নির্বাচন: সাতকানিয়ায় মায়ের কান্না ও শত খুনের মহড়া

গত সোমবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় নির্বাচন কেন্দ্রের বাইরে তাসিব নামে ১৩ বছরের এক শিশুকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
ছবি : সংগৃহীত

‘ও ভাই, ভাই রে ওঠ’। এটি ছিল গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ে প্রথম আলোর খবরের শিরোনাম। গত সোমবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে মরফলা গ্রামের বোর্ড অফিস কেন্দ্রের বাইরে তাসিব নামে ১৩ বছরের এক শিশুকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তারা গিয়েছিল কেন্দ্র দখল করতে। প্রতিপক্ষ তাদের খবর পেয়ে কেন্দ্র ছেড়ে আগেই চলে গেছে। তাসিব কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে ভোট দেখছিল।

তাসিবের লাশ বাড়িতে নিয়ে এলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তাসিবের বাবা রিকশাচালক। ভাঙাচোরা ঘর। সেখানে ছেলের লাশ নিয়ে আসা হলে মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাসিবের দুই ছোট বোন ইমা ও হিমু মৃত্যু কী, তা এখনো বোঝে না। ভেবেছে, ভাই শুয়ে আছে। এ কারণে তার মাথায় হাত দিয়ে বারবার ডাকছিল, ও ভাই, ভাই রে ওঠ। কিন্তু তারা জানে না, ভাই কোনো দিন আর উঠবে না। নির্বাচন নামের নৃশংসতা তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে। মা-বাবা বিলাপ করছিলেন। কেন তাঁদের শিশুপুত্রকে এভাবে হত্যা করল সন্ত্রাসীরা?

পত্রিকায় প্রতিদিন মৃত্যু ও দুর্ঘটনার খবর দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। তাসিবকে নিয়ে হয়তো কখনো লেখা হতো না। প্রথম আলোর পাঠক তোফাজ্জেল হোসেনই আমাকে লেখাটি লিখতে অনুরোধ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম আলো পত্রিকায় দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় “ও ভাই, ভাই রে ওঠ” শিরোনামে লেখাটি পড়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। তখন মনে হলো আপনার কাছে কিছু কথা লিখি। শিশু তাসিবের সঙ্গে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। সে আমার আত্মীয়ও নয়। তবু তার জন্য মন কাঁদে, প্রাণ কাঁদে। মানুষ কীভাবে এত নিষ্ঠুর হতে পারে, তা বোধগম্য নয়। যে নির্বাচন মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, সে নির্বাচন কার প্রয়োজনে? আমরা তাসিবকে ফিরে পাব না জানি। কিন্তু তাসিবের জন্য কিছু লিখুন।’

কেবল তোফাজ্জেল হোসেন নন, প্রথম আলোর খবর পড়ে আরও অনেক পাঠক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। একজন লিখেছেন: কিসের ভোট? কিসের নির্বাচন? তাকে কেন হত্যা করা হলো? তাসিব তো খেলতে গেছে। তাকে দেখে কি তাদের মনে হয়েছে সে ভোট নিতে গেছে? কেন মারল? আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘আল্লাহ, আমরা কোন যুগে এসে পড়লাম। একজন মায়ের বুক এভাবে যারা খালি করল, তাদের বিচার কি হবে? চোখে পানি চলে এল। এই মায়ের আর্তনাদ কি এই নিষ্ঠুর সমাজের কানে যাবে?’

আমাদের রাষ্ট্র, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কী বলবেন? যারা তাসিবকে খুন করেছে, সরকার কি তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করবে? স্থানীয় থানা-পুলিশ বলেছে, নিহত তাসিবের আত্মীয়রা এখনো মামলা করেননি। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা পুলিশের কোনো দায় নেই? নির্বাচনী সহিংসতা কেবল সাতকানিয়ায় নয়, সারা দেশেই কমবেশি সহিংসতা হয়েছে। মানুষ মারা গেছে। অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছেন। এর জন্য কাকে দায়ী করব আমরা?

১৩ বছরের একটি শিশু, যাকে বাবা রিকশা চালিয়েও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। শিশুমনের কৌতূহল নিয়েই নির্বাচন দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু সন্ত্রাসীরা সামনে অন্য কাউকে না পেয়ে কিরিচ দিয়ে খুন করল তাকে। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, সাত দফা ইউপি নির্বাচনে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। নির্বাচন তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। মানুষ যাকে পছন্দ করবে, তাকে ভোট দেবে। কিন্তু সেই নির্বাচন কেন একের পর এক মানুষের জীবন কেড়ে নেবে।

আমাদের রাষ্ট্র, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কী বলবেন? যারা তাসিবকে খুন করেছে, সরকার কি তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করবে? স্থানীয় থানা-পুলিশ বলেছে, নিহত তাসিবের আত্মীয়রা এখনো মামলা করেননি। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা পুলিশের কোনো দায় নেই? নির্বাচনী সহিংসতা কেবল সাতকানিয়ায় নয়, সারা দেশেই কমবেশি সহিংসতা হয়েছে। মানুষ মারা গেছে। অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছেন। এর জন্য কাকে দায়ী করব আমরা? প্রথমত নির্বাচন কমিশন। তারা সহিংসতা বন্ধ তথা জনগণের নিরাপত্তা বিধান করতে না পারলে নির্বাচন বন্ধ করে দেবে। মানুষ খুনের ক্ষেত্র তৈরি করার কোনো অধিকার তাদের নেই। মানুষের ভোটের অধিকার অনেক আগেই তারা হরণ করেছে।

এখন তো জীবন কেড়ে নিচ্ছে। এই যে দুই ছোট বোন তাদের ভাইয়ের নিথর মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে, ‘ও ভাই, ভাই রে ওঠ, ওঠ না কেন?’ আমার মনে হচ্ছে এই কথাগুলো কেবল ১৩ বছরের ভাইকে বলা নয়, সমগ্র জাতিকে তারা বলছে, ওঠো না কেন? কেন ঘুমিয়ে আছ? কিছুদিন আগে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করলাম। সুবর্ণজয়ন্তীর শপথ কী ছিল আমাদের? উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গড়ার। শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধনে সবাইকে কাছে টানার। নির্বাচনের নামে ১৩ বছরের শিশু খুন করা কি শান্তি ও সমৃদ্ধির নমুনা?

সাতকানিয়ার নির্বাচনের যে ছবি প্রথম আলোসহ সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তাতে মনে হয় দুই পক্ষ লাঠি-বন্দুক নিয়ে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়েছে। নির্বাচনের নামে তারা চর দখলে মত্ত হয়েছে। আর আমাদের অতি দক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হয় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে অথবা অধবা ঘটনা শেষ হওয়ার পর অকুস্থলে এসে লোকদেখানো অভিযান চালাচ্ছে। মামলার নামে অনেক মানুষকে তারা গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেলে বিচার হোক বা না হোক ‘বাণিজ্য’ হবে।

নিহত শিশু তাসিবের ছোট দুই বোনের আকুতি কিংবা মা-বাবার আহাজারি কখনোই আমাদের গণতন্ত্রের রক্ষকদের কানে পৌঁছাবে না। এই শিশু দুটি ভাই ছাড়াই বড় হবে। মা-বাবা আজীবন সন্তান হারানোর বেদনা বহন করবেন। তারা নিয়তিকেই দোষ দেবেন। কেননা, অদৃশ্য নিয়তি যতটা কাছের, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা তার থেকে অনেক দূরে বাস করেন। তাঁদের কাছে তাসিবেরা কেবলই সংখ্যা।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি