নির্বাচন কমিশনের মানের পতন আমাকে ব্যথিত করে

২০০৭ সালে আমার কল্পনার বাইরে যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তা ছিল নির্বাচন কমিশনে আমার অন্তর্ভুক্তি। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনে কমিশনার পদে পদায়ন হতে আহ্বান জানানো হয়েছিল তৎকালীন সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তরফ থেকে। যদিও বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরে ঊর্ধ্বতন সদস্য হিসেবে প্রতিটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়েছে, তারপরও নির্বাচন নিয়ে আমার খুব বিস্তারিত ধারণা থাকার কথা নয়। সামরিক বাহিনী পরিচালনা এবং মাঠে, আপদে-বিপদে ও দুর্যোগে কাজ করার যে বিশাল অভিজ্ঞতা, সেটাই পুঁজি ছিল। তবে আরও পরে অবসরপ্রাপ্তির পর কিছু পড়াশোনা ও ওই সময়কার নাগরিক সমাজের সঙ্গে যুক্ত হয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও উন্নয়ন সাধন নিয়ে অনেক আলোচনা, সেমিনার ও সামান্য লেখালেখির কারণে পড়তে হয়েছিল।

যা-ই হোক, নির্বাচন কমিশনের আইন এবং পদ্ধতিতে কিছু সংস্কার নিয়ে সংবাদমাধ্যমেও আলোচনা করেছি। হয়তো এসব কারণে এবং পরিচিত মুখ বলে কমিশনে অন্তর্ভুক্তির আমন্ত্রণ পেয়েছি। কিন্তু এরপরও তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ভাবতে হয়েছিল। কারণ, ওই সময় যাঁরা কমিশনে ছিলেন, তাঁদেরকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে শুধু ধিক্কৃতই নয়, নানা ধরনের বিড়ম্বনা সইতে হচ্ছিল। এমন বিড়ম্বনা বোধ হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘটেনি। কারণ, ওই সময় রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে নির্বাচন কমিশন এবং এর সদস্যদের ওপর জনগণের আস্থা শূন্যে নেমে এসেছিল। আমার কল্পনায় তখন তিনটি প্রধান বিষয় ছিল, ভাবছিলাম যদি এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে কিছু করা যায়। (১) ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা। (২) রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধিত করে জনগণের কাছে জবাবদিহির দ্বার উন্মুক্ত করা। (৩) প্রায় ১৫ বছর বন্ধ হয়ে থাকা উপজেলা নির্বাচন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করা।

গত দুই কমিশন ও নির্বাচন সাধারণ মানুষ ও ভোটারদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। মানুষ আস্থা হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানের ওপর, কিছুতে বিশ্বাস রাখতে পারছে না। এখানেই হবে অনুসন্ধান কমিটির পরীক্ষা।

আমি কমিশনে যোগদানের কয়েক দিন আগেই অত্যন্ত কর্মঠ এবং কর্মক্ষম চৌকস সাবেক সচিব শামসুল হুদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং সাবেক আইনসচিব ছহুল হোসাইন (এবারের সার্চ কমিটির অন্যতম সদস্য) নিয়োজিত হয়েছিলেন। এ দুজনই আমার কাছে ছিলেন দিকপাল। হুদা সাহেব আমার পূর্বপরিচিত হলেও ছহুল সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় কমিশনে, একজন সজ্জন ব্যক্তি।

এর আগে ২০০৬-০৭ সালের রাজনৈতিক সংকটের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল নির্বাচন কমিশন, যার বিশদ বিবরণের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সমগ্র বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু। বিশেষ করে, ভোটার তালিকায় প্রায় দেড় কোটি অতিরিক্ত ভোটার থাকার অভিযোগে তালিকা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ে অথচ এরই মধ্যে নির্বাচনের তারিখ এবং কয়েকজন প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিতও হয়ে গিয়েছিলেন। অপর দিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিরোধের কারণে অনেক জায়গায় নির্বাচনী অফিস হামলার শিকার হয়, অফিসে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে, এমনকি অনেক নির্বাচনী কর্মকর্তা হেনস্তার শিকার হন। এক কথায়, নির্বাচন কমিশন বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনাস্থা আর হীনম্মন্যতায় ভুগছিলেন। এমন অবস্থায় আমাদের প্রথম কাজ ছিল নির্বাচন কমিশনকে অভ্যন্তরীণভাবে পুনর্গঠিত করা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আশ্বস্ত করা ও তাঁদের ঐতিহ্য এবং গৌরবকে ফিরিয়ে এনে বিশ্বাস স্থাপন করা। এটা করতে আমাদের তিনজনকেই একাধারে অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সংস্কার, ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরির পদ্ধতি প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি আমাদের গৃহীত সংস্কারগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরা ও দৃশ্যমান করার দিকে মনযোগ দিতে হয়েছে। এ পর্যায়ে সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করার বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা আমাদের কর্মকাণ্ডকে দারুণভাবে তুলে ধরেছে।

অপর দিকে নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি এবং হাতে নেওয়া সংস্কারের বিষয়ে মতামত তুলে ধরে আলোচনা, সমালোচনা ও সুপারিশের জন্য ক্রমেই সব শরিক দলকে অংশীদার করতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যেতে হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নে তদারকি করতে দেশের আনাচকানাচে অনবরত ঘুরতে হয়েছে। অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন করতে হয়েছে। করতে হয়েছে নতুন আঙ্গিকে রেজিস্ট্রেশন, নতুন আঙ্গিকে সংসদ ও ১৫ বছর বিরতির পর উপজেলা নির্বাচনের আয়োজন। নির্বাচনে সব দলকে সম্পৃক্ত করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। প্রায় দুই বছর আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রশংসনীয় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর ধারাবাহিকতা তৃণমূল নির্বাচন পর্যন্ত চলে।

আমাদের অনেক দৃশ্যমান অথবা অদৃশ্যমান কাজের মধ্যে সবচেয়ে দৃশ্যমান ও বড় কাজ ছিল নির্বাচন কমিশনের মূল ভবন, আঞ্চলিক, জেলা এবং উপজেলা পর্যন্ত কমিশনের অফিস তৈরি করে দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে আলাদা পরিচয়ে শক্ত ভিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নবরূপ দেওয়া হয়েছিল। কর্মকর্তাদের মধ্যে নতুন প্রাণ, গর্ব করার মতো পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল (বিস্তারিত আমার লেখা, নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর দ্রষ্টব্য)।

যা-ই হোক, নির্বাচন কমিশন এবং এর কর্মকাণ্ড আমাদের কাছে, বিশেষ করে, আমার কাছে কোনো দায়িত্ব বা চাকরি নয়, নেশায় পরিণত হয়েছিল। পাঁচ বছর দিন-রাত মিশে গিয়েছিলাম এ প্রক্রিয়ায় আর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। শুধু আমার নয়, আমাদের তিনজনেরই কমবেশি একই অনুভূতি। তাই কমিশনের মানের পতন আমাকে এবং আমাদের ব্যথিত করে। আজও করে, যত দিন বেঁচে থাকব, করবে। এ কারণেই আগামী কমিশন কেমন হবে, তা নিয়ে কিছুটা ভাবাবেগের কারণেই সার্চ কমিটির সামনে উপস্থিত হয়েছি। তবে যেভাবে উৎসাহী প্রার্থীদের নাম জমা হয়েছে, তদবিরও নাকি হচ্ছে, তাতে মনে হয় নির্বাচন কমিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভাবগাম্ভীর্য এবং গুরুত্ব অনেকেই উপলব্ধি করতে পারেননি।

আমাদের কাছে, অন্তত আমার কাছে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ছিল প্রবল অনুরাগের (প্যাশন) এবং সেটা এখনো আছে। কাজেই এই প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের অবমাননা, জনগণের চোখে হেয় হওয়া অথবা জনগণের পুরো আস্থা হারানোর বিষয়টি প্রত্যক্ষ করলে প্রাণে আঘাত লাগে। এই অনুরাগের কারণেই বিগত বছরে উচ্চ গবেষণা ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। প্রথমে এমফিল পরে পিএইচডি এবং প্রায় ৮০টির বেশি প্রবন্ধ ও ৪টি বই লিখেছি, এখনো লিখছি। যাতে এই প্রতিষ্ঠানটি মর্যাদা ধরে রাখতে পারে। আজও উপজেলা অফিসগুলো দেখলে ভাবাবেগে ভেসে যাই। কত দিন, কত রাত কাটিয়েছি এ জায়গাগুলো বের করতে।

অনুসন্ধান কমিটির কাছে আমার একটিই বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনে সদস্য হতে যত গুণাবলিরই চর্চা হোক, আমার মতে নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন নিয়ে সদস্যদের প্যাশন না থাকলে ফলাফল নিয়ে সন্দেহ থাকবে। গত দুই কমিশন ও নির্বাচন সাধারণ মানুষ ও ভোটারদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। মানুষ আস্থা হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানের ওপর, কিছুতে বিশ্বাস রাখতে পারছে না। এখানেই হবে অনুসন্ধান কমিটির পরীক্ষা।

আগামী নির্বাচন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো হলে তা হবে বাংলাদেশের জন্য অশুভ এবং উদার গণতন্ত্রের জন্য দুঃসংবাদ।

(১৩ ফেব্রুয়ারি অনুসন্ধান কমিটির সভায় উপস্থাপিত বক্তব্য)

এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার