মতামত

নির্বাচন কীভাবে হবে সেটিই এখন ‘রহস্য’

এই সংসদ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। নির্বাচন হতে হবে এই সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে যেকোনো সময়ে। সরল হিসাবে, ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। তার মানে নির্বাচনের আরও অন্তত ১৭ মাস সময় আছে। কোনো কারণে আগাম নির্বাচন হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। অঙ্কের হিসাবে কোনো বিভ্রান্তি থাকে না। এখানেও নেই। বিভ্রান্তি অন্যখানে, নির্বাচনটি কেমন বা কীভাবে হবে, তা কেউ জানে না। ২০১৪ সালের নির্বাচন আগের কোনো নির্বাচনের মতো হয়নি, ২০১৮ সালের নির্বাচনটিও আগের কোনো নির্বাচনের মতো হয়নি। দুটি নির্বাচনই ছিল ইউনিক বা অনন্য। এবারের নির্বাচনটি যে আগের দুটির কোনোটির মতোই হবে না, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মোটামুটি একমত। কীভাবে ও কেমন হবে আগামী নির্বাচন, এটা জনগণের সামনে এক বড় রহস্য।

প্রতিটি নির্বাচনে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল গ্রহণের কৃতিত্ব যেমন আওয়ামী লীগকে দিতে হয়, তেমনি নির্বাচনের আগপর্যন্ত সেই কৌশল পুরোপুরি গোপন রাখার কৃতিত্বও দলটিকে দিতে হয়। তবে দল ও দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি দিনে দিনে যে মাত্রায় কেন্দ্রীভূত ও এককেন্দ্রিক হয়েছে, তাতে দলের কৌশল গোপন রাখার কাজটি খুব সহজ হয়ে গেছে। দলের লোকজনও তেমন কিছু জানেন বলে মনে হয় না।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পরদিন সহকর্মী সোহরাব হাসানের সঙ্গে বের হয়েছি কী যেন কাজে। তিনি টিভিতে টক শোতে যান, পরিচিত মুখ। তাঁকে দেখে ষাটোর্ধ্ব এক লোক এগিয়ে এলেন। সেই নির্বাচন তখনো ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়নি কিন্তু নির্বাচনটি কেমন হয়েছে, তা নিয়ে সবার মধ্যে নিজেদের মতো একটি ধারণা হয়ে গেছে। ওই ব্যক্তি ব্যাংকে চাকরি করতেন, এখন অবসরজীবন যাপন করছেন। নির্বাচন নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বললেন। বোঝা গেল, এই নির্বাচন তাঁকে চরম হতাশ করেছে। বিদায় নেওয়ার সময় বললেন, ‘আল্লাহ যেন আমাকে আরও পাঁচটি বছর বাঁচিয়ে রাখেন। ’১৪ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগ একভাবে করেছে, এবারের (২০১৮ সালের) নির্বাচন হলো আরেকভাবে, পরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কী কৌশল নেয়, তা নিয়ে আমার মধ্যে চরম কৌতূহল তৈরি হয়েছে। আল্লাহ যেন আমাকে তা দেখার সুযোগ দেন।’

সেই ভদ্রলোক কোথায় বা কীভাবে আছেন, জানি না। কিন্তু সামনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল কী হবে, তা দেখার জন্য শুধু তিনি নন, সম্ভবত পুরো জাতি এখন ‘চরম কৌতূহল’ নিয়ে অপেক্ষা করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কেউ ভাবছেন বা তা নিয়ে কারও তেমন কৌতূহল আছে বলে এখনো খুব টের পাচ্ছি না।

প্রতিটি নির্বাচনে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল গ্রহণের কৃতিত্ব যেমন আওয়ামী লীগকে দিতে হয়, তেমনি নির্বাচনের আগপর্যন্ত সেই কৌশল পুরোপুরি গোপন রাখার কৃতিত্বও দলটিকে দিতে হয়। তবে দল ও দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি দিনে দিনে যে মাত্রায় কেন্দ্রীভূত ও এককেন্দ্রিক হয়েছে, তাতে দলের কৌশল গোপন রাখার কাজটি খুব সহজ হয়ে গেছে। দলের লোকজনও তেমন কিছু জানেন বলে মনে হয় না।

এই যে ‘কেউ কিছু জানে না পরিস্থিতি’, তা বিএনপিকে ফেলেছে মহাবিপদে। আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে এমনিতেই দলটি বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত। আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা কী, তা আঁচ বা অনুমান করা গেলে হয়তো সে অনুযায়ী কৌশল ঠিক করা বিএনপির জন্য সহজ হতো। ঘটনা ঘটে গেলে বিশ্লেষণ করা সহজ। অনেক বিশ্লেষকের মূল্যায়ন হচ্ছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যেমন ভুল করেছে বিএনপি, তেমনি ভুল করেছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে। এর মানে গত দুটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপির দুটি সিদ্ধান্তই ভুল ছিল। নির্বাচন বর্জন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ—দুটো পথ ধরেই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এবার তাহলে কী করবে বিএনপি?

সম্ভবত গত দুই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি এখন বলতে শুরু করেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন তারা কোনো নির্বাচন করবে না। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা করতেও রাজি নয় বলে বক্তব্য দিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ‘আমি মনে করি, কোনো কথাই হবে না, যতক্ষণ না আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করে। পরবর্তী নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের কথা পরিষ্কার, আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ না করলে, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে, নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। নির্বাচনে তো আমরা যাবই না, শেখ হাসিনা যদি ক্ষমতায় থাকেন।’

মির্জা ফখরুলের এ বক্তব্যে কি বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার হলো? নাকি আরও প্রশ্ন তৈরি হলো? বিএনপি দাবি করলেই কি আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করবে? নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেবে? নাকি আওয়ামী লীগকে এই কাজে বাধ্য করা হবে? সেটা কীভাবে? আর ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ’ সরকারের ধারণাটাই–বা কী?

এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিএনপি আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। ‘নিরপেক্ষ সরকারের’ অধীনের নির্বাচনের পর ‘জাতীয় সরকার’ গঠন নিয়েও দলটি চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, ভবিষ্যতে নির্বাচনের পর সব দলকে (জয়ী ও পরাজিত) নিয়ে একটি সরকার গঠন করা হবে, এমন একটি ধারণা সামনে রেখে বিভিন্ন দল ও জোটকে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত করতে চাইছে। সম্ভবত সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তারা ‘নিরপেক্ষ সরকারের অধীন’ নির্বাচন নিশ্চিত করতে চায়। তার মানে নির্বাচন কীভাবে হতে যাচ্ছে, তা বোঝার জন্য বিএনপির আন্দোলনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করতে হবে। িকন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপির আন্দোলন যদি আওয়ামী লীগ ব্যর্থ করে দিতে পারে, তাহলে কী হবে? বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে ঈদের একটা সম্পর্কের কথা অনেকেই বলেন। রোজার ঈদ শেষ হয়েছে, সামনে কোরবানির ঈদ। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো পথ নেই।

আওয়ামী লীগ–বিএনপির বাইরে যে দলগুলো ক্ষমতার স্বপ্ন দেখে, নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দাম বাড়ে। তারা সরব হয়। এবারও হয়েছে। তারা সাধারণত আওয়ামী লীগ বা বিএনপি—কোনো না কোনো দলের ওপর ভর করে। আবার কোনো কোনো দল ও এর নেতাদের হাবভাবে মনে হচ্ছে, কেউ তাঁদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন, তাঁরা সেই আশায় আছেন। ভেতরে-ভেতরে এই দলগুলোর তৎপরতা ও দেনদরবার চলবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিও তাদের কাজে লাগাতে চাইবে। জোট গঠন বা দল ভাঙার চেষ্টাও চলবে। নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কোন কায়দায় অনুষ্ঠিত হবে, এসব তৎপরতার ফলাফলের ওপরও তা নির্ভর করবে।

আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ আমাদের জানা। কিন্তু নির্বাচনটি কীভাবে হবে, তা অজানা। আমরা কি জানি এই নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হবে কি না? অথবা এই নির্বাচন ঠিক কোন ক্ষণে হবে? দিনে, রাতে নাকি অন্য কোনো সময়ে? এই নির্বাচন কি সবার সাধারণ চাওয়া অনুযায়ী ‘অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য’ হবে? আমরা জনগণ তো জানিই না, সম্ভবত কেউই জানে না। এমনকি আওয়ামী লীগের যে কৌশল দেখার জন্য অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বাঁচতে চেয়েছেন, সেই আওয়ামী লীগই কি তার কৌশল সম্পর্কে নিশ্চিত?

আগামী ১৭ মাসের মধ্যে যে নির্বাচন হতেই হবে, তা নিয়ে কেউ কিছু জানে না, এ বড় বিস্ময়ের।

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

akmzakaria@gmail.com