খোলা চোখে

নিরপেক্ষ নির্বাচন কেন জরুরি

নিরপেক্ষ নির্বাচন কেন জরুরি? এই প্রশ্নের জবাবের জন্য আজকের কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের দিকে তাকানো যাক।

কেনিয়ায় গত আগস্টে একবার নির্বাচন হয়, কিন্তু তাতে যে কারচুপি হয়েছে, তা হাতেনাতে ধরা পড়ার পর সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট সেই নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেন। ভোটের ব্যবস্থায় সমস্যা আছে—কোর্ট থেকে এ কথা বলা হলেও তা শোধরাতে সরকার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই এই নির্বাচন অর্থহীন—এই যুক্তি দেখিয়ে প্রধান বিরোধী দল অক্টোবরের পুনর্নির্বাচন বয়কট করে। খালি মাঠে একা গোল করার সুযোগ পেয়ে সেই পুনর্নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী উহুরু কেনিয়াত্তা ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন। বলা বাহুল্য, বিরোধীপক্ষ সেই ফলাফল মানতে রাজি নয়। তাই এক মাস পরও নির্বাচনের প্রশ্নে কেনিয়ায় রাজনৈতিক অশান্তি থামছে না। ইতিমধ্যে প্রায় ৪০ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। এই অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির ওপর, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়।

অন্যদিকে জিম্বাবুয়েতে ৯৩ বছরের এক বৃদ্ধ নেতা প্রায় ৪০ বছর ধরে ক্ষমতা দখল করে আছেন। সেনাবাহিনী তঁার হাতে, পুলিশ তঁার মুঠোয়, ফলে তিনি নির্বাচনের ফল যেমন খুশি তেমন করেছেন। ইতিমধ্যে দুর্নীতি হয়েছে আকাশচুম্বী, দেশের অর্থনীতি পৌঁছেছে তলানিতে। হাতে আর বেশি সময় নেই, টের পেয়ে নিজের বউকে প্রেসিডেন্টের পদটি দেওয়ার পঁায়তারা করছিলেন, সে কথা টের পেয়ে দেশের সেনাবাহিনী বিগড়ে গিয়ে তঁাকে গৃহবন্দী করে। নিজের দল থেকেও তঁাকে বহিষ্কার করা হয়, কিন্তু তারপরও তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়তে রাজি না হওয়ায় জিম্বাবুয়ে এক মহা সংকটে পড়েছে।

নির্বাচন দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও কোনো কোনো নেতা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকেন। এতে দেশের অর্থনীতি গোল্লায় যাক, সেদিকে তঁাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। রাজনৈতিক প্রতিবাদে মানুষ হতাহত হচ্ছে, সেদিকেও কোনো হেলদোল নেই। পূর্ব আফ্রিকার আরেক দেশ গাম্বিয়ার কথা ধরুন। সেখানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জামেহ আড়াই দশক ক্ষমতা দখল করে থাকার পর গত বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচনে পরাজিত হন। প্রথমে সেই ফল তিনি মেনে নেন, কিন্তু আট দিনের মাথায় মত পরিবর্তন করে জানালেন যে তিনি ক্ষমতা ছাড়ছেন না। কোনো যুক্তি নেই, কোনো কারণ নেই। এ নিয়ে মহা তোলপাড়, অনেক রক্তপাত, আন্তমহাদেশীয় উত্তেজনা। অবশেষে দেড় মাসের নাটক শেষে এ বছরের জানুয়ারিতে তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। শোনা যায়, তিনি সঙ্গে করে কয়েক বাক্স মার্কিন ডলার নিয়ে চম্পট দিয়েছেন।

এই তিন উদাহরণ থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট। যেসব নেতা দেশের ভালো–মন্দের বদলে ব্যক্তিগত স্বার্থকেই সবার ওপরে স্থান দেন, তঁারা যা–ই হোক, নিজের দেশকে ভালোবাসেন না। দেশের মানুষকে তো নয়ই। দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কারণে তঁাদের চারপাশে এত বিস্তর আগাছা গজিয়ে ওঠে যে কখনো কখনো নিজেরা না চাইলেও তঁাদের এসব আগাছার চাপে ভুল পথটাই বেছে নিতে হয়।

আবার সেই জিম্বাবুয়ের উদাহরণটাই বিবেচনা করুন। রবার্ট মুগাবে সে দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের একজন প্রধান নেতা। শুধু নিজের দেশে নয়, সারা আফ্রিকাতেই তঁাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান করা হয়। ৪০ বছরে দেশটাকে মুড়ির ঠোঙা বানিয়ে ফেলেছেন, তা সত্ত্বেও মানুষ তঁাকে কমবেশি সহ্য করে চলেছে। নব্বই পেরিয়েছেন, আর কত? একসময় তো স্বাভাবিক নিয়মে তঁাকে চলে যেতেই হবে, এই ছিল সবার যুক্তি। কিন্তু মুগাবের ৫৩ বছরের স্ত্রী গ্রেস ভাবলেন, স্বামীর মৃত্যু হলে তঁার কী অবস্থা হবে? তিনি তো গাড্ডায় পড়ে যাবেন। গরিব দেশের ফার্স্ট লেডি হলে কী হবে, বিলাসিতায় তিনি ফরাসি সম্রাজ্ঞী মারি আঁতোয়ানেতকেও হার মানান। অতএব, তিনি নিজের কিছু তঁাবেদার নিয়ে ঠিক করলেন বুড়ো টেসে গেলে প্রেসিডেন্টের চেয়ারখানা তিনিই দখল করবেন। সেই পরিকল্পনা মাথায় রেখে বুড়োকে রাজি করিয়ে তঁার ভাইস প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে নিজে সেখানে বসার আয়োজন করলেন। সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটল তখনই।

আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি প্রধান উপাদান এ কারণে যে সামরিক অভ্যুত্থানের মতো অশাসনতান্ত্রিক পথ অনুসরণ না করে দেশের মানুষ নিজেরাই কোনো অদক্ষ-অযোগ্য সরকারকে সরিয়ে সেখানে নিজেদের পছন্দমতো সরকার নির্বাচন করতে পারে। বুর্জোয়া ব্যবস্থা বলে পশ্চিমা গণতন্ত্রকে আমরা যত গালমন্দ করি না কেন, এটাই একমাত্র ব্যবস্থা, যেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে সাধারণ মানুষের। নানাভাবে সেই ক্ষমতা নস্যাতের চেষ্টা হয় বটে, কিন্তু বল যে শেষ পর্যন্ত সাধারণ ভোটারদের হাতেই, এ নিয়ে তর্ক নেই।

লক্ষ করুন, পৃথিবীর যেসব দেশে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল হয় না, তাদের অধিকাংশই তৃতীয় বিশ্বে, তাদের সিংহভাগই দরিদ্র, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অনুন্নত। তারা সামনে এগোনোর বদলে ক্রমাগত পিছে হটতে থাকে। কোনো দেশকে টেনে পিছে নামাতে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারই যথেষ্ট, কিন্তু শুধু সরকারের একার চেষ্টায় কোনো দেশ আগায় না। এ জন্য চাই জনসাধারণের অংশগ্রহণ। জনগণ যদি নিজের দেশের ও সরকারের ব্যাপারে তাদের কোনো মালিকানা বা ওনারশিপ রয়েছে, এ কথা বিশ্বাস না করে, তাহলে তারা সেই চেষ্টায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবে কেন? শুধু বন্দুকের নল দেখিয়ে অথবা জেল-জুলুমের ভয় দেখিয়ে দেশকে খুব বেশি দূর সামনে আগানো যায় না।

স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থা যে জরুরি তার অপর কারণ, একমাত্র এই মাধ্যমেই উন্মুক্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অর্জন সম্ভব। দেশের সব বৈধ রাজনৈতিক মতের ও দলের এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অর্থপূর্ণ হয়। এই প্রক্রিয়া অর্থপূর্ণ করার প্রধান দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের। তারাই নির্বাচনের আয়োজন করে, সেই নির্বাচন পরিচালনা করে। অতএব, নির্বাচন যাতে স্বচ্ছ হয়, এর দায়ভার তো তাদের ঘাড়েই। কেনিয়ার কথা ভাবুন। নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে—দেশের সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দেওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন মহলের তরফ থেকে সেই অনিয়ম মোকাবিলার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় বিরোধী নেতা রাইলা ওডিঙ্গা যদি বলেন, এমন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কী লাভ? নির্বাচনের ফলাফল তো আগে থেকেই স্থির হয়ে আছে।

অবশ্য পাল্টা যুক্তিও আছে। নির্বাচনে কোনোভাবেই তারা জিতবে না—এই ধারণা থেকে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নানা ছুতোয় নির্বাচন বয়কটের পঁায়তারা করে থাকে। এই অবস্থায় ‘বাবা, এসো এসো’ বলে যত চেঁচানো হোক না কেন, তারা নির্বাচন বয়কট করেই যাবে। তবে এই লক্ষণটা বেশি দেখা যায় ছোট ছোট অতি বাম বা অতি ডান দলগুলোর মধ্যে। বড় দল, যাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্রধান লক্ষ্য কোনো না কোনো উপায়ে ক্ষমতার ভাগীদার হওয়া, তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে অংশ নেবে, সেটাই স্বাভাবিক।

ধান ভানতে শিবের এই গীত হলো তার কারণ বাংলাদেশেও এখন গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। নির্বাচন নিরপেক্ষ না হলে কী হয়, তার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি, তাই সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, নির্বাচন-উত্তর সহিংসতায় ২০১৫ সালের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২২০ কোটি ডলার। এই ক্ষতিটা শুধু অর্থের অঙ্কে বোঝা যাবে না। দেশ যদি রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হয়, তাহলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দেয় অনাস্থা ও অনাগ্রহ। বাংলাদেশকে যদি একটা ব্র্যান্ড হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে বিনিয়োগকারীদের চোখে তা হয়ে পড়ে কীটদষ্ট। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি দেশের মানুষের। নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা হারিয়ে তারা হয়ে পড়ে হতাশ, নিজের দেশের ব্যাপারে অনাগ্রহী।

আমরা কেউ চাই না সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। কেনিয়া বা জিম্বাবুয়ের মতো ঘটনা ঘটুক, তা-ও আমরা চাই না। এ অবস্থা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। যঁারা ক্ষমতার এপারে অথবা ওপারে দঁাড়িয়ে আছেন, তঁারা যদি শুধু নিজেদের আরামকেদারাখানা ভালো না বেসে দেশটাকেও কিছুটা ভালোবাসেন, তাহলে দেশের মানুষ তঁাদের মাথায় নিয়ে নাচবে।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।