>২৪ অক্টোবর ছিল জাতিসংঘ দিবস। সেদিন রাজধানী ঢাকার লেক শোর হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে জাতিসংঘ সহযোগিতা করে আসছে; উন্নয়নের নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করার পাশাপাশি মিয়া সেপ্পো নির্বাচন প্রসঙ্গেও কথা বলেন। তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম দিক। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য বক্তৃতাটির বাংলা অনুবাদ ছাপা হলো।
উন্নয়নযাত্রায় মুগ্ধ করার মতো অগ্রগতি অর্জনকারী নবীন দেশ বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে জাতিসংঘ দিবস উদ্যাপনের সুযোগকে আমি এ দেশে কর্মরত জাতিসংঘ টিমের পক্ষ থেকে অনেক সম্মানের বিষয় বলে মনে করছি।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পর্যায়ে বাংলাদেশ মেয়েদের বিদ্যালয়মুখী করার ক্ষেত্রে অগ্রগামী দেশগুলোর অন্যতম ছিল। সরকারিভাবে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে বিশ্বে যত দেশ মেয়েদের বিদ্যালয়মুখী করতে পেরেছে এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যায়ে ছেলেমেয়ের সমতা অর্জন করতে পেরেছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে।
বিশ্বে বাংলাদেশই প্রথম দেশ, যে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ২০০৯ সালে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান’ শীর্ষক একটি পরিকল্পনা কাঠামো দাঁড় করিয়েছে। এই সঙ্গে দেশটি দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর উদ্যোগ হিসেবে সফলভাবে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ‘সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক’ অনুসরণ করে আসছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে বাংলাদেশের জনগণের সাহসী প্রত্যাবর্তনের গল্প বলা যেতে পারে।
জাতি হিসেবে এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের পাশে বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে জাতিসংঘ রয়েছে।
সরকারি, বেসরকারি ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করেছে; এসব অর্জনের মধ্য দিয়েই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের মজবুত ভিত্তি রচিত হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের এক সক্রিয় সদস্যরাষ্ট্র। বিশ্বের শান্তি ও উন্নয়ন অ্যাজেন্ডায় বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে কার্যকর অবদান রেখে চলেছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যেসব দেশের সর্বাধিকসংখ্যক সেনা অংশ নিয়েছেন, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। জাতিসংঘ মহাসচিবের অ্যাকশন ফর পিসকিপিং সংস্কার উদ্যোগ (এফোরপি) এবং যৌন নির্যাতন ও নিগ্রহের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতিরও (এসইএ) সক্রিয় অংশীদার বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের সংঘাত প্রতিরোধ ও ‘টেকসই শান্তি’বিষয়ক কর্মসূচি এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
‘গ্লোবাল কমপ্যাক্ট ফর মাইগ্রেশন’ শীর্ষক জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক চুক্তির অন্যতম প্রস্তাবক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জি-৭৭ এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন তহবিল ও কার্যক্রমের নির্বাহী পর্ষদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশ চতুর্থ মেয়াদে গর্বিত সদস্য হিসেবে কাজ করছে। এই চতুর্থ মেয়াদকে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের মানবাধিকার রক্ষার কাজে গতি সঞ্চারে বাংলাদেশকে আমি উৎসাহিত করি। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ইউনিভার্সাল পেরিওডিক রিভিউতে (ইউপিআর) যে সুপারিশ এসেছে, বাংলাদেশ তা বাস্তবায়ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে। আগামী বছরগুলোতে ইউপিআর বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিতে জাতিসংঘ সব সময়ই প্রস্তুত আছে।
ইউপিআরে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সেসবের মধ্যে বাক্স্বাধীনতা পরিস্থিতির উন্নয়ন করা, বাল্যবিবাহের অবসান ঘটানো, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা, মানবাধিকারকর্মীদের সুরক্ষা দেওয়াসহ কয়েকটি বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশ এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বাংলাদেশ উদারভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য তার দুয়ার খুলে দিয়েছে। কক্সবাজারের স্থানীয় মানুষ এবং বাংলাদেশ সরকার প্রথম তাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার আশ্রয় ও খাবার দিয়ে প্রথমেই তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
সেখানে পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। এবারের বর্ষায় বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। সেখানে শরণার্থীদের পাশে দেশি–বিদেশি সহায়তাকর্মীরা ছিলেন এবং এখনো আছেন। তাঁদের সহযোগিতার কারণে বড় ধরনের কোনো স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় ঘটেনি। গত জুলাইয়ে সফর করার সময় জাতিসংঘের মহাসচিব যেমনটি বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মহল যেভাবে সাড়া দিয়েছে, তা ‘অলৌকিক’। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে, তাদের জন্য একটি শ্রেয় ভবিষ্যতের আশা অটুট রাখতে, শরণার্থীদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠীর চাহিদাগুলোর প্রতি সাড়া দিতে, বাংলাদেশের কাঁধে যে বোঝা চেপেছে, তা লাঘব করতে এবং সংহতি প্রদর্শনের লক্ষ্যে আরও অনেক কিছু করতে হবে। এই দায়িত্ব সবার।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রাথমিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার মাইলফলক স্থাপনের জন্য প্রস্তুত। এই উত্তরণকে টেকসই করতে হলে বাংলাদেশকে তার বিদ্যমান ভঙ্গুরতাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন ও তার ১৭টি সুদূরপ্রসারী, গণমুখী, মানবাধিকারভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্য হলো, ‘কেউ পিছিয়ে থাকবে না’। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সুশাসন, জনগণের নাগরিক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমিতি–সংগঠন করার স্বাধীনতা, তথ্যপ্রাপ্তির স্বাধীনতা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে।
‘কেউ পিছিয়ে থাকবে না’—অঙ্গীকারের অর্থ হলো, সমাজের সব মানুষের জন্য ক্রমান্বয়ে এই সব লক্ষ্য পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য আরও পদক্ষেপ গ্রহণ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কেউ পিছিয়ে থাকবে না—অঙ্গীকারের অর্থ হলো, বিচিত্র মানুষের জ্ঞান, সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা।
কেউ পিছিয়ে থাকবে না—অঙ্গীকারের অর্থ হলো, গড়পড়তার মধ্য থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে নিয়ে কাজ শুরু করা:
* কন্যাশিশুদের পড়াশোনা শেষ করার আগেই জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়।
* প্রতিবন্ধী মেয়েদের নিরাপদ ও সম্মানজনক কাজের সুযোগ নেই।
* মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন।
* বাংলাদেশের যুবসমাজ এবং শরণার্থী যুবসমাজ উভয়েরই সমাজে অবদান রাখার মতো উৎপাদন সক্ষমতা আছে।
অনেকের মধ্যে এদের কণ্ঠস্বর অবশ্যই শুনতে হবে। পরিবর্তনের সক্রিয় অংশীদার হিসেবে তাদের ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা যখন নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত, তখন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য সংসদ নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শক্তিশালী ও টেকসই রাজনৈতিক ম্যান্ডেট নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ১৬–এর অন্যতম দিক।
জাতিসংঘের মহাসচিব, যিনি গত জুলাইতে বাংলাদেশ সফর করেছেন, তিনি জাতিসংঘে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্কার কর্মসূচি সূচনা করেছেন। এই সংস্কারের লক্ষ্য হলো আজকের সমস্যাসঙ্কুল বিশ্বে একটি বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা হিসেবে জাতিসংঘের অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত করা। দেশভিত্তিক পর্যায়ে এই সংস্কার কর্মসূচির লক্ষ্য হলো সংশ্লিষ্ট দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রয়াসে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সহযোগিতা জোরদার করা।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তথা যুবসমাজের উদ্দেশে কিছু কথা বলে আমি শেষ করতে চাই: বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে, আপনাদের কথা আমাদের শোনা প্রয়োজন, প্রয়োজন আপনাদের ক্ষমতায়িত করা। আমাদের আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে, আপনাদের জন্য কাজ করতে হবে।
সবার জন্য সমতা, বৈষম্যহীনতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রসহ সব ধরনের বৈশ্বিক লক্ষ্য, রীতিনীতি ও মানদণ্ড অর্জনে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে জাতিসংঘ প্রস্তুত রয়েছে।
আপনাদের অংশীদারত্ব এবং জাতিসংঘের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্থানীয় সরকার, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা; উন্নয়ন–সহযোগী, বেসরকারি সংস্থাসমূহ, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি খাতের যাঁরা আমাদের অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করে চলেছেন, তাঁদের সবার প্রতি আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। নানা সময় ‘আড্ডা’র মধ্য দিয়ে আপনারা আমাদের অনেক গঠনমূলক পরামর্শ দিয়েছেন এবং আমাদের কাজের মানোন্নয়নে সহায়তা করেছেন। বাংলাদেশে জাতিসংঘ মিশনে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে কর্মরত সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমাদের সঙ্গে আজ এখানে যাঁরা জাতিসংঘ দিবস উদ্যাপনে মিলিত হয়েছেন, সবাইকে ধন্যবাদ।
শুভ জাতিসংঘ দিবস।
মিয়া সেপ্পো ,বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী