মতামত

নির্বাচন কমিশন: স্বস্তি, শঙ্কা ও বিনোদন

‘নির্বাচন কমিশন’ এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে যা হচ্ছে, তাতে কেউ আতঙ্কিত, কেউ পাচ্ছেন বিনোদন। যাঁরা আগের কমিশনগুলোর সমালোচক ছিলেন, তাঁদের মনে শঙ্কা, আবার না ওই রকম একটি সিন্ডিকেট সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো ঘাড়ে চেপে বসে। সদ্য সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাঁর বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘কমিশন তার কাজে সফল হয়েছে’। এই উক্তিতে যাঁদের ঘোরতর আপত্তি, তাঁরা বলতেই পারেন, ‘লজ্জা, ঘৃণা, ভয়—তিন থাকতে নয়।’

অনেকেই অনুসন্ধান কমিটি তৈরি থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং কমিশনের অধীন ‘সফল’ নির্বাচনের বিষয়টিকে তামাশা মনে করেন। বাঙালি তামাশা পছন্দ করে। এতে নিখাদ বিনোদন থাকে একটা স্থূল উদাহরণ দেওয়া যাক। শিশুরা পশুপাখি দেখতে চিড়িয়াখানায় যায়। যে পশুগুলোর বাজারমূল্য বেশি কিংবা যে প্রজাতিগুলো বিলীয়মান—যেমন বাঘ, ভালুক, জেব্রা, জিরাফ ইত্যাদি দেখতে শিশুরা যত না ভিড় করে, তার চেয়ে বেশি ভিড় করে বাঁদরের খাঁচার সামনে। কারণ একটাই; বাঁদর তার বাঁদরামি দিয়ে শিশুদের বিনোদন দেয়। আমরা সাহসী শিশুর তারিফ করে বলি বাঘের বাচ্চা কিংবা সিংহশাবক। আর যারা একটু দুষ্টু, চঞ্চলমতি তাদের বলি শাখামৃগ।

আমাদের আকাঙ্ক্ষা হলো আকাশছোঁয়া। আমরা নির্বাচন কমিশনে বাঘ-সিংহ দেখতে চাই। চাই তাঁরা সাহসের সঙ্গে দাপিয়ে বেড়াবেন। কিন্তু চাইলেই তো সব পাওয়া যায় না! নির্বাচন কমিশন নিয়ে একটা বড় অভিযোগ হলো কমিশনের সদস্যরা সরকারের অনুগ্রহভাজন। তাঁরা সরকারের ইচ্ছার বাইরে পা রাখতে চান না বা সাহস পান না। তাঁরা খুবই প্রভুভক্ত।

এবার বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে তৈরি হলো অনুসন্ধান কমিটি। কমিটির সদস্যরা তো এ দেশেরই সন্তান। তাঁরা কি মানুষ চেনেন না? তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোকে নামের প্রস্তাব পাঠাতে বললেন। দল তো দলীয় বিবেচনার বাইরে কারও নাম দেবে না। পেশাজীবী সংগঠন আর ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তিদের কাছেও তাঁরা নামের ব্যাপারে প্রস্তাব চেয়েছেন। তাঁদের অনেকেই ‘নিরপেক্ষ’, অনেকেই ‘দলকানা’। তাঁরা তিন শতাধিক নাম প্রস্তাব করেছেন। তালিকা দেখে ঢি ঢি পড়ে গেছে। দেশে এত ‘সোনার মানুষ’!

অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে সংলাপে কেউ কেউ বলেছেন, কাদের নাম কোন দল প্রস্তাব করেছে, তা জানানো হোক। এতে প্রক্রিয়াটি আরও স্বচ্ছ হবে। এর একটা ভালো দিক হলো নাগরিকেরা জানতে পারবেন কে কোন দলের পছন্দের ব্যক্তি এবং একই সঙ্গে অনুমান করতে পারবেন কোন বিবেচনায় তাঁরা ওই দলের কাছে গ্রহণযোগ্য।

আমরা সবাই মুখে বলি, নির্বাচন কমিশন হতে হবে দলনিরপেক্ষ। তাহলে কমিশনের সদস্যরা দলীয় চাহিদা ও বিবেচনার বাইরে গিয়ে কর্তব্য পালন করতে পারবেন। অনেকেই মনে করেন, এ দেশে কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি নেই। আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। দেশে দলবাজের চেয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তি বেশি বলেই আমার মনে হয়। আমরা তাঁদের খোঁজার চেষ্টা করি না। কারণ, তাঁদের দায়িত্ব দিলে নির্বাচন নিয়ে কারসাজি করার সুযোগ থাকে না।

কোন দল কাদের নাম প্রস্তাব করেছে, এটা হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যাবে না। তবে চূড়ান্তভাবে যাঁরা মনোনীত হবেন, তাঁরা তো অন্য গ্রহের মানুষ নন। তাঁদের ব্যাকগ্রাউন্ড, অতীত কর্মকাণ্ড ও আচরণ একেবারেই অজ্ঞাত থেকে যাবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

কোন দল কাদের নাম প্রস্তাব করেছে, এটা প্রকাশ করার ঘোর বিরোধী কোনো কোনো দল। খবরের কাগজে তাঁদের কয়েকজনের নামও এসেছে। আমি এর কারণ বুঝি না। প্রস্তাবকের নাম জানা থাকলে তো মানুষ তাঁর প্রশংসা করবে। বলবে, দেখো দেখো, দলটি সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ‘ভালো’ মানুষদের নাম প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবক যদি তাঁর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হন, তাহলে ধরে নিতে হবে, তিনি ‘মন্দ’ লোকের নাম প্রস্তাব করেছেন এবং এ তথ্য ফাঁস হয়ে যাক, এটি তিনি চান না।

একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন, প্রস্তাবকারী দলের নাম জানাজানি হলে ‘সম্মানিত ব্যক্তিদের ওপর দলীয় তকমা পড়ে যাবে’। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা বলেছেন, ‘কে কার নাম প্রস্তাব করল, তা প্রকাশ করা ঠিক হবে না।’

এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। বিদায়ী কমিশনের একজন সদস্য ছিলেন মাহবুব তালুকদার। তাঁর সম্পর্কে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা বলেছেন, তিনি বিএনপির নমিনি। এটি কিন্তু মাহবুব তালুকদার নিজে বলেননি, বিএনপিও বলেনি। তাহলে তাঁর ওপর দলীয় তকমা কেন দেওয়া হলো? কোন যুক্তিতে? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব তালুকদারের কাজকর্মে এতটাই ক্ষিপ্ত ছিলেন যে তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন—মাহবুব তালুকদার মানসিক রোগী, তাঁর চিকিৎসা দরকার।

কোন দল কাদের নাম প্রস্তাব করেছে, এটা হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যাবে না। তবে চূড়ান্তভাবে যাঁরা মনোনীত হবেন, তাঁরা তো অন্য গ্রহের মানুষ নন। তাঁদের ব্যাকগ্রাউন্ড, অতীত কর্মকাণ্ড ও আচরণ একেবারেই অজ্ঞাত থেকে যাবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

উপসংহারে এটা বলা যায়, যাঁরা প্রস্তাবকের নাম প্রকাশের বিরোধী, তাঁরা চান না তাঁদের গুমর ফাঁস হোক। অর্থাৎ ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। সৎসাহস থাকলে তো ফন্দি আঁটার দরকার পড়ে না।

অনুসন্ধান কমিটি প্রস্তাবিত তালিকা ও তাদের নিজেদের অনুসন্ধান থেকে দশটি নাম বাছাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি ‘সিস্টেম’ অনুযায়ী তাঁদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে নিয়োগ দেবেন। তখন তাঁরা পাদপ্রদীপের আলোয় আসবেন। আমরা হররোজ টেলিভিশনে তাঁদের মুখ দেখব, তাঁদের বাণী শুনব।

নির্বাচন কমিশন যেমনই হোক না কেন, সরকারের সহযোগিতা ছাড়া পাঁচজনের পক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব। প্রশ্ন হলো, সরকার ভালো নির্বাচন চায় কি না। গত দুটি নির্বাচন হয়েছে দলীয় সরকারের অধীন। সরকারের দাবি, ওই নির্বাচনগুলো ভালো হয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে তাঁরা চাইবেন এ রকম একটি ‘ভালো নির্বাচন’। দলীয় সরকারের অধীন ‘ভালো নির্বাচন’ হতে পারে, এটি অনেকেই বিশ্বাস করেন না। তাই দাবি উঠেছে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনব্যবস্থা বাতিলের পেছনে বাতিলকারীদের যুক্তি ছিল, একটি অনির্বাচিত সরকারের হাতে তো আমরা ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য ছেড়ে দিতে পারি না। এটা নাকি সংবিধানসম্মতও নয়। আর কে না জানে, আমাদের মতো সংবিধানপ্রিয় জাতি দুনিয়ার আর কোথাও নেই!

এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এত রক্তপাত হয়েছে, যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে, তার একটি ড্রেস রিহার্সাল হিসেবে সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে দেখা যেতে পারে। অনেকেই বলেন, আরে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তো সরকার বদল হয় না! এর সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের তুলনা করা উচিত নয়। কথাটা সর্বাংশে ঠিক নয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্থানীয় সরকার বদল হয়। স্থানীয় সরকারে থাকে ‘পুঁটি মাছ’। জাতীয় পরিমণ্ডলে থাকে রুই-কাতলা। ক্ষমতার পরিমণ্ডলের ব্যাপ্তিতে ফারাক থাকলেও চরিত্রগত পার্থক্য তেমন নেই।

আইয়ুব খানের আমল থেকে এ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীন যত নির্বাচন হয়েছে, সরকারগুলো সব নির্বাচনকেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলেছে। একই ফাটা রেকর্ড সবাই বাজায়। এ নিয়ে যদি একটি প্রজেকশন করা যায়, তাহলে আগামী নির্বাচন কেমন হবে, তা অনুমান করা কঠিন নয়।

রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরের মতো ‘কাইজ্জা-ফ্যাসাদ’ জারি রাখবে। আল্লাহর রহমতের ওপর ভরসা রাখা ছাড়া নাগরিকদের সামনে আপাতত আর কোনো পথ খোলা নেই। কেননা, পরবর্তী নির্বাচন কমিশন যে আরেকটি সিন্ডিকেট হবে না, তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক