আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসি।
আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসি।

মতামত

নিরুত্তাপ কুমিল্লা সিটিতে যে কারণে হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া

মঙ্গলবার যখন কুমিল্লা পৌঁছাই, সবকিছু ছিল সুনসান। মেয়র ও কাউন্সিল প্রার্থীরা যাঁর যাঁর মতো করে প্রচার চালাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আইন মেনে তাঁরা বেলা দুইটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সভা-সমাবেশ করছেন। রাস্তায় যেতে দুই পাশে সারি সারি পোস্টার চোখে পড়ে। কোনো উত্তেজনা নাই।

এমনকি বুধবার যখন দুই প্রধান মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক ও মনিরুল হকের সঙ্গে তাঁদের বাসায় দেখা করি, তখনো কোনো উত্তাপ লক্ষ করা যায়নি। তাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছেন; ওই পর্যন্তই। রাতে হঠাৎ আওয়ামী লীগ শিবিরে ঝোড়ো হাওয়া। টিভিতে ও পত্রিকার অনলাইনে খবর ছড়িয়ে পড়ে, ইসি স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, তাঁকে এলাকা ছাড়তে হবে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত।

কয়েক দিন ধরেই বাহাউদ্দিন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক, অভিভাবক, শ্রমিক সংগঠন ও এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। যখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও সাবেক মেয়র মনিরুল হক ইসিতে সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ আনেন, তখনো তাঁরা বিষয়টিকে পাত্তা দেননি। ভাবতে পারেননি, গোটা কুমিল্লা শহর যাঁর কথায় চলে, তাঁকেই কিনা কুমিল্লা ত্যাগ করতে বলবে ইসি।

প্রথম আলো অনলাইনের খবরে বলা হয়, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসি। তাঁকে পাঠানো একটি চিঠিতে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।

যখন এ লেখা তৈরি করছি, তখন নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ নির্দেশনামা নিয়ে আওয়ামী শিবিরে চাপান-উতোর চলছিল। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিসে যোগাযোগ করলে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সংসদ সদস্যকে এলাকা ছাড়তে বলা হয়েছে। আমরা আশা করি, তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন।’

ইসির চিঠিতে বলা হয়, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কৌশলে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। ৭ জুন প্রথম আলো ও যুগান্তরে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন অত্যন্ত সুকৌশলে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করছেন, যা সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬-এর ২২ বিধির লঙ্ঘন। এ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে তদন্ত করানো হয়। এতে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। এ কারণে এই সংসদ সদস্যকে অবিলম্বে এলাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে ইসি।

পথসভায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী (নৌকা প্রতীক) আরফানুল হক

এর আগে নির্বাচন কমিশন সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিনকে সতর্ক করে বলেছিল, তিনি যেন নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়া থেকে বিরত থাকেন। নির্বাচন কমিশনের এ আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট রিট করেন বাহাউদ্দিন। কাকতালভাবে বুধবার রিটের প্রাথমিক শুনানিও হয়। সেই শুনানিতে বিচারপতি জাফর আহমদ ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের বেঞ্চ রুলনিশি জারি করেন। রুলনিশি জারির অর্থ, এ আদেশ যাঁরা জারি করেছেন, তাঁদের কাছে কারণ জানতে চাওয়া। যদিও সেই রুলনিশির দোহাই দিয়ে কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা প্রচার চালাতে থাকেন, দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাতে বাহাউদ্দিনের কোনো বাধা নেই। এরপরই সন্ধ্যায় ইসি থেকে সংসদ সদস্যকে এলাকা ছাড়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। বুধবার রাতেই রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস থেকে চিঠি সংসদ সদস্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, তথা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংসদ সদস্য ও সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রচার চালাতে পারবেন না।

বুধবার রাতে টেলিভিশনে খবরটি প্রচার হওয়ার পর থেকে কুমিল্লায় এটাই টক অব দ্য টাউন। বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা ও হতাশা লক্ষ করা যায়। কেননা, আরফানুল হক এই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন ঠিক; নির্বাচনের নেপথ্যের প্রধান চালিকা শক্তি স্থানীয় সংসদ সদস্য। তাঁর স্ত্রী-কন্যাও আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচার চালান। এই নির্বাচনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো পুরুষ প্রার্থী ও নেতাদের স্ত্রী-কন্যারাও ভোটারদের টানতে জোরেশোরে প্রচারে নেমেছেন।

চিঠি দেওয়ার পর ঢাকা ও কুমিল্লায় ইসি কার্যালয়ের অন্তত তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা বলেছেন, যেকোনো মূল্যে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা করা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ব্যক্তিবিশেষের জন্য নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হবে, তা তারা মেনে নেবেন না। রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিসও শক্ত অবস্থান আছে বলে প্রতীয়মান হয়। তারা সিটি করপোরেশনের তিন প্রার্থী, যথাক্রমে আরফানুল হক, মনিরুল হক ও মোহাম্মদ নিজামউদ্দিনকে জরিমানা করেছেন। এর মধ্যে নিজামউদ্দিনের জরিমানার পরিমাণ এক লাখ টাকার ওপর। ইসি প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। নির্বাচনী এলাকায় অন্তত ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেছেন, নির্বাচনের পরিবেশ মোটামুটি সুষ্ঠু আছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য হস্তক্ষেপ না করলে আরও সুষ্ঠু হতো।

স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী (টেবিল ঘড়ি প্রতীক) মনিরুল হকের গণসংযোগ

প্রায় সব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে থাকেন। আলাপ প্রসঙ্গে এক কর্মকর্তা বরিশাল অঞ্চলের একটি স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, একজন সংসদ সদস্যকে নির্বাচনী প্রচারণা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানালে তিনি ভীষণ খেপে যান এবং বলেন, আপনি জানেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন। জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, স্যার, আপনারা যে আইন তৈরি করেছেন, সেই আইন প্রতিপালন করা আমাদের দায়িত্ব। আইনে স্পষ্টভাবে সংসদ সদস্যের স্থানীয় নির্বাচনে প্রচার চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। আগে আপনারা আইনটি বদল করুন। তারপর আপনি নির্বাচনী প্রচার চালালে কেউ কিছু বলবে না। এবার বরিশালের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটল কুমিল্লায়।

এখন প্রশ্ন হলো, ইসির নির্দেশ মেনে কি বাহাউদ্দিন শহর ছাড়বেন, না নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাববেন? ১৫ তারিখের মধ্যে রুলনিশির নিষ্পত্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা মনে করেন, এটি তাঁদের নৈতিক বিজয়। যদিও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এক নেতা বলেছেন, ভোটের মাঠে এর কোনো প্রভাবই পড়বে না।

যখন এ লেখা তৈরি করছি, তখন নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ নির্দেশনামা নিয়ে আওয়ামী শিবিরে চাপান-উতোর চলছিল। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিসে যোগাযোগ করলে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সংসদ সদস্যকে এলাকা ছাড়তে বলা হয়েছে। আমরা আশা করি, তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন।’

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com