>২৫ ডিসেম্বর প্রথম আলোর আয়োজনে ও ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইডি) এবং অ্যাকশনএইড, বাংলাদেশের সহযোগিতায় ‘নির্বাচন ২০১৮: তারুণ্যের ইশতেহার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা নতুন সরকার পেতে যাচ্ছি। সব কটি রাজনৈতিক দল এরই মধ্যে ইশতেহার ঘোষণা করেছে।
এবারের নির্বাচনে ভোটারদের একটি বড় অংশ তরুণ। তরুণদের চিন্তার মধ্যে অনেক নতুনত্ব থাকে। তাদের অনেক স্বপ্ন। এসব বিষয় নিয়ে এখন আলোচনা করবেন সাঈদ আহমেদ
সাঈদ আহমেদ
নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে রাজনৈতিক দলগুলো ইশতেহার দিয়েছে। আগে ইশতেহার হতো জনতুষ্টিমূলক। এবার হয়েছে তরুণতুষ্টিমূলক।
নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে দেওয়া এই তরুণতুষ্টির ইশতেহারগুলোতে বাস্তবায়নের সদিচ্ছা ও কর্মপরিকল্পনার অভাব আছে। ইশতেহারে অনেক বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও তরুণদের বিষয়ে দুটি জোটই কিছু নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এবারের প্রতিশ্রুতির কেন্দ্রে আছে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তারুণ্যেপূর্ণ এই জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা সুবিধা (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) নেওয়ার সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে প্রবেশ করেছি।
এক জরিপে দেখা যায়, ২০৪১ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে গাড়ি চালানোর (ড্রাইভিং) ৮০ শতাংশ চাকরি চলে যাবে। কারণ, তাঁরা চালকবিহীন গাড়ির চিন্তাভাবনা করছে। অটোমেশন-ব্যবস্থার কারণে নির্মাণের ৭৫ শতাংশ কাজ চলে যাবে।
এটা এত দ্রুত পরিবর্তনশীল যে আর ১০-২০ বছর পর কী ধরনের চাকরি বা কর্মবাজার হবে তা বলা কঠিন। ফলে কী ধরনের চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, তা আমরা জানি না। তরুণ প্রজন্মকে সেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে বর্তমানের শিক্ষাব্যবস্থা বদলাতে হবে।
তাদের ভবিষ্যৎমুখী করতে ‘শিখতে শেখার’ ওপর জোর দিতে হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই এবারের নির্বাচনী ইশতেহারের বাস্তবায়ন দরকার।
নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন রাজনৈতিক দলগুলো দায়িত্ব শেষ করে, তখন তরুণদের দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে তরুণদের নজরদারি বাড়াতেই ২০১৩ সাল থেকে আইআইডি ‘তারুণ্যের ইশতেহার’ নামে উদ্যোগ নিয়েছে।
এর অংশ হিসেবে গত সিটি নির্বাচনেও তারুণ্যের ইশতেহারের ওপর প্রাক্-নির্বাচনী প্রার্থী-বিতর্ক থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন-নজরদারির কাজ হয়েছে। আশা করছি আগামী নির্বাচনের পরও ইশতেহার বাস্তবায়নে তারুণ্যের নজরদারি শুরু হবে।
মো. নাজমুল আহসান
এখন জনমিতির সুফল নিয়ে কথা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যে সময়টা জাতীয় জীবনে খুব আসে না। এ সময়টা কাজে লাগাতে পারলে জাতির উন্নয়ন সম্ভব।
দেশে এখন পাঁচ থেকে ছয় কোটি তরুণ। এর তিন ভাগের এক ভাগ কর্মক্ষম। যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর। এই বয়সে তাঁরা সর্বোচ্চ কর্মক্ষম। এ সময়ে তরুণেরা সৃজনশীলতা, উদ্যম ও সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন।
রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতিই দিক না কেন, তরুণদের বিষয়ে নীতি পরিকল্পনার সংস্কার ছাড়া বেকারত্ব দূর করা যাবে না।
সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের কর্মমুখী শিক্ষায় যেতে হবে। প্রতিবছর ১৭ লাখ মানুষ প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগ পায়, হোক সেটা স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি। কিছু ক্ষেত্রে আমাদের অবকাঠামো আছে, কিন্তু সেটাও ব্যবহৃত হয় না।
যুবকেরা এখন চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পাচ্ছেন। তাঁরা কোথাও কথা বলতে চান না। তাঁরা ভাবছেন, কথা বললে নিজের ও পরিবারের সংকট তৈরি হতে পারে। এই পরিবেশ থেকে বের হতে না পারলে সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয়।
মোছা. যারিন তাছনিম স্মরণী
তরুণ উদ্যোক্তারা যেন সহজ শর্তে ঋণ পান, সরকারের সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। দেশে নারীরা অনেক এগিয়ে গেলেও তাঁদের নিরাপত্তার যথেষ্ট সংকট রয়েছে।
নারীরা ইচ্ছে করলেও রাতে কাজ করতে পারেন না। অনেক সৃজনশীল নারী আছেন, কিন্তু নিরাপত্তার জন্য তাঁরা শতভাগ প্রচেষ্টা কাজে লাগাতে পারেন না। নারীদের নিরাপত্তাবিধান যদি সরকার করতে পারে, আরও উন্নয়ন সম্ভব। অনেকে বিদেশে গিয়ে বিপাকে পড়েন, সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে গিয়েও সহায়তা পান না। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
ওয়াহিদুল ইসলাম
বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ কোটির ওপরে। এর অধিকাংশের বসবাস শহরের বাইরে, অর্থাৎ প্রান্তিক অঞ্চলে। আগামী নতুন সরকারের কাছে আমার প্রত্যাশা, নগর উন্নয়নের পাশাপাশি সুষম উন্নয়ন যেন প্রান্তিক অঞ্চলেও হয়, সেটা নিশ্চিত করা।
অঞ্চলভিত্তিক শিল্প–কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেমন বরিশাল অঞ্চল মৎস্যসম্পদের জন্য বিখ্যাত। ফলে ওই অঞ্চলে মৎস্যসম্পদকেন্দ্রিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
তেমনই খুলনা অঞ্চল চিংড়িশিল্প ও সামুদ্রিক সুবিধায় সমৃদ্ধ। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে। এতে অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন হবে, স্থানীয় মানুষ তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন করতে পারবে।
নগরের সঙ্গে প্রান্তিক অঞ্চলের যদি সুষম উন্নয়ন করা যায়, তবে তাদের কর্মসংস্থান হবে।
ফারাহ্ কবির
প্রথমত, সব তরুণ-তরুণী এক নন। পার্থক্যের জন্য বলা হচ্ছে, শহর ও গ্রামভিত্তিক তরুণ-তরুণীদের কথা। এ দুটির বাইরেও প্রান্তিক একটি গোষ্ঠী আছে, সেই মানুষগুলো আসলে কোথায়? আপনাদের এ আলোচনায় কিংবা তাদের নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা হচ্ছে কি না?
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমরা বারবার বলি, শিক্ষাব্যবস্থায় অবক্ষয় ঘটেছে। কিন্তু এই শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেউ খুব বেশি কথা বলে না। দেখা যায়, কিছু মানুষ বা গোষ্ঠী এ নিয়ে কথা বলছে। অনেকে এই শিক্ষাব্যবস্থা মেনে নিয়েছে। কোচিং মেনে নিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার অবক্ষয় রোধে আমরা কতটুকু অবদান রাখছি? এসব বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
তৃতীয় প্রশ্ন, যঁারা মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে কাজের জন্য প্রবাসে যান, তাঁদের সঙ্গে আমরা কয়জন কথা বলি, তাঁদের ব্যাপারে কতটুকু জানি? তাঁদের দাবিগুলো কি এখানে আসছে?
অলিভা রানী শীল
কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলেও আমরা সে অনুযায়ী কাজ করতে পারছি না। কারণ, আমাদের দিনাজপুরে মেয়েদের বাইরে কাজ করা এখনো অনেক বড় ব্যাপার। সামাজিক বাধা, ধর্মীয় কুসংস্কার মেয়েদের পিছিয়ে দিচ্ছে।
মেয়েদের জন্য নিরাপত্তার বিষয়টিও জরুরি। প্রয়োজন হলেও মেয়েরা রাতে বের হতে পারে না। সন্ধ্যা হলেই পরিবার থেকে বাড়িতে আসতে বলা হয়।
এ ছাড়া লিঙ্গবৈষম্য আমাদের সমাজে একটি বড় বিষয়। তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া সন্তান জন্ম নিলে একটু বড় হলেই তাকে সমাজ বা পরিবার থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা পারিবারিকভাবে বড় হতে পারছে না। এতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
মো. নাসির উদ্দিন
বর্তমানে শিল্পায়ন হচ্ছে। তবে সেটা অনেকটা অপরিকল্পিত। ফলে পরিবেশের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ছে। বৈশ্বিক পরিবেশসূচকে গত বছর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮০টি দেশ নিয়ে একটি জরিপ করেছে। সেখানে দেখা গেছে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯।
আমাদের জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, কিন্তু পরিবেশের দিকের থেকে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। যা ভবিষ্যতের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ।
আমাদের পড়াশোনা গবেষণাধর্মী হওয়া উচিত। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গবেষণার সুযোগ নেই। এটা কোনোভাবেই শিক্ষাব্যবস্থা হতে পারে না। পড়াশোনা করা অবস্থায় সবাই চাকরির জন্য ছুটছে। বিসিএসের জন্য দৌড়াচ্ছে।
চাকরি বয়স যদি ৩৫ থেকে ৪০ বছর হতো, তবে পড়াশোনা শেষে গবেষণা করার সুযোগ থাকত, নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা থাকত। এতে করে অন্যদের আরও কর্মসংস্থান করা যেত।
আমরা সেটা পাচ্ছি না। কারণ, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের দৌড়ের মধ্যে আমাদের থাকতে হয়। নতুন সরকারের কাছে আমার প্রত্যাশা, সরকারি চাকরিতে যেন বয়স বাড়ানো হয়।
মো. কামরুজ্জামান কামরুল
গত তিন-চার বছরে বুয়েটে বেশ কিছু ভালো গবেষণা হয়েছে। জুনিয়র শিক্ষকেরা গবেষণার বিষয়ে সহায়তা করেন। গবেষণার জন্য তহবিল থাকা দরকার। কিন্তু শিক্ষার্থীরা নিজেরাই গবেষণা করেন।
বাংলাদেশ থেকে বছরে পিএইচডির সংখ্যা ৫০-৬০ জনের মতো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষক আছেন, যিনি ১০ বছর থেকে প্রভাষক। তাঁর পদ স্থায়ী করার জন্য বুয়েটে পিএইচডি করেছেন। এ জন্য তিনি বিদেশে যাননি।
আমরা এমন গবেষণা চাই না।
দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যে ১৫ বছর পর মনে হয় না সেখানে বাসার কাজকর্ম করার জন্য মানুষ লাগবে। কারণ, এরই মধ্যে রোবট চলে আসছে। সুতরাং, আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা দরকার।
আমরা মেট্রোরেল করছি। এই ট্রেনের গতি হচ্ছে ১১০ কিলোমিটার। কিন্তু মেট্রোরেলের ৪৪টি থামার স্থান। তাই ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে না। যদি ট্রেন ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে না পারে তাহলে আমরা কি সুবিধা পাব?
সাবিলা নূর
আমরা চাই দুর্নীতিমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, জঙ্গিমুক্ত ও মাদকমুক্ত সমাজ। এই সময় নেশা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমি চাই,
আগামী দিনে যে সরকারই আসুক না কেন, মাদক দূর করার জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম যেন চালু করা হয়।
অনেকে বেকারত্বের কথা বলেছেন। আমার মনে হয় বেকারত্ব দূরীকরণের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা জরুরি। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াকে যদি আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি, তবে বেকারত্ব দূর করতে সহায়ক হবে।
আর শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে সাজাতে হবে, যেন কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। এ ছাড়া আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে পর্যটনশিল্পকে উন্নত করতে হবে। যদি আমরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পর্যটনশিল্পকে সামনে আনতে পারি, সে ক্ষেত্রেও বেকারত্ব দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
অরূপ কুমার দাশ
আমরা এমন একসময়ে, যখন যুবসমাজকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারি। সে জন্য পরবর্তী সরকারকে কিছু বিষয় মেনে চলা উচিত। তার মধ্যে যুবাদের জন্য উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যেন তাঁরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বাজার গবেষণা নিয়ে ভাবতে পারেন।
সরকার থেকে যুবকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় বরাদ্দ শেষ হলে কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা দেখা যায় না।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র, সড়ক ও পরিবহন খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বিচক্ষণ ও যোগ্য ব্যক্তিদের যদি নিযুক্ত করা যায়, তবে উন্নয়নে কোনো বাধা থাকে না।
শুধু সরকারি চাকরিতে নয়, উদ্যোক্তা ও বেসরকারি চাকরিতে সুযোগ–সুবিধা বাড়ানো দরকার। এতে চাকরির বাজারে ভারসাম্য আসবে।
শরীফ আশিকুজ্জামান
ছোটবেলা থেকে আমাদের মধ্যে মূল্যবোধের শিক্ষা থাকা জরুরি। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও আমরা তা নেব না। মূল্যবোধের এই শিক্ষার আমাদের মধ্যে অভাব আছে।
আরও একটি বিষয়, সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। এটা বিকেন্দ্রীকরণ করা উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প–কলকারখানা ঢাকার বাইরে হলে ঢাকায় মানুষের চাপ কমে যেত।
দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলোর আরও প্রচার করা উচিত। আরও বেশি পর্যটনকেন্দ্র তৈরি করা উচিত, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও বেকারত্ব নিরসনে সহায়তা করতে পারে।
ময়নামতি, পাহাড়পুর ছাড়াও অন্যান্য প্রত্নতত্ত্ব সৌন্দর্যের বিষয়ে সরকার মনোনিবেশ করতে পারে। এতে পর্যটনের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। আমাদের গ্রামগঞ্জে ভালো শিক্ষক নেই। এক শিক্ষকই বাংলা, ইংরেজি, সমাজ, ধর্ম—সব বিষয়ই পড়াচ্ছেন।
আমি ভারতে গিয়ে দেখেছি, গ্রামাঞ্চলে প্রাইমারি শিক্ষকদের বেতন ৫০ থেকে ৬০ হাজার রুপি। তাহলে ভালো শিক্ষক অবশ্যই সেখানে যাবেন।
জুবেলী খানম
বাংলাদেশকে যদি আমরা উন্নতির চরম শিখরে নিতে চাই, তাহলে কোনো গোষ্ঠী বা কোনো রাজনৈতিক দলের একক প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। প্রত্যেকের জায়গা থেকে দায়িত্বটা পালন করতে হবে।
প্রতিবছর ২৬ লাখ তরুণ বেকারত্বের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। এর মধ্যে সবাই চাকরি পান না। এমন একটা প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে। এটা যদি আমরা উন্নত করতে চাই, তবে কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে অথবা উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে।
এ জন্য গবেষণা দরকার। কিন্তু গবেষণায় আমাদের সমন্বয় নেই। শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। আমাদের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার তেমন ক্ষেত্র নেই। আজকের তরুণ শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন না। তঁাকে প্রস্তুত হতে হবে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য।
আসরাফুন নেসা মৌরী
আমাদের মানসিকতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এখনো অনেক আইন রয়ে গেছে ব্রিটিশ আমলের। তবে কেন এসব আইন সংস্কার হচ্ছে না। আইনের বইগুলো সাধু ভাষায় লেখা, যা অনেকের কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। ফলে ইংরেজির ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।
এতে আমাদের বাংলা ভাষার চর্চা উপেক্ষিত হচ্ছে। যে সরকারই আসুক না কেন, আইনগুলো যেন বোধগম্য করা হয় এবং সংস্কার করা হয়।
দেশের প্রতিটি মানুষ যেন সংবিধান সম্পর্কে সচেতন থাকে, নিজের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবগত থাকে, নতুন সরকারকে সে উদ্যোগ নিতে হবে।
আমরা নারীরা অধিকারটা পাচ্ছি না। হয়তোবা সেটা আমাদের খানিকটা দোষে। ছোটবেলা থেকে বাবা আমাকে বলতেন, কেউ কাউকে অধিকার দেয় না। সেটা আদায় করে নিতে হয়। আমাদের অধিকার আমাদের আদায় করে নিতে হবে। আমি নারী বলে পিছিয়ে যাওয়া যাবে না। আমি মানুষ, সবার আগে এটা হবে আমার বড় পরিচয়।
তাসনিয়া বাহার চৌধুরী
আমরা কোন সম্প্রদায়ের এর ওপর আমাদের পরিচয় ঠিক করা হয়। এটা অনেক সময় সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হয়।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে জেন্ডারভিত্তিক। কৃষিশিক্ষা ছেলেদের জন্য, আর গার্হস্থ্য মেয়েদের জন্য। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি জেন্ডারভিত্তিক না হতো, তাহলে ছেলে বা মেয়ের পৃথক মানসিকতা তৈরি হতো না। তখন সমাজের ছোটখাটো অনেক সমস্যা দূর হতো।
পরবর্তী যেকোনো সরকারই আসুক, তারা যেন হিজড়াদের জন্য আরও বেশি কাজ করে। এই জনগোষ্ঠী যেন শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি সুযোগ পায়। কারণ, এরা অনেকভাবে অবহেলিত।
মাহবুবা সুলতানা
গত ১০ বছরে সত্যিই নারীরা অনেক দূর এগিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে। কিন্তু নারীরা রাতে কোথায় থাকবে, সেটার ভালো ব্যবস্থা নেই। পরবর্তী সংসদে যঁারা আসবেন, তঁাদের বলব কর্মজীবী নারী হোস্টেলের সুবিধা আরও যেন বাড়ানো হয়। আমাদের হাতে গোনা অল্প কিছু হোস্টেল আছে, যেখানে আমরা থাকতে পারি। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। অনেক সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। কিন্তু মৌলিক যে সুযোগ-সুবিধা, সেগুলো আমরা দেখি না।
আমাদের রাস্তাঘাটে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নেই। ঢাকা শহরের সুন্দর একটি জায়গা হাতিরঝিল, কিন্তু পুরো জায়গায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাবলিক টয়লেট নেই। বিষয়টি ছোট হলেও বেশ প্রয়োজনীয়।
আমরা উবারে চড়ার ক্ষমতা রাখি না, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ার ক্ষমতা রাখি না, সব রাস্তায় রিকশাও চলে না। সুতরাং আমাদের পাবলিক বাসই ভরসা। কিন্তু অধিকাংশ পাবলিক বাসেই নারীদের ওঠার সুযোগ থাকে না। অনেক কষ্ট করে উঠতে পারলেও সেখানে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা তৈরি হয়।
পাবলিক পরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার।
অরিন হক
সরকার তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক বিনিয়োগ করছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেমন গবেষণাধর্মী না, তেমনি শিক্ষা গবেষণায় অর্থায়ন খুবই সামান্য। শিক্ষা খাতে বিদেশি তহবিলও কমছে। তবে আইসিটি ক্ষেত্রে বিদেশি তহবিল বাড়ছে। আশা করা যায়, কর্মসংস্থানের জন্য এটি ভালো দিক।
প্রবাসী কর্মীরা যখন দেশে ফেরত আসছেন, তখন সরকারিভাবে তঁাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা ও রেমিট্যান্সের টাকা বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা উচিত। নারী পোশাককর্মী ৮০ শতাংশ। তাঁরা দ্রুত পোশাকশিল্পে যোগ দিচ্ছেন। আবার ঝরেও যাচ্ছেন দ্রুত।
এরপর কোথায় যাচ্ছেন, সেটাও সরকারের পর্যবেক্ষণ দরকার। সরকার সড়ক নিরাপত্তা আইন করেছে। সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমাদের। সে ব্যাপারে সবার নজর রাখতে হবে।
ফারাহ্ কবির
আমাদের যুবাদের কথা বলার ক্ষেত্র কোথায়? তঁারা কীভাবে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলবেন? স্বাধীনতার এত বছর পর আমরা হয়তো সে সুযোগ কিছুটা হলেও সৃষ্টি করতে পেরেছি। আজকের অনুষ্ঠান এরই প্রমাণ। গণমাধ্যম ব্যবহার করে আমরা এ কাজটি করতে পারব।
আমাদের ছোট বিনিয়োগ, ভিন্ন চিন্তা এক জায়গায় নিয়ে আনতে হবে। যুবাদের ক্ষমতায়ন হলে তঁাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরির নিশ্চয়তা থাকতে হবে। সরকার তার ইশতেহারে এ বিষয়গুলো আনবে এবং এর বাস্তবায়ন করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
অনেক বছরের চেষ্টায় প্রবাসীদের জন্য তথ্যকেন্দ্র হয়েছে। সেখানেও সমস্যা আছে। সরকারের ওপর যেন মানুষ আস্থা রাখতে পারে, সেভাবে সরকারকে কাজ করতে হবে।
আপনারা যঁারা শহরে আছেন, তঁারা অনেক বেশি সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছেন। গ্রামের তরুণেরা আপনাদের মতো সুযোগ পাচ্ছেন না।
আশির দশক থেকে আমাদের দেশের মেয়েরা পোশাকশিল্পে কাজ করছেন। অথচ আজও তঁাদের জন্য কোনো আবাসনের ব্যবস্থা নেই। পরবর্তী সরকারকে এসব বিষয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
তরুণদের বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় এসেছে। দেশে এখন তরুণের সংখ্যা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এই তরুণসমাজকে কাজে লাগাতে পারলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জন করবে।
ভবিষ্যতের সরকার যেন তরুণদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়, সেটাই আজকের তরুণদের প্রত্যাশা। আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
আলোচনায় সুপারিশ
যাঁরা অংশ নিলেন
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো