মতামত

নির্বাচনী অঙ্ক মেলাতেই কি ত্রিপুরায় ‘বাংলাদেশ’-এর দরকার

বাংলাদেশের ঘটনায় ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো প্রতিবাদে ফেটে পড়ে, সেই ক্ষোভে ত্রিপুরায় সহিংসতা সৃষ্টি হয়
ছবি: এএফপি

ভারতে জাতীয় নির্বাচন হবে ২০২৪-এর শুরুতে। এ কারণে ২০২২ ও ২০২৩ সেখানে স্পর্শকাতর বছর। এই ২৪ মাসে বিভিন্ন রাজ্যে যেসব স্থানীয় নির্বাচন হবে, সেসব এখন জাতীয় নির্বাচনের কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনালের মতো মনোযোগ পাচ্ছে। এ তালিকায় আছে বৃহত্তর উত্তর প্রদেশ থেকে ক্ষুদ্র ত্রিপুরা পর্যন্ত, দশের অধিক রাজ্য।

৫৪৩ আসনের ভারতীয় লোকসভায় উত্তর প্রদেশের জন্য বরাদ্দ ৮০ আসন। ত্রিপুরার জন্য মাত্র দুটি। ত্রিপুরা এত ছোট জনপদ যে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত এলাকার আয়তনে দেশে এর অবস্থান ২৮তম। তারপরও এ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন হঠাৎ তুমুল উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করেছে কিছুদিন থেকে। যদিও সে নির্বাচন আসতে বহু সময় বাকি এখনো!

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর উপাত্তে উত্তর-পূর্ব ভারতের সব রাজ্যের মধ্যে সহিংসতায় ত্রিপুরা এক নম্বর পজিশন পেয়েছে ২০২০ সালে। এ বছর তাতে যুক্ত হয়ে গেল সংখ্যালঘু এলাকায় হামলা-সহিংসতা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কেন ত্রিপুরা এত গরম হলো? ভোটের আগে আগে কেন রাজ্যে সংখ্যালঘুদের নাস্তানাবুদ করার দরকার পড়ল?

ত্রিপুরার নির্বাচন যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ
মাত্র ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের রাজ্য হলেও ত্রিপুরার নির্বাচন তিন কারণে গুরুত্ব পাচ্ছে এবার। এই গুরুত্ব বাম-ডান-মধ্যপন্থী-আদিবাসী সবার কাছেই। বিজেপি গত নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেছে এ রাজ্যে। ৬০ আসনের বিধানসভায় শূন্য থেকে ৩৬ আসনে নিজেদের নিয়ে এসেছে তারা। ভোটের হিস্যা বেড়েছে ২ ভাগ থেকে প্রায় ৪০ ভাগে। অভাবনীয় উত্থান। এ অবস্থা থেকে পেছাতে চায় না তারা। তাদের মুরুব্বি সংগঠন আরএসএসের কাছে এই গুরুত্ব আরও বেশি।

উত্তর-পূর্ব ভারতের খ্রিস্টান হওয়া রুখতে ত্রিপুরা ও আসাম আরএসএসের কাছে হৃৎপিণ্ডের মতো। ২০১৮ সালে বিজেপি যে ত্রিপুরা জয় করতে পারল, সেটা আরএসএসেরই পরিশ্রমে। রাজ্যে প্রায় ১১০০ গ্রামে সরাসরি সংগঠন আছে তাদের (দ্য উইক, ৯ মার্চ ২০১৮)। ২৫ লাখ ভোটারের মধ্যে পাঁচ লাখের সঙ্গে রয়েছে জীবন্ত যোগাযোগ। এসব আরও বাড়াতে হলে বিজেপিকে প্রশাসনে রাখতেই হবে।

বহু ধর্ম ও বহু জাতির জায়গা ত্রিপুরায় দেশভাগের পর ইসলাম অনুসারীদের ওপর নিপীড়নের ইতিহাস নগণ্য। সেখানে এত দিন মারামারি হয়েছে ‘বাঙালি-পাহাড়ি’ সমীকরণে। বাঙালি হলেও মুসলমানেরা জাতিবাদী দাঙ্গায় সাধারণত প্যাভিলিয়নে বসে থাকে। তারপরও এবার বেছে বেছে তাদের পাড়াই জ্বলল।

আরএসএস-পরিবারের মতোই এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার প্রত্যাশায় আছে বামপন্থীরা এবং তৃণমূল কংগ্রেসও। বামেরা চাইছে যেকোনো মূল্যে হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে। ২০১৮-এর আগে ২৫ বছর তারা এখানে রাজত্ব করেছে। অন্যদিকে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে থিতু হয়ে ত্রিপুরা ও আসামে সংসার বাড়িয়ে মমতাকে জাতীয় নেত্রী বানাতে চায়। মুশকিলের দিক হলো বিজেপি, তৃণমূল ও বামপন্থী সবার মূল সাংগঠনিক লড়াই বেঁধেছে রাজ্যের বাংলাভাষীদের ঘিরে।

ভোটের গণিতে বাংলাদেশ কেন
ত্রিপুরা বিধানসভায় ৬০ আসন। তার মধ্যে ২০টি আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত। এসব আসনে প্রাধান্য থাকবে প্রদ্যোত দেববর্মার দল ‘তিপ্রা-মথা’র। পুরো রাজ্যের প্রায় ৩০ ভাগ ভোটার আদিবাসীরা। তাদের দিক থেকেও এবার নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক। অতীতের নানান বিভক্তি কাটিয়ে আদিবাসীরা রাজ্যের পুরোনো রাজপরিবারের যুবরাজ প্রদ্যোত দেববর্মার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ এবার। তাদের ‘তিপ্রা-মথা’যে নির্বাচনে ভালো করবে, সেটা ইতিমধ্যে স্পষ্ট। তিপ্রাদের নির্বাচনে ভালো করার মানে হলো বাঙালি ভোটব্যাংকে বিজেপি, তৃণমূল এবং বামদের নজর ও চাপ বেড়ে যাওয়া। রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ার মূল কারণ এটাই। সহিংসতার মূলে রাজ্যের অ-আদিবাসী ৭০ ভাগ ভোট এবং বিধানসভার ৪০টি অ-সংরক্ষিত আসন। এই ভোট ও আসনের মূল অংশ পেতে হবে তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস এবং বামদের মধ্যে যারা সরকার গড়তে চায় তাকে। ভোটের আগে-পরে এদের কারও সঙ্গে প্রদ্যোত দেববর্মার জোটও হবে। সেই সম্ভাবনায় এগিয়ে তৃণমূল। রাজ্যে মমতার দলের প্রতি বিজেপির আক্রমণাত্মক মনোভাবের মূল কারণ এটাই।

বামেরা রাজ্যে হারানো দুর্গ উদ্ধার করতে চাইলেও তাদের ভোটব্যাংক স্থির। বিজেপির আক্রমণেও অনেকখানি কাহিল তারা। জন-অরণ্যে বিজেপিবিরোধী সুনামি ঘটানো তাদের পক্ষে কঠিন। সেই তুলনায় বিজেপির ভয় মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলকে। তৃণমূল জানিয়েছে আগামী মাসে মমতা ত্রিপুরা যাবেন। মমতা এই সফরে বিজেপিবিরোধী তরঙ্গ তৈরি করতে চাইছেন। বিজেপি এই চ্যালেঞ্জ রোখার কাজে নেমেছে মমতার সফরের আগে আগেই। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক-সন্ত্রাস তাকে সাহায্য করেছে।

‘বাঙালি ভোটব্যাংক’ নিয়ে টানাপোড়েন
বিজেপি ত্রিপুরায় প্রায় চার বছর ক্ষমতায়। আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার বিষয়ে দলের ভেতর আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি রয়েছে। ক্ষমতায় এসে দলটি তিপ্রাদের ‘তিপ্রল্যান্ড’ দিতে পারেনি। বাঙালি বেকার তরুণদেরও কাজকর্মের সুযোগ বাড়েনি। দুই জাতের মধ্যেই বিজেপিকে নিয়ে হতাশা। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমারের ব্যক্তিগত ইমেজও ভালো নয়।

আগরতলায় গুঞ্জন আছে, এই মুখ্যমন্ত্রীকে পছন্দ নয় স্থানীয় বিজেপি নেতাদের অনেকের। এদের একাংশ মমতার দলে যুক্ত হতে পারে। এমএলএ আশিষ দাস এরই মধ্যে বিজেপি ছেড়ে ঘাসফুল শিবিরে যুক্ত হয়েছেন। এ রকম দলছুট এএলএ–র সংখ্যা আরও বাড়বে বলে প্রচার আছে। এ রকম ভাঙন রোধ করা এবং প্রায় চার বছর রাজ্য শাসনের হতাশা থেকে মানুষের মনোযোগ পাল্টাতে অপর দেশের ধর্মীয় ইস্যু দারুণ এক সুযোগ। গেরুয়া কর্মীরা সুযোগটি নিতে দেরি করেননি। এভাবেই কুমিল্লা ‘টক অব দ্য স্টেইট’ হয়েছিল ত্রিপুরায়।

তৃণমূল এবং তিপ্রা-মথার শক্তি বৃদ্ধিতে ত্রিপুরায় বিজেপি শিবির গত কয়েক মাস কোণঠাসা বোধ করছিল। রাজনীতিতে তাদের অবস্থান হয়ে পড়েছিল ‘আত্মরক্ষামূলক’। কুমিল্লা তাদের আত্মরক্ষা থেকে আক্রমণাত্মক অবস্থানে যেতে সাহায্য করেছে। সংখ্যালঘুদের ‘প্রতিপক্ষ’ দেখিয়ে বাঙালি ভোটব্যাংকের ভেতরকার বড় অংশকে সুখী করতে চেয়েছে তারা। অথচ ত্রিপুরায় মুসলমান জনসংখ্যা সামান্য। আট থেকে নয় ভাগের বেশি হবে না। এই ভোট অপর দলগুলোর বাক্সে গেলে বিজেপির বড় অঙ্কে ক্ষতি নেই যদি বাঙালি বাকি ভোট পদ্মফুলে আসে। সাম্প্রদায়িক–সন্ত্রাসের মাধ্যমে সংখ্যাগুরুকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে তৃপ্ত করার চেষ্টার গাণিতিক দিক এটাই। কিন্তু তার অর্থনৈতিক দিক খুব নির্মম। উত্তর ত্রিপুরায় বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের দোকানপাটের সর্বনাশ হয়েছে। এসব দৃশ্য বুঝতে সাহায্য করে ঘটনাবলির পেছনে স্বতঃস্ফূর্ততার অংশ কত সামান্য।

এ রাজ্যের গত কয়েক মাসের রাজনীতির দিকে নজর রাখলে দেখা যায় ‘তিপ্রা-মথা’র প্রদ্যোতকে ক্ষমতাসীনেরা বেশি চটাতে চাইছে না। কিন্তু বাঙালি শিবিরে কাউকে হাটে-মাঠে সভা করতে দেওয়া হয়নি। তৃণমূলের নেতাদের রাজ্যে ঢোকা কমাতে সম্প্রতি নিয়ম হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেউ এলে তাদের কোভিড পরীক্ষা করতেই হবে। এ রকম অবস্থার মাধ্যেই কিন্তু মন্দির-মসজিদের আবেগ নিয়ে অবলীলায় লম্বা মিছিল করে ফেললেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) কর্মীরা। প্রশাসন সহিংসতার দায় চাপাচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক আর টুইটারের ওপর। এটা মিথ্যা নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে আক্রমণের আগের কয়েক দিন সমাজকে তাঁতিয়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু তাতে প্রশাসন কেন সতর্ক হলো না, এর উত্তর মিলছে না। তবে ‘দায়’ যারই হোক সচেতন এই সহিংসতায় হিন্দু বাঙালিদের এক কাতারে আসার পাটাতন তৈরির কাজ বেশ গতি পেল। বাংলাভাষী অমুসলিম ভোটের বড় অংশ যদি বামফ্রন্ট ও তৃণমূলে ভাগ না হয়ে কেবল পদ্মফুলে থাকে, তাতে বিজেপিকে আরও পাঁচ বছর টিকে থাকতে সমস্যা হয় না।

বহুকাল ধরে ত্রিপুরায় বাংলাদেশকে কল্পিত এক প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখানোর রেওয়াজ আছে। রাজ্যে বাঙালিদের হিস্যা যত বাড়ছে, তত বাংলাদেশের দিকে আঙুল দেখানো জারি আছে। অর্থাৎ, বাঙালি বাড়া এবং আদিবাসীদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার দায় কেবল বাংলাদেশের! যদিও পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহারসহ আশপাশের ভারতীয় রাজ্যগুলোতে বাংলাভাষী অনেক; কিন্তু ত্রিপুরায় বাংলাভাষী বৃদ্ধির জন্য দোষারোপের ভাগিদার বরাবর বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের দরকার বাড়তি সতর্কতা
বহু ধর্ম ও বহু জাতির জায়গা ত্রিপুরায় দেশভাগের পর ইসলাম অনুসারীদের ওপর নিপীড়নের ইতিহাস নগণ্য। সেখানে এত দিন মারামারি হয়েছে ‘বাঙালি-পাহাড়ি’ সমীকরণে। বাঙালি হলেও মুসলমানেরা জাতিবাদী দাঙ্গায় সাধারণত প্যাভিলিয়নে বসে থাকে। তারপরও এবার বেছে বেছে তাদের পাড়াই জ্বলল। এ অধ্যায়ের কৌতূহলোদ্দীপক দিক ছিল, ঢাকায় কয়েক সপ্তাহ আগে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা চেয়ে অনেক জায়গায় ‘ভিএইচপি’ নামে যে পোস্টার দেখা গিয়েছিল, উত্তর ত্রিপুরায় একই নামের সংগঠনের মিছিল শেষেই সংখ্যালঘুদের প্রার্থনাগৃহে আগুন লাগে।

তবে ত্রিপুরায় এবারই প্রথম বাংলাদেশ রাজনৈতিক আলোচ্য বিষয় নয়। বহুকাল ধরে এখানে বাংলাদেশকে কল্পিত এক প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখানোর রেওয়াজ আছে। রাজ্যে বাঙালিদের হিস্যা যত বাড়ছে, তত বাংলাদেশের দিকে আঙুল দেখানো জারি আছে। অর্থাৎ, বাঙালি বাড়া এবং আদিবাসীদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার দায় কেবল বাংলাদেশের! যদিও পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহারসহ আশপাশের ভারতীয় রাজ্যগুলোতে বাংলাভাষী অনেক; কিন্তু ত্রিপুরায় বাংলাভাষী বৃদ্ধির জন্য দোষারোপের ভাগিদার বরাবর বাংলাদেশ। এত দিন বিভাজনের ওই রাজনীতি চলেছে হিন্দু-বাঙালি ও মুসলমান-বাঙালিকে একপক্ষে এবং তিপ্রাদের বিপরীত শিবিরে রেখে। এবার সেখানে ফাটল ধরিয়ে ছোট আরেকটি পক্ষ তৈরি করা হলো। এত দিনকার জাতিবাদী বিভাজনের জায়গায় এবার নতুন বিষবৃক্ষ হিসেবে চারা রোপিত হলো ধর্মবাদের। এই চারা থেকে ত্রিপুরায় কী গজাবে, সেটা এখনই বলা মুশকিল।

আগরতলায় বিবেকানন্দ স্টেডিয়ামে ডিসেম্বরে মমতার জনসভার জমায়েত থেকে বোঝা যাবে হাওয়া কোন দিকে কতটা এগোচ্ছে এ রাজ্যে। এর মধ্যে সহিংস পরিস্থিতিতেই রাজ্যে মিউনিসিপ্যাল ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হলো। নভেম্বরের এ ভোটে লড়বে তৃণমূলও। বাম ও বিজেপিও থাকবে লড়াইয়ে। আদিবাসীরাও প্রথমবারের মতো এই নির্বাচনে প্রার্থী দেবে বলে জানাচ্ছে। তাতে করে এ মাসেই ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমীকরণের মৃদু আঁচ পাওয়া যাবে ত্রিপুরায়। এ রকম সময়ে বাংলাদেশেরও দরকার বাড়তি সতর্কতা। দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িক-কূটকৌশল বন্ধে ভূমিকা রাখতে হবে ঢাকাকেও।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক