যে দেশে প্রায় এক–চতুর্থাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, সে দেশে ঈদ কখনোই সবার জন্য আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে না। করোনাকালে আরও বেশিসংখ্যক মানুষের ঈদের আনন্দ যে বিষাদে পরিণত হয়েছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। জীবনে যাদের হররোজ রোজা, তাদের জীবনে ঈদই বা কী, আনন্দই বা কী।
ঈদের আগে ঢাকা থেকে যে জনস্রোত গ্রামে ছুটে গিয়েছিল, তারা আবার ফিরতে শুরু করেছে। এই মানুষগুলোর করোনা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, স্বাস্থ্যবিধি না মানা ইত্যাদি নিয়ে আমরা ঢের সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু কেন তারা শহর ছেড়ে গ্রামে পালাতে চান, তা খতিয়ে দেখি না।
জোতজমি হারানো এই বিপন্ন মানুষগুলো ঢাকা বা অন্য কোনো শহরে আসেন কাজের খোঁজে, জীবিকার তাগিদে। সামান্য পয়সার জন্য তাঁরা অহোরাত্রি পরিশ্রম করেন। কিন্তু শহর তাঁদের কখনো আপন করে নেয় না। তাঁদের জীবিকা মানে দিনযাপনের গ্লানি। তাঁদের বাসস্থান মানে বস্তির ঝুপড়ি। এক ঘরে ৭–৮ জন গাদাগাদি করে থাকা। এ জীবন থেকে মুক্তি চাওয়া অপরাধ নয়। বরং যে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাঁদের এই জীবন যাপন করতে বাধ্য করছে, সেটাই অপরাধ। রাষ্ট্র বদল হলেই জীবন বদল হয় না। মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় না।
ঈদের আগে সরকার করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে আন্তজেলা গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়। সবাইকে কর্মস্থলে থাকার সুপরামর্শ দেয়। কিন্তু কোনো হুকুম কিংবা পরামর্শ তাঁদের আটকাতে পারেনি।
এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ৬৫ লাখ মানুষ ঈদের আগে ঢাকা ছেড়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও এই মানুষগুলো গেলেন কীভাবে? গেলেন পায়ে হেঁটে, রিকশা-ভ্যানে চড়ে, পণ্যবাহী ট্রাকে চেপে। উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষগুলো এভাবে দূরদূরান্তের পথ পাড়ি দিলেও দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীদের ফেরি পার হতে হয়েছে।
আর সেই ফেরিতেই ঘটেছে একের পর এক দুর্ঘটনা। ফেরি পার হতে গিয়ে পাঁচজন নারী-পুরুষ পদদলিত হয়ে মারা যান। ফেরি থেকে ছিটকে পড়া মাইক্রোবাসের চালকের লাশ ভেসে ওঠে দুদিন পর।
ঈদযাত্রার নামে এই অগুনতি মানুষের দুঃখ–দুর্দশা আমাদের ভদ্রলোক রাজনীতি কিংবা রাজনীতিকদের স্পর্শ করে না। সরকারি ও বিরোধী দলের রাজনীতির যাঁরা দিকপাল, তাঁদের কাছে পথেঘাটে–ফেরিতে-সড়কে বেঘোরে মানুষের মৃত্যু কোনো বিষয় নয়। তাঁরা একে অপরের ওপর দোষ চাপাতে ব্যস্ত।
স্বাভাবিক সময়ে আমরা দেখতাম, ঈদের দিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমাবেশ করে দলীয় সমর্থকদের উপস্থিতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজ নিজ দলের মহিমা কীর্তন করত। করোনাকালে সে রকম আয়োজন সম্ভব নয়।
তাই আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁদের কথা বলার জন্য সাংবাদিকদের ঘরে ডাকেন। বিএনপির নেতারা জিয়াউর রহমানের কবরস্থানে হাজির হন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার বলেন, ‘ঈদ বলতে আমরা সব সময় যেটা বুঝি, সেই ঈদ এক যুগ ধরে আমাদের নেই। নেতা-কর্মীদের হত্যা করা, গুম করা, মিথ্যা মামলা দেওয়া—এমন একটা অবস্থা, যেন এই দেশে শুধু আমাদের নেতা-কর্মীরাই আসামি।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি নেতা-কর্মীদের নাকি এক যুগ ধরে ঈদ নেই, তাদের হত্যা করা হচ্ছে এবং মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। আপনারা কি ভুলে গেছেন, ২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্মম নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছিলেন?’
ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপির আমলে মা-বাবা মারা গেলেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গ্রামের বাড়ি যেতে পারেননি। দাফন-কাফনের শেষ সুযোগটুকুও দেওয়া হয়নি। ঈদের নামাজ আদায়ের সময়ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
সরকার খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়ায় ঈদের দিন কয়েকটি স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রতিবাদ সমাবেশও করেছেন। বিএনপির এই সমালোচনা সরকারি দলের নেতারা কী করে মেনে নেন? তাঁরা দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়াকে জেলখানার বাইরে রেখে সরকার কতটা মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে, তা বিএনপির নেতাদের ফের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু তাঁরা এ কথা বলেন না যে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে সাবেক স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, নাজমুল হুদা, সাংসদ হাজি সেলিম জামিন পেলেও খালেদা জিয়া কেন পেলেন না? ঈদের সময় বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা নিগৃহীত হলে আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর একই শাস্তি নেমে আসাটা আইনের শাসনের অংশ কি না, সেই প্রশ্নও করা দরকার। একটি অন্যায় দিয়ে আরেকটি অন্যায়কে জায়েজ করার রাজনীতিই চলে আসছে স্বাধীনতার পর থেকে।
এই যে যে লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়ে, সহায়–সম্বল খুইয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ–কষ্টের মধ্যে আছেন, তাঁদের নিয়ে কোনো দলের তেমন মাথাব্যথা নেই। সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা এ–ও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোবাইলের মাধ্যমে হতদরিদ্র প্রতিটি পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে দিয়েছেন, যা অতীতের কোনো সরকার করেনি। প্রতি পরিবারের জন্য আড়াই হাজার টাকা।
গত বছর মে মাসেও আড়াই হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। এই পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটি পরিবার কত দিন চলতে পারে? যাদের আড়াই হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে, তারা না হয় পনেরো দিন বা এক মাস চলতে পারবে।
কিন্তু এর বাইরে যে লাখ লাখ গরিব মানুষ আছেন, তাঁরা কীভাবে চলবেন? ঈদের দিনে বিএনপি প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে খালেদা জিয়ার জন্য।
আর পরিবহনশ্রমিকেরা সমাবেশ করেছেন অবিলম্বে গণপরিবহন চালু করার দাবিতে। এই শ্রমিকেরা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন, পরিবারের সদস্যদের কাছে তাঁরা মুখ দেখাতে পারছেন না। স্ত্রী–সন্তান অভুক্ত থাকলে কীভাবে মুখ দেখাবেন? কেবল গণপরিবহন শ্রমিকেরা নন। লঞ্চ শ্রমিক, হোটেল শ্রমিকদের অবস্থা আরও শোচনীয়। আক্ষরিক অর্থেই তাঁরা পথে বসেছেন।
কিন্তু আমাদের ভদ্রলোক রাজনীতির দিকপালেরা এঁদের নিয়ে ভাবেন না। করোনাকালেও তাঁরা একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চান। কোন সরকারের আমলে নির্যাতনের স্টিম রোলার চলেছে, কোন সরকার ফ্যাসিস্ট কায়দায় দেশ চালাচ্ছে, তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন। মানুষ সব সময় সামনে হাঁটে। কিন্তু আমাদের রাজনীতি বরাবর ভূতের মতো পেছনে চলতেই পছন্দ করে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম–সম্পাদক, কবি
sohrabhassan55@gmail.com