাকে সুসংহত করেছেন। একই পন্থা অবলম্বন করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা এমনকি আদালতকেও ব্যবহার করেছেন বিরোধী পক্ষের নেতাকে দণ্ডিত করে নির্বাচনের অযোগ্য করে তুলতে।

রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামে

এই ফিরিস্তি শুনে যাঁরা ভাবছেন, এ আর এমন কী; তাঁদের জন্যও আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছে। কারণ, গণতন্ত্রের যেকোনো সূচকে সবচেয়ে অগ্রসর হিসেবে যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে বিবেচনা করা হয়, তাদের অবস্থাও ভালো নয়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ বলছে, ২০১২ সালে ভি–ডেম ও ফ্রিডম হাউসের সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল শীর্ষ পাঁচে, ২০১৮ সালে তা নেমে ৩১তম–তে দাঁড়িয়েছে। এই অবনমনের পেছনেও রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব, নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে সংশয়, গণমাধ্যমের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপের মতো বিষয়গুলো, যা ২০১৬ সালের পর থেকে প্রকট হয়ে উঠছে। ভি–ডেমের প্রকাশিত সর্বশেষ সূচকে শীর্ষে অবস্থানকারী নরওয়ে থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা উত্তর কোরিয়া—সব কটি দেশেই ২০১২ সালের তুলনায় গণতন্ত্রের গুণগত মান কমেছে।

কথা হচ্ছে গণতন্ত্র ধারণাটিই কি তবে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে? বিস্ময়কর হলেও সত্য, এই প্রশ্নের উত্তরও ‘হ্যাঁ’। কথা হচ্ছে—কেন? এত যুদ্ধ, এত ঝঞ্ঝা পার হয়ে ব্যক্তি মানুষকে শক্তিশালী করতে, সামষ্টিক চাওয়াকে ভাষা দিতে যে ধারণা থিতু হলো, তার হঠাৎ এমন অসুখ হলো কেন? উত্তর খুঁজতে গেলে তাকাতে হবে গণতন্ত্রের লেবাসধারী কিন্তু নির্যাসহীন ক্ষমতাকাঠামোর দিকে, যা এখন দেশে দেশে বিস্তৃতি পাচ্ছে। বাইরের শত্রু যখন আক্রমণ করে, তখন তাকে চেনা যায়, তার ধরন–ধারণ বুঝে পাল্টা কৌশল নেওয়া যায়। কিন্তু ভেতরেই যদি রোগ বাসা বাঁধে, তবে তা শনাক্ত করাটা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্র ধারণাটি সম্ভবত সে রোগেই আক্রান্ত। নির্বাচিত (সে যেভাবেই হোক) জনপ্রতিনিধিরাই যখন গণতন্ত্রের মূল ভিতগুলোকে সীমিত করার প্রয়াস পান, যখন নাগরিক স্বাধীনতাকে খর্ব করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন, তখন এই পীড়নের দায় মানুষ ধারণাটির ওপরই চাপিয়ে দেয়। কারণ, পীড়নটিই তার কাছে বড় সত্য। এমন পরিস্থিতিতে অবধারিতভাবেই তারা এমন কোনো শক্তিমানকে কামনা করে বসে, যা তাকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দেয় এবং ক্ষমতাসীনকে আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে উৎসাহিত করে। এটা একটা চক্রের মতো।

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান

গণতন্ত্রের এই সংকট থেকে মুক্তির উপায় তাহলে কী? সে পথটি খুঁজতে হলে গণতন্ত্রকেই নিজের দিকে তাকাতে হবে। পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামোর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এর উত্থান হলেও গণতন্ত্রের মূল কাজ পুঁজির পাহারাদার হওয়া নয়—এই সত্য তাকে বুঝতে হবে। বরং পুঁজির স্বেচ্ছাচারী অভিমুখ থেকে, পণ্যায়ন ও একচেটিয়াপনা থেকে গণকে নিষ্কৃতি দিতেই এর উত্থান হয়েছিল। মুশকিল হচ্ছে, গণতন্ত্র নিজের দিকে তাকাবে কীভাবে? ‘গণ’ মানে তো অগণিত সাধারণ। এই অগণিত সাধারণ ‘রাজনীতি’টাকে যেদিন ‘জননীতি’তে বদলে দিতে পারবে, সেদিনই হয়তো গণতন্ত্র তার ভেতর বাড়িতে হওয়া ষড়যন্ত্রের মুখে আগল দিতে পারবে। এটা যত দিন না হচ্ছে, তত দিন গণতন্ত্র নামসর্বস্ব হয়ে শুধু পুঁজি তথা অভিজাতদের পাহারাদার হিসেবেই বেঁচে–বর্তে থাকবে। দীর্ঘ এ রোগযাত্রায় ওলট–পালট হবে হয়তো, কিন্তু সত্যটা বদলাবে না।

ফজলুল কবির: সাংবাদিক, প্রথম আলো
ই–মেইল: fazlul.kabir@prothomalo.com