নির্বাচন কমিশন নতুন, চাওয়া পুরোনো

কিছুদিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন নতুনভাবে গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সংলাপ করলেন বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। অনেকে আবার আমন্ত্রিত হয়েও যাননি। এর পরপরই নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত একটি আইন সংসদে পাস হয়। সে আইনের আওতায় গঠিত হয় অনুসন্ধান কমিটি। এ কমিটি বিচার-বিশ্লেষণ করে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করে। আর রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন পাঁচজনকে। সংবিধানের আবশ্যিক বিধান অনুসারে নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশেই হয়েছে এ নিয়োগ। তাই এ পর্বে তাঁদের সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে শুভকামনা করছি।

বর্তমানে প্রায় পর্যুদস্ত বিপন্ন নির্বাচনব্যবস্থার মধ্যে যে কমিশন গঠিত হলো, তাদের যোগ্যতা, অযোগ্যতা বা আনুগত্য নিয়ে অনেক কথা থাকলেও আমরা আশায় বুক বাঁধতে চাই। আমরা ধরে নিতে চাই, এ কমিশন জাতিকে আগামী পাঁচ বছর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেবে। অবশ্য নির্বাচন শব্দটির আগে অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার ইদানীং রেওয়াজ হয়ে গেছে। তবে আমি সাধারণত ধরে নিই নির্বাচন কথাটির মধ্যেই এসব বিশেষণ অন্তর্হিত আছে। আগের খতিয়ান না টানলেও এটুকু বলতে হবে, ২০০৮ সালের শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় একটি সক্রিয় ও মর্যাদাসম্পন্ন কমিশনের তত্ত্বাবধানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে ২০০৯ সালের সূচনায়। তারা সরকারে এসে সংবিধানের বহুতর সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও উঠিয়ে দেয়। অবশ্য আদালতের একটি বিভক্ত রায় তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়েছিল।

এরপর দলীয় সরকারের অধীন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি দেশে ও বিদেশে, এটা সর্বজনবিদিত। অবশ্য এগুলোর ফলাফলের বিরুদ্ধে বিরোধী দল কোনো গণ-আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারেনি। তা সত্ত্বেও নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার নজির হিসেবে এ দুটো নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা হয়। অবশ্য অতীতেও এ দেশে ভোটারবিহীন, গণবিচ্ছিন্ন নির্বাচন একাধিকবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে ১৯৯০ সালের পর সময়টাকে গণতন্ত্রের উত্তরণের কাল বলে বিবেচনায় নেওয়া হয়। তাই আলোচনা এ সময়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। অবশ্য এ সময়ে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভোটারবিহীন একটি নির্বাচন হয়েছিল। তবে সে সংসদ ছিল স্বল্পায়ু।

বর্তমান কমিশন সংসদ নির্বাচন করবে বছর দুই পর। তবে এর আগেই বেশ কিছু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দায়িত্ব নিতে হবে। প্রথমেই আসবে কুমিল্লা। তবে নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি নির্বাচন রাজনৈতিকের চেয়ে সামাজিক অনুঘটক বেশি বলে অতীতে লক্ষ করা গেছে। তবে অন্য সিটিগুলোর নির্বাচনে দলীয় ভিত্তিতেই জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। এবার প্রধান বিরোধী দল তাদের বর্জনের কঠোর নীতিতে অটল থাকলে কী হবে, তা বোধগম্য নয়। তবে গতবার তারা নির্বাচনে এসেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভোটের দিনের বেশ আগেই সেসব প্রার্থীর সম্ভাব্য কর্মী-সমর্থকদের জেলে ঢোকানো কিংবা এলাকাছাড়া করা হয়। এজেন্টও দিতে পারেনি তারা প্রায় ক্ষেত্রে। সভা-সমিতি ও মিটিং-মিছিল করে প্রচারণা চালাতেও সরকারবিরোধী প্রার্থীরা বারবার বাধার সম্মুখীন হন। স্বভাবতই সরকারি দলের প্রার্থীরা একতরফা জয় লাভ করেছেন। অবশ্য এর ঠিক পাঁচ বছর আগের সিটি নির্বাচনে রংপুর ছাড়া অন্য সিটিগুলোয় বিরোধী দলের প্রার্থীরা জিতেছিলেন।

বিপন্ন নির্বাচনব্যবস্থার পরিত্রাণ সরকারি দলের পরাজয় বা বিরোধী দলের জয় নয়। আমাদের দেশে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন বরাবরই গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। গত দুটো জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান সরকারের সুযোগ ছিল এর গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করার। নির্বাচন কমিশনের সুযোগ ছিল আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার। এ ক্ষেত্রে সরকার ও কমিশন ব্যর্থ হয়েছে।

বিরোধী দল জিতলেই নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়, এমন দাবি করা যাবে না। তবে আলোচিত সিটি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতহীন আচরণ করেছিল, ছিল কড়া নজরদারিতে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। আর গতবার হয়েছে এর উল্টোটা। এমন অবস্থাই আমরা দেখেছি ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এখানেও সব দল অংশ নিয়েছিল। কিন্তু প্রচার-প্রচারণা বা তাদের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে চরম বৈরী আচরণ ভেস্তে দিয়েছিল নির্বাচনটিকে। এটাকে ব্যাপকভাবে মধ্যরাতের নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করা হয়। এর পেছনে তথ্যাদিও রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু কমিশন ছিল নির্বিকার।

এখন আগামী নির্বাচনগুলোয় প্রধান বিরোধী দল অংশ নেবে কি না, এটা অনিশ্চিত। এদের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে দলীয় সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। আমাদের দেউলিয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীন অত্যন্ত সফল কোনো কোনো নির্বাচন কমিশনকে দলীয় সরকারের সময় নিষ্প্রভ ও ক্ষেত্রবিশেষে অসফল হতে দেখা গেছে। যেমনটা ১৯৯১ সালের নির্বাচন পরিচালনার সময় সিইসি ছিলেন বিচারপতি আবদুর রউফ। সে নির্বাচন প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। সে কমিশনই মাগুরা উপনির্বাচনে এর ছাপ রাখতে পারেনি। ১৯৯৬ সালের অতি সফল আবু হেনা কমিশনকে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের সময় বিপন্ন মনে হয়েছিল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের স্মৃতি অম্লান। নবগঠিত কমিশনে যাঁরা গেছেন, তাঁরাও সবই জানেন। তবে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা তাঁদের আওতায় পড়ে না। তবে সে সময় প্রজাতন্ত্রের যেকোনো কর্মচারী বা সংস্থার সহায়তাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা সংবিধান তাদের দিয়েছে। এর অন্যথা হলে সে ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে সংবিধান ভঙ্গের অভিযোগ আনা যায়। কমিশন প্রয়োজনে এ বিষয়ে সোচ্চার হতে পারে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি বা কমিশন কর্মচারীদের পক্ষপাত বা দায়িত্ব অবহেলার জন্য জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলার বিধানও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের হতে পারে জেল-জরিমানা। অত্যন্ত প্রয়োজন থাকলেও এদিকে কোনো কমিশন অগ্রসর হয়েছে—এমনটা আমরা দেখিনি। সংবিধানে নিশ্চিত করা ক্ষমতা প্রয়োগে বাধার মুখোমুখি হলে কেউ রুখে দাঁড়ায়নি। অথচ আমরা দেখেছি, ভারতের প্রয়াত সিইসি টি এন সেসান নির্বাচনের পরিবেশ অনুকূল না থাকলে একের পর এক নির্বাচন স্থগিত করে আবার তারিখ নির্ধারণ করেছেন কারও পরোয়া না করে। সেদিকে একটু নজর দিতে আমরা বর্তমান কমিশনকে বলতে পারি।

বিপন্ন নির্বাচনব্যবস্থার পরিত্রাণ সরকারি দলের পরাজয় বা বিরোধী দলের জয় নয়। আমাদের দেশে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন বরাবরই গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। গত দুটো জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান সরকারের সুযোগ ছিল এর গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করার। নির্বাচন কমিশনের সুযোগ ছিল আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার। এ ক্ষেত্রে সরকার ও কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে বিতর্ক চলে অনেক। কিন্তু এমনটা বলা হয় না ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলই ছিল আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার মৌলিক হাতিয়ার। সেই ঘোষণাপত্রে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে এর কথা। আমরা বিলুপ্তপ্রায় সে চেতনাই আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছি। আর প্রতিটি কমিশনের কাছে আমাদের থাকে একই প্রত্যাশা।

  • আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

    majumderali1950@gmail.com