আচরণবিধি

নির্বাচন কমিশন এটি কী করল?

প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাজ নিয়ে। তারা কি নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি করবে, না কারও প্রতি পক্ষপাত দেখাবে? যদি ইসি সংবিধান মেনে চলে, তাহলে তাদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হবে, সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সব পক্ষই নিজের সুবিধাকে বড় করে দেখে এবং পারলে নির্বাচন ছাড়াই নিজেকে নির্বাচিত ঘোষণা করে। এখানে ইসির দায়িত্ব হলো কোনো পক্ষ যাতে না-হক সুবিধা আদায় করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা। নির্বাচনে সবার জন্য মাঠ সমতল রাখা।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯-এ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বর্ণিত আছে। তারা রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন পরিচালনা, নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, আইন কর্তৃক নির্ধারিত অন্যান্য নির্বাচন পরিচালনা (এর মধ্যে সব স্থানীয় সরকার পরিষদ, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ অন্তর্ভুক্ত) এবং আনুষঙ্গিক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করে থাকে। দায়িত্ব পালনে ইসি স্বাধীন থাকবে এবং সংবিধান ও আইন দ্বারা পরিচালিত হবে।

নির্বাচনের প্রধান পক্ষ হলেন ভোটার। তাঁরাই ঠিক করবেন কে নির্বাচিত হবেন। গ্রিক নগর রাষ্ট্রে নাগরিকেরা এক জায়গায় বসে ‘নেতা’ নির্বাচন করতেন। বর্তমানে সেটি সম্ভব নয় বলেই আধুনিক নির্বাচনব্যবস্থা চালু হয়েছে। আর সেই নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। কোনো নেতা, মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের নির্দেশে তারা চলবে না; বরং নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়ে কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সবাই চলতে বাধ্য। এখানে কমিশনকে শতভাগ সৎ ও নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, সবাই সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেন না, পারেননি। বাংলাদেশ যেমন মোহাম্মদ আবু হেনা ও এ টি এম শামসুল হুদা কমিশনের মতো সাহসী কমিশন পেয়েছে, তেমনি এম এ আজিজ ও রকিবউদ্দীন কমিশনের মতো অথর্ব কমিশনও পেয়েছে। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো আইনি জোর ইসির আছে। প্রশ্ন হলো, সেটি প্রতিপালনের মতো সততা, দক্ষতা পদাধিকারীরা রাখেন কি না।

কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন একটি খুব জটিল পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে। রকিবউদ্দীন কমিশন ২০১৪ সালে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে কোনো নির্বাচন হয় না, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে দায়ের করা রিটে সেটি স্পষ্ট করে বলেছেন। তাই রাজনীতিকেরা যা-ই বলুন না কেন, বাংলাদেশের মানুষ আশা করে, আগামী নির্বাচন শুধু অংশগ্রহণমূলক হলে চলবে না, সেটি হতে হবে সুষ্ঠু, অবাধ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।

জাতীয় নির্বাচনটি কেমন হয়, সে জন্য আমাদের ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে স্থানীয় তথা চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনই ভাবনার বিষয়। ইসি নির্বাচনী আইন ও বিধি কতটা নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতশূন্যভাবে করতে পারে, তার ওপরই নির্ভর করছে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ। ‘কোনো প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট কেন্দ্রে উপস্থিত না থাকলে কিছু করার নেই’-এ কথা বলে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি পার পেতে পারে না। তাদের অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে কী কারণে সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট নেই। কী কারণে ভোটারদের কেন্দ্রে এসেও ভোট না দিয়ে ফিরে যেতে হয়। ভোটার ও ভোটের নিরাপত্তা রক্ষাই ইসির দায়িত্ব।

এর আগে নির্বাচনী আচরণবিধিতে ছিল প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, সাংসদ ও সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা স্থানীয় সরকার সংস্থার কোনো নির্বাচনে প্রচারকাজে অংশ নিতে পারবেন না। নির্বাচন কমিশন যখন এই বিধি তৈরি করে, তখনো স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হতো নির্দলীয় ভিত্তিতে, যদিও সেখানে রাজনৈতিক দলের নেতারাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। পরবর্তী কালে বর্তমান সরকারই বিভিন্ন মহলের আপত্তি উপেক্ষা করে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ (পরোক্ষ) এবং কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনও আগের আইন ও আচরণবিধিতে তারা সম্পন্ন করেছে। তারপর কী এমন ঘটনা ঘটল যে আচরণবিধি পরিবর্তন করে সাংসদের নির্বাচনী প্রচারে নামার সুযোগ করে দিতে হলো? আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসি যখন বৈঠক করেছে, তখনো সাংসদদের প্রচারে অংশগ্রহণ নিয়ে যে নিষেধাজ্ঞা আছে, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি।

গত ১২ এপ্রিল এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে সাংসদদের প্রচারের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানানোর পরই ইসি তৎপর হয়ে ওঠে। প্রথমে পাঁচ নির্বাচন কমিশনার বসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন এবং কবিতা খানমের নেতৃত্বাধীন আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ ব্যাপারে প্রস্তাব দিতে বলেন। সেই কমিটির প্রস্তাবের আলোকে ২৪ মে ইসির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনের প্রচারে এখন থেকে সাংসদেরা অংশ নিতে পারবেন। কেননা, তাঁদের পদটি নাকি লাভজনক নয় আর সাংসদেরা নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন। অনেকটা ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছে পূরণ করল ইসি। তবে তারা সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। কমিশনার মাহবুব তালুকদার বৈঠকে লিখিতভাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন। এর অর্থ তিনি এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন।

এখন দেখা যাক সিইসিসহ যে চার কমিশনার সদয় সম্মতি দিলেন, তাঁদের যুক্তিটা কী। নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই সংশোধনী আনা হয়েছে কি না। তাঁর জবাব, ‘নির্বাচন কমিশনের স্টেকহোল্ডার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। অনেকভাবে তারা প্রস্তাব নিয়ে আসে। ইসির কাছে যেটা মনে হয় যুক্তিযুক্ত, তখন ইসি আলোচনার মাধ্যমে বিবেচনা করে থাকে।’

সেটাই যদি হবে, বিএনপিসহ অধিকাংশ দল স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে, ইসি কেন তাদের দাবি আমলে নিল না? এমনকি বিষয়টি নিয়ে তো কমিশনের কোনো বৈঠকে আলোচনা পর্যন্ত তারা করল না। ইসির এই দ্বৈতনীতি মহাবিপদ ডেকে আনতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ আর মাগুরার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘সাংসদ পদটি লাভজনক কি না, এটি নিয়ে আমাদের সময় বিস্তর আলোচনা হয়েছিল। সব পক্ষের সঙ্গে বহু আলোচনার পর অমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রচারে সাংসদেরা অংশ নিতে পারবেন না। এর কারণ হলো সাংসদেরা যখন এলাকায় যান, তখন নানা ধরনের প্রভাব তৈরি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসন তাঁদের কথা শোনে।...নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত ভালো হয়নি। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার যে ধারণা, সেদিক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি।’ (প্রথম আলো, ২৫ মে ২০১৮)

প্রথম আলোর একাধিক সম্পাদকীয়তেও ইসিকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, এ রকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবেন না। কিন্তু ইসি আমাদের সদুপদেশ শোনার প্রয়োজন বোধ করেনি। ইসির যে পদাধিকারীরা মনে করেন সাংসদেরা গুরুত্বপূর্ণ নন, তাঁদের বলব একবার নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে দেখুন, সেখানে তিনিই ‘রাজা’। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবই তাঁর হুকুম বরদার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে সরকারটি গঠিত হয়, সেই সরকারটি গঠন করেন সাংসদেরা। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর প্রথম পরিচয় তিনি একজন সাংসদ। সাংসদ না হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হতে পারতেন না (টেকনোক্র্যাট কোটায়ও মন্ত্রী করার বিধান আছে। তবে তা ১০ শতাংশের বেশি নয়)।

নির্বাচন কমিশনের অযৌক্তিক সিদ্ধান্তটি এখনো আইনে পরিণত হয়নি। আইন করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের প্রয়োজন হবে। আমরা আশা করব, আইন মন্ত্রণালয় এটি অনুমোদন করবে না। ইসির সচিব বলেছেন, যেহেতু গাজীপুরের তফসিল হয়ে গেছে এবং ঈদের পরই সেখানে নির্বাচন হবে; সেহেতু গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নতুন বিধান কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাহলে তিনটি সিটি করপোরেশন-বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটকে লক্ষ্য করে ইসি কেন এটা করতে গেল? এর মাধ্যমে নিজের অধীনতাই প্রকাশ করল স্বাধীন বলে দাবিদার নির্বাচন কমিশন।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com