মতামত

‘নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিশ্চিতকরণ আইন’

আইনটি মহান জাতীয় সংসদ ২৭ জানুয়ারি পাস করেছে। যে আইন পাস হয়েছে, তার শিরোনাম অবশ্য কিছুটা ভিন্ন; ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশন নিয়োগ বিল ২০২২’। নির্বাচন কমিশন গঠনের এই বিলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছেন।

আইনে সম্মতি প্রদান করা রাষ্ট্রপতির একটা রুটিন কাজ। যত দূর জানি, গত শতাব্দীর শেষের দিকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একটা সংশোধনী আইনে সম্মতি না দিয়ে পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতির সম্মতি না দেওয়ার ঘটনা গত সিকি শতাব্দীতে ঘটেছিল কুল্লে একবার। অবশ্য সংবিধান অনুযায়ী সংসদ রাষ্ট্রপতির অসম্মতি আমলে না নিয়ে আইনটি আবার পাস করতে পারে। সংসদ দ্বিতীয়বার পাস করলে রাষ্ট্রপতি সাত দিনের মধ্যে সম্মতি দিতে বাধ্য। যদি কোনো কারণে দ্বিতীয়বারও রাষ্ট্রপতি সম্মতি জ্ঞাপনে বিরত থাকেন, তাহলে সংবিধান বলেছে, তিনি সম্মতি দিয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হবে।

যে আইন পাস হলো, সেই আইন নিয়ে আলাপ-আলোচনায় সরকারি দলের পক্ষ থেকে এমন একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে যে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি অনেক বিষয়েই স্বীয় বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সরকারি দলের এ ধারণার পক্ষে একটা যুক্তি দাঁড় করানো যেতে পারে যে আমাদের সংবিধানে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে দেড় শ বারের বেশি। এত অধিকবার যেহেতু রাষ্ট্রপতি শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে, সেহেতু তার একটা গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে। অবশ্য পৃথিবী গোলাকার নয়, এ বাক্য আপনি হাজার বা লক্ষবার লিখলেও পৃথিবী চ্যাপটা হয়ে যাবে না।

২.

ইদানীং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন নিয়ে যত বেশি আলোচনা হয়েছে, এত বেশি আলোচনা শেষবার হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ পাসের আগে; সংসদে পাস হওয়ার সময় এবং এখন পর্যন্ত সেই আলোচনা বজায় আছে। কয়েক দিন আগে আইনমন্ত্রী আবারও বলেছেন এ আইন সংশোধনের কথা। আইনটি নিয়ে সম্পাদক মহল, সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের বিভিন্ন গোত্র-উপগোত্র ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ভূরি ভূরি মত প্রকাশ করেছিলেন এবং এখনো অকাতরে মতামত প্রদান করে চলেছেন। তবে সরকার অনড়, এ আইনের আওতায় ধরে ধরে সব গোত্রের মানুষকে জেলে পাঠানোর সুব্যবস্থা চালু রেখেছে। এ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই একইভাবে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন নিয়েও আলাপ-আলোচনার কোনো ঘাটতি ঘটে নেই। তবে ফলাফল একই, সরকার যা চেয়েছে, তা-ই হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে সরকার যে বাহাদুরি দেখিয়েছে, নির্বাচন কমিশন আইনেও সেই বাহাদুরিই বজায় থাকল। অবশ্য ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে যে আইনটির ব্যাপারে সংসদে উপস্থাপিত বিভিন্ন মতামত চূড়ান্ত আইনে প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটিতে একজন নারী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আহা, বেশ বেশ বেশ!

নির্বাচন কমিশন গঠনে একটা আইন পাস করার কথা সংবিধানে বলা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। সংবিধানের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটা আইন সংসদ পাস করবে, যার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত সৎ, রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ এবং অভিজ্ঞ ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিরা নির্বাচন কমিশন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন। রাম-শ্যাম-যদু-মধুবর্গকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়া অথবা দিনের নির্বাচন রাতে সম্পন্ন করার জন্য আইনের কথা সংবিধান প্রণয়নকারী গণপরিষদের সদস্যরা নিশ্চয়ই চিন্তা করেননি। তাঁরা চিন্তা করেছিলেন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন নিশ্চিত করার জন্য আইনের কথা। সংবিধান প্রণয়নকারী গণপরিষদের অতি অল্পসংখ্যক সদস্য এখনো জীবিত। ২৭ জানুয়ারি পাস হওয়া আইনটি নিয়ে তাঁরা পুলকিত বোধ করছেন, এমন ধারণা করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। গণপরিষদের কয়েকজন সদস্য জীবিত থাকলেও তাঁদের একজনও মহান জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্য আছেন বলে নাম চোখে পড়েনি। সম্ভবত প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গণপরিষদের সদস্য হিসেবে ইদানীংকালের সংসদে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখানে এটা উল্লেখ করা মোটেও অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের প্রয়াত বাবা আইনজীবী সিরাজুল হক সাহেবও গণপরিষদের সদস্য ছিলেন।

অনুসন্ধান কমিটি হুট করে ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। এই ১০ জনের মধ্য থেকে কে হবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার আর কারা বাকি চারজন নির্বাচন কমিশনার, সেটা—এই আইনে যা কিছু বলা থাকুক না কেন—সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারণ করে দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

৩.

আলোচ্য নির্বাচন কমিশন গঠন আইনে যে ছয়জন সদস্যের সমন্বয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে, তাঁদের অনেকেই সরকারের কমবেশি অনুগ্রহভাজন হবেন এটাই স্বাভাবিক। আপনি যতই যোগ্য, দক্ষ, সৎ ও অভিজ্ঞ হোন না কেন, আপনার প্রতি সরকার সদয় না হলে নিশ্চয়ই কোনো বড় পদ পাবেন না। আর সরকার যদি আপনার প্রতি অতিশয় সদয় হয়, তাহলে মেধা-অভিজ্ঞতা ইত্যাদি অত্যন্ত মামুলি যোগ্যতা, যেমন কে এম নূরুল হুদা।

পদধারী চারজন ছাড়া অনুসন্ধান কমিটিতে আরও দুজন সদস্য নিয়োগ হবেন ‘রাষ্ট্রপতি’ কর্তৃক। সরকারের ভাবখানা এই যে রাষ্ট্রপতি স্বীয় বিবেচনায় এই দুই সদস্যকে নির্ধারণ করবেন। ‘আষাঢ়ে গল্প’ আর কত শুনব? অনুসন্ধান কমিটি হুট করে ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। এই ১০ জনের মধ্য থেকে কে হবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার আর কারা বাকি চারজন নির্বাচন কমিশনার, সেটা—এই আইনে যা কিছু বলা থাকুক না কেন—সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারণ করে দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধান বলছে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কী পরামর্শ দিয়েছেন, সে ব্যাপারে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। অর্থাৎ, পুরো ব্যাপার যাতে সম্পূর্ণ সংগোপনে করা যায়, সংবিধান তা নিশ্চিত করেছে। মূল কথা দাঁড়াচ্ছে, সরকার নির্ধারিত অনুসন্ধান কমিটি সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী ১০ জনকে মনোনীত করবে এবং চূড়ান্ত সিলেকশনও হবে সরকার বাহাদুরের ইচ্ছা অনুযায়ী।

আগামী বড় নির্বাচনী খেলার এখনো বছর দুয়েক বাকি, কিন্তু এখন থেকেই সেই নির্বাচনী খেলার ফলাফল মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল এই আইনের মাধ্যমে। তাই আইনটার জুতসই শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল ‘নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিশ্চিতকরণ আইন-২০২২’।

প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, এত আলোচনা-সমালোচনা, আইনের বিকল্প খসড়ার প্রস্তাব ইত্যাদি উপেক্ষা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনটি সরকার সংসদের মাধ্যমে কেন পাস করল? এর সম্ভাব্য ও যৌক্তিক একটাই উত্তর থাকতে পারে, সেটা হলো আগামী জাতীয় নির্বাচনসহ এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনগুলোর একটা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিশ্চিত করা। কোনো খেলায় জেতার একটা সহজ উপায় হলো আপনার দলের একনিষ্ঠ সমর্থক ব্যক্তিকে রেফারি বা আম্পায়ার হিসেবে খেলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া। ফুটবল খেলায় প্রতিপক্ষ গোল দিলে রেফারি বলবে অফসাইড বা ফাউলের কারণে গোল হয়নি। প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান আউট না হলেও আম্পায়ার বলবে আউট। অর্থাৎ খেলার ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারিত থাকবে। খেলার মাঠে প্রচুর দর্শক থাকতে পারে, হাততালি, করতালি অকাতরে হতে পারে, কিন্তু কে জিতবে কে হারবে, সেটা নির্ধারিত হয়ে থাকবে খেলা শুরুর অনেক আগেই। আগামী বড় নির্বাচনী খেলার এখনো বছর দুয়েক বাকি, কিন্তু এখন থেকেই সেই নির্বাচনী খেলার ফলাফল মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল এই আইনের মাধ্যমে। তাই আইনটার জুতসই শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল ‘নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিশ্চিতকরণ আইন-২০২২’।

শেষের কথা

গত শুক্রবার বাংলাদেশ চলচিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন ছিল। তার দু-তিন দিন আগে থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নির্বাচনটাই ছিল অন্যতম মুখ্য আলোচ্য বিষয়। টিভির সংবাদে দেখেছি কারওয়ান বাজারের এফডিসির গেটের সামনে শত শত ভক্ত আর উৎসুক জনতার ভিড়। নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা বাঙালির মজ্জাগত ব্যাপার। যে নির্বাচন নিয়ে এত উৎসাহ ও আগ্রহ, সেই নির্বাচন তো হয় না বহুকাল, শিল্পী সমিতির নির্বাচন হঠাৎ করে আসল নির্বাচনের মতো হয়ে গেল, তাই এত উৎসাহ-উদ্দীপনা। মুখ্য নির্বাচনের ফলাফল যেহেতু ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে, তাই নিকট ভবিষ্যতে আমরা অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনায় ব্যস্ত হয়ে যাব বিভিন্ন ধরনের অরাজনৈতিক সংঘ, সংগঠন, চক্র, ক্লাব ইত্যাদির নির্বাচন নিয়ে। এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ।

ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক