নাগরিক সংগঠন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিতর্ক হয়নি—এমন ঘটনা বিরল। সংস্থাটির দুর্নীতির সূচক, পার্লামেন্টে সময়ের অপচয়, পুলিশের দুর্নীতির মতো বিষয়গুলোর কথা এখানে স্মরণ করা যায়। গত তিন দশকে তাদের দুর্নীতির সূচককে ঘিরে কত রাজনীতিই না হয়েছে।
কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য যে তাদের সাম্প্রতিক একটি বিবৃতি নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই। ১২ ডিসেম্বরের ওই বিবৃতিতে টিআইবি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনারের আশু অপসারণ ও নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই’ উল্লেখ করে বিষয়টিতে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। কারণ হিসেবে টিআইবি বলেছে, একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে একের পর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিচ্ছে, তা অভূতপূর্ব ও গোটা জাতির জন্য বিব্রতকর।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে নিশিরাতের নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরপূর্তির আগে এই বিবৃতির বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কিংবা সরকার কোনো প্রতিবাদ করেনি। কমিশন এবং সরকারের নীরবতার কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া অন্যায় হবে না যে এসব গুরুতর অভিযোগের কোনো জবাব তাদের কাছে নেই। অবশ্য, বিরোধী দলগুলোও যে ট্রান্সপারেন্সির বক্তব্যের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে, তা-ও নয়। বিরোধী দলগুলো সম্ভবত দম হারিয়ে ফেলায় এ বিষয়ে নীরবতা পালনের বিকল্প কিছু ভাবতে অক্ষম।
নিয়োগপ্রক্রিয়ায় একজন কমিশনারের অনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট কমিশনের অভ্যন্তরীণ বিরোধের খবরের পটভূমিতে টিআইবি এই বিবৃতি দেয়। তবে বিবৃতিতে তারা বলেছে, এই নির্বাচন কমিশন দেশকে এক অভূতপূর্ব নির্বাচনের দায় চাপিয়ে দিয়েছে, যার পরতে পরতে অনিয়মের অভিযোগ সত্ত্বেও কোনো তদন্ত হয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনাররা এবং সচিবালয়ের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণের নামে জনগণের করের টাকা লুট করেছেন, এমন অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু তারপরও ছিল অস্বস্তিকর নীরবতা। ব্যর্থতা এবং নৈতিক স্খলনের দায় নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা অন্য কমিশনাররা যে সরে যাবেন না, সেটা এত দিনে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। টিআইবি রাষ্ট্রপতির প্রতি এই বিতর্কিত ব্যক্তিদের দ্রুত অপসারণের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণের আবেদন জানিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের অযোগ্যতা ও খোলামেলা পক্ষপাতে একমাত্র ক্ষমতাসীন দল ছাড়া সবারই রয়েছে হতাশা ও ক্ষোভ। এমনকি তাদের জোটসঙ্গীদের অনেকেই প্রকাশ্যে এ বিষয়ে একাধিকবার মুখ খুলেছেন। একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে জোট শরিক রাশেদ খান মেনন ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ’ কোনো এক ‘অশুভ শক্তি’ নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে অভিযোগ করে নির্বাচনকে তার যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আরেক শরিক জাসদ সংসদেই রাতের বেলায় ভোট হওয়ার কথা বলে তার জন্য ‘অতি উৎসাহীদের’ দায়ী করেছিল।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে অবশ্য এ কথাও সত্য যে দেশের প্রধান বিরোধী দল এতটাই রক্তশূন্যতায় ভুগছে যে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানানোর সামর্থ্যও তারা হারিয়ে ফেলেছে। গত এক বছরে এই কমিশনের পদত্যাগের দাবিটাও তারা যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারেনি। মানুষের ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে দলটি বরং একের পর এক নির্বাচনী প্রহসনে অংশ নিয়ে চলেছে। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটবে, এমন আশা করা কঠিন। ভোটের পবিত্রতা রক্ষায় ব্যর্থতার দায় নিয়েও তাঁরা কী আশায় নাগরিকদের কাছে ভোট প্রার্থনা করেন, তা-ও বোঝা ভার। নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ নিয়ে তাঁরা যে একটা কার্যকর আইনি লড়াই করতে পেরেছেন, তা-ও নয়। রকিব কমিশনের অধীনে ঢাকার গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও যে কারচুপি ও কেন্দ্র দখলের উৎসব হয়েছিল, তা নিয়ে বিএনপি আইনি লড়াইয়ের কথা বলেছিল। ওই নির্বাচনের মেয়ররা তাঁদের মেয়াদ পূরণ করেছেন, কিন্তু নির্বাচনী বিরোধের আইনগত প্রতিকারের কোনো চেষ্টাই দেখা গেল না।
ভোটের পবিত্রতা রক্ষায় ব্যর্থ কমিশন ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন ব্যবস্থার যে সর্বনাশ সাধন করেছে, তার স্বীকারোক্তিগুলো আমরা ধীরে ধীরে তাদের মুখ থেকেই শুনেছি। শুরুটা অবশ্য করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। সেটাও ৩০ ডিসেম্বরের মহড়া হিসেবে অনুষ্ঠিত খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ দিয়ে। পরে উপজেলা নির্বাচনের প্রস্তুতির সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কমিশনাররা একটু একটু করে মুখ খুলতে শুরু করেন। ৮ মার্চ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনী কর্তাদের এক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে বলেন, যদি ইভিএমে ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না। সেদিন তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে কারা সে জন্য দায়ী, তাদের কী করা যাবে...সেই দীক্ষা-শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা, যোগ্যতা আমাদের কমিশনের নেই এবং সেভাবে বলারও সুযোগ কোনো নেই যে কী কারণে হচ্ছে, কাদের কারণে হচ্ছে, কারা দায়ী। (বিডিনিউজ২৪.কম, ৮ মার্চ ২০১৯)। সেই অনুষ্ঠানেই কমিশনার শাহাদাত হোসেন বলেছিলেন যে উপজেলা নির্বাচনে আগের রাতে ভোট চলবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিশি ভোট বিশেষণ চালু হওয়ার বিষয়টি যে মোটেও ভিত্তিহীন নয়, এগুলো তারই সাক্ষ্য।
নির্বাচনের ছয় মাস পর গত জুলাইয়েও নির্বাচন কমিশন যখন তার ওয়েবসাইটেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায়, ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে ভোট পড়েছে শতভাগ। তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা সংবাদমাধ্যমগুলোকে বলেন, শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। তবে আগে কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেনি। গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর আর কিছু করার থাকে না (ডয়চে ভেলে, ১০ জুলাই, ২০১৯)। গত এক বছরে কমিশনের অন্য সদস্যরাও কিছুটা সরাসরি এবং কিছুটা পরোক্ষে নানা অনিয়মের কথা বলতে গিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছেন। সম্প্রতি মাহবুব তালুকদার আবারও বলেছেন, নির্বাচন কমিশন আইনতভাবে স্বাধীন হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা নির্বাচন-প্রক্রিয়ার কাছে বন্দী। তিনি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন উল্লেখ করে বলেছেন, ‘নির্বাচন যদি গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের পদযাত্রা অবারিত করতে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হতে হবে। অবৈধভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জনগণের প্রতি বা গণতন্ত্রের প্রতি কোনো কমিটমেন্ট থাকে না।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময়ে বলেছেন, ‘নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোটারদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমরা নেব। তাঁরা ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরবেন, সেই নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করব। তাই আহ্বান করব, ভোটাররা যেন ভোট দিতে আসেন।’ তাঁর এই কথাতেই স্বীকারোক্তি মেলে অতীতে তাঁরা ভোটারদের নিরাপত্তাও দেননি, নির্বাচনও নিরপেক্ষভাবে করতে পারেননি।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন-বিকৃতির পটভূমিতে উপজেলা নির্বাচন আয়োজনের সময়ে ২ মার্চ বাম জোট এক বিবৃতিতে ‘জনগণের ট্যাক্সের টাকা অপচয় করে নির্বাচনের নামে তামাশা বন্ধ করার’ আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, ভোটের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বন্ধ করতে হবে। তবে বিএনপি ও তার জোট সহযোগীদের মতোই বাম জোটও নির্বাচন ব্যবস্থার পবিত্রতা ও তার প্রতি জন-আস্থা পুনরুদ্ধারে কোনো অর্থবহ কার্যক্রম গ্রহণে সক্ষম হয়নি। ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধারে যে ধরনের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল, তা অর্জনে বিরোধী দলগুলোর এই ব্যর্থতার দায় কেউ গ্রহণ করুক বা নাই করুক, নির্বাচন কবে আবার বিশ্বাসযোগ্য হবে, তার কোনো উত্তর তাদের কাছে নেই। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন ব্যবস্থায় আস্থা পুনরুদ্ধারে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার পটভূমিতে নাগরিক সমাজের তরফে যে উদ্বেগ ও দাবি জানানো হয়েছে, তার আলোকে আদৌ কি কোনো নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠবে?
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক