নির্বাচন মানে আমরা আর আমাদের মামুদের খেলা

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের একটি ভোটকেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করা হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো


চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের হালহকিকত দেখে প্রশ্ন জাগে, নির্বাচনের আসল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে কার সঙ্গে কার? স্বাভাবিক গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের মধ্যে নির্বাচন হয়। প্রতিযোগিতা হয় বিরোধী দলগুলোর প্রার্থীদের মধ্যেও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র অর্থাৎ নির্দলীয় প্রার্থীরাও ভোটের ভাগে কামড় বসান। কিন্তু গত প্রায় এক দশকে জাতীয় ও স্থানীয় যত নির্বাচন হয়েছে, বিরোধীরা কোথাও পাত্তাই পাননি।

ভোটের প্রতিযোগিতায় চ্যালেঞ্জ জানানো তো দূরের কথা, নির্বাচনী প্রচারণাও ঠিকমতো চালাতে পারেননি তাঁরা। যেখানে বা একটু দাঁড়াতে চেয়েছেন, দলে-বলে গ্রেপ্তার হয়ে মাঠ ফাঁকা করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের চাপে ও তাপে তাঁদের অবস্থা ছিল ‘জয়-পরাজয় পরের ব্যাপার, অংশগ্রহণই আসল কথা’। তাঁরা অংশ নিয়েছেন বা পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে তাঁদের অংশ নিতে হয়েছে। নির্বাচনের উত্তাল সাগরে তাঁদের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ঝাঁপ দিতে হয়েছে। এ ধরনের অসম মাঠে কোনো সুষম প্রতিযোগিতা হতে পারে না, হয়ওনি।

তিন ধাপের স্থানীয় নির্বাচনের ফলও সেই বিষম পরিস্থিতিকে স্পষ্ট করে। প্রথম পর্বে ২৬টি পৌরসভার মধ্যে ১৬টিতে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ এবং ২টিতে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হন। দ্বিতীয় পর্বে ৬০টির মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ৪৬টি এবং বিএনপির প্রার্থীরা ৪টিতে জয়ী হন। স্বতন্ত্র ও অন্য প্রার্থীরা জিতেছেন ৯টিতে। এই স্বতন্ত্র নামধারীদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী নেতা। সুতরাং নির্বাচন ব্যাপারটা এখন আমরা আর আমাদের মামুদের গল্প হয়ে গেছে। বিএনপি এখানে সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় মাত্র। সেই যে গ্রামের একজনকে ধরে বাইরের একজন জিজ্ঞাসা করছে, ‘ভাই আপনাদের গ্রামে ভালো কারা?’ লোকটি বলে, ‘আমরা আর আমাদের মামুরা’। আর খারাপ? ‘সেটাও আমরা আর আমাদের মামুরা।’

২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলও একই ছকের অঙ্কই দেখায়। সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেন পেয়েছেন মাত্র ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট। শুধু মেয়র নয়, বুধবারের নির্বাচনে সাধারণ কাউন্সিলর ৪০ জনের মধ্যে সব কটি জিতে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি একটি ওয়ার্ডও পায়নি। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলোতেও বিএনপির কোনো প্রার্থী জেতেননি। এখানেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে সাতজন জয় পেয়েছেন।

যেখানে যেখানে দুটি পক্ষের মধ্যে সহিংসতা হয়েছে, সেখানেও তা হয়েছে আওয়ামী লীগেরই দুটি অংশের মধ্যে। এ ধরনের সহিংসতায় প্রথম দুই দফায় বিজয়ী কাউন্সিলরসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে—আহত হয়েছেন কয়েক শ জন।

এ কথা বলতেই হবে, সারা দেশের যেখানে যেখানে স্বতন্ত্ররা জয় পেয়েছেন, সেখানে সেখানে তাঁরা ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই লোক। দলীয় মনোনয়ন না পেলেও দলের স্থানীয় অর্ধেকের বা তারও বেশির মদদ তাঁদের পক্ষে ছিল। কোথাও কোথাও কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রভাবশালী হাতের আশ্রয় ছিল। ফলে পুলিশকেও তাঁদের কিছুটা সমঝে চলতে হয়েছে। আবার যেখানে যেখানে দুটি পক্ষের মধ্যে সহিংসতা হয়েছে, সেখানেও তা হয়েছে আওয়ামী লীগেরই দুটি অংশের মধ্যে। এ ধরনের সহিংসতায় প্রথম দুই দফায় বিজয়ী কাউন্সিলরসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে—আহত হয়েছেন কয়েক শ জন। চট্টগ্রামে পুলিশের হিসাবে একজনের মৃত্যু হলেও প্রথম আলোর হিসাবে মৃতের সংখ্যা ৩। এর মধ্যে একটি মৃত্যুর ঘটনায় নির্বাচনের পক্ষ-বিপক্ষের চেহারাটা স্পষ্ট হয়।

চট্টগ্রামের সরাইপাড়ার নিজাম উদ্দিন মুন্না নামে যুবলীগের একজন কর্মী তাঁর আপন বড় ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছেন। পুলিশ বলার চেষ্টা করছে যে পারিবারিক কলহের জের ধরে মুন্না খুন হয়েছেন। কথাটা এক অর্থে সত্য। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থন নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। এই দ্বন্দ্বের জের ধরেই বড় ভাইয়ের হাতে তাঁর হত্যাকাণ্ডটি ঘটে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্য এটি একটি দৃষ্টি খুলে দেওয়ার মতো ঘটনা।

নিহত ও তাঁর খুনি বলে যিনি অভিযুক্ত উভয়ে একই পরিবারের দুই সন্তানই শুধু নন, তাঁরা একই দলের অনুসারী। কিন্তু কাউন্সিলর প্রার্থীকে সমর্থন করা নিয়ে তাঁরা একে অপরের শত্রু হয়ে যান। যার পরিণতিতে এক ভাই প্রাণ হারালেন আর আরেক ভাই হলেন তাঁর খুনি। ঠিক হাবিল ও কাবিলের গল্প।

সম্প্রতি চাঁদপুর থেকে ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামে যতগুলো রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সবই ঘটেছে ভাইয়ে ভাইয়ে, অর্থাৎ একই রাজনৈতিক দলের দুটি অংশের মধ্যে। একচেটিয়া ক্ষমতার পরিবেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অনেকেরই মধ্যে পদ ও পদবির জন্য উচ্চাভিলাষ তৈরি হয়েছে। এই উচ্চাভিলাষ দলীয় শৃঙ্খলার চেয়েও শক্তিশালী বলে মনে হচ্ছে। দিনকে দিন এটা আরও বাড়বারই কথা।

এমন একটি পরিস্থিতিতে আমরা কী করতে পারি? আমরা প্রস্তাব করতে পারি, জনগণের ভোটাধিকারের যা হয় হোক, বিরোধী দলগুলো দেউলিয়া হয়ে গেলে যাক। নির্বাচন কমিশনের কাছে এসবের বিহিত আশা করে লাভ নেই। সরকার যা চায় তা-ই হবে। কিন্তু এই নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক নির্বাচন কমিশনের মুখোশটা ছেড়ে দিয়ে তারা আওয়ামী লীগের ভেতরে যে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হচ্ছে ও হবে, সেসবের দেখাশোনা করুক। আওয়ামী লীগের অনুগত ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে নিরপেক্ষতা রক্ষা করার দায়িত্বটা তারা নিক, তাতে দেশের লাভ না হোক, ভোটাধিকার না ফিরুক, গণতন্ত্র পুনর্জীবিত না হোক, আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতটা কমবে।

আর আওয়ামী লীগের মধ্যে যাঁরা বেশি যোগ্য ও দলের নেতা-কর্মীদের পছন্দের লোক, তাঁরা অন্তত ‘নির্বাচিতের’ খেতাবটা পাবেন। আমেরিকায় যেমন, দলীয় প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার আগে দলের ভেতরে জনপ্রিয়তা যাচাই করে নিতে হয়, অনেকটা সে রকম। তাতে অন্তত ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানিটা কমতে পারে। সেটাই বা কম কী!

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক