আড়াই হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হলো। শিক্ষা কার্যক্রমে জমে থাকা একটা জট খুলল। অনেক কাঠখড় পুড়েই তবে খুলল। যদিও অধিকাংশ শিক্ষক এখানে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগপ্রাপ্ত আছেন। প্রয়োজনীয় ডোনেশন বা অনুদান দিয়ে অনেকের এই নিয়োগপ্রাপ্তি ঘটেছে। নিন্দুকেরা বলেন, এসব নিয়োগ প্রকৃত অর্থে বেকার পুনর্বাসন মাত্র। বেকারত্ব মোচন করাও রাষ্ট্রেরই কর্তব্য। কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষা শিক্ষার্থীদের ভাগে কতটা জুটবে, সে আরেক প্রশ্ন। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় অনুদান ও যোগাযোগ না থাকায় ১-১২তম ব্যাচের ১৭ হাজার নিবন্ধন সনদধারী শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হতে পারছেন না। তাঁদের ১৬৬টি গ্রুপ বিভিন্ন সময় হাইকোর্টে রিট করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট তাঁর রায়ে ৭টি অনুচ্ছেদে এনটিআরসিএকে একটি গাইড লাইন দেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে এনটিআরসিএ পরবর্তী পরীক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটায়। মেধাতালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু সংক্ষুব্ধ রিটকারীদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় এনটিআরসিএ রিটকারীদের ব্যাপারে নীরবতা পালন করে যাচ্ছেন। ফলে সংক্ষুব্ধ রিটকারীগণ পুনরায় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
বিচারপতি মোহাম্মদ উল্যাহ ও কাজী রেজাউল হকের একটি বেঞ্চ যে ৭টি নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সংক্ষেপে সেগুলো হচ্ছে: নিবন্ধন সনদপ্রাপ্তি সময়সীমা ও বিষয়ভিত্তিক পদশূন্য সাপেক্ষে সনদ প্রদান; ৯০ দিনের মধ্যে সমন্বিত মেধাতালিকা প্রকাশ করা ও সেই মেধাতালিকা অনুসারে উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় শূন্যপদ থাকলে সেখানে নিয়োগ দেওয়া; প্রতিবছর এই মেধাতালিকা হালনাগাদ করা; এনটিআরসিএ সরাসরি নিয়োগের প্রস্তাব পাঠাবে রিটকারী ও অন্যান্য প্রত্যাশী প্রার্থীদের পদ শূন্য সাপেক্ষে জাতীয় মেধাতালিকা অনুসারে সনদ ইস্যু করা এবং নিজ এলাকায় বদলিকে সম্মান জানান; ৬০ দিনের মধ্যে ম্যানেজিং কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া এবং এর অন্যথা হলে ম্যানেজিং কমিটিকে বিলুপ্ত করা; এবং চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে একটি যথাযথ বয়সসীমা নির্ধারণ করা।
এই গাইড লাইন অনুসারে এনটিআরসিএ ৩৫-ঊর্ধ্বদের চাকরিতে প্রবেশের অনুপযুক্ত ঘোষণা করে। পরে হাইকোর্টের আরেকটি রায়ে ১-১২তমদের ক্ষেত্রে বয়সসীমা উঠিয়ে দেয়। তাও ১-১২তমদের রিট করেই সম্পন্ন হলো। এনটিআরসিএর প্রতিটি সিদ্ধান্ত যদি নিবন্ধন সনদধারীদের কোর্টের মাধ্যমে আদায় করে দিতে হয়, তাহলে আর তাঁদের রাখা কেন?
সংক্ষুব্ধ হিসেবে রিটকারী গ্রুপগুলো বলছে, তাদের সময় মেধাতালিকার ধারাটি না থাকায় এবং শুধু ন্যূনতম ৪০ নম্বরই যোগ্য বিবেচনার মানদণ্ড হওয়ায়, তারা অধিক নম্বরপ্রাপ্তির দিকে নজর দেয়নি। রিটকারী ১৭ হাজার নিবন্ধনধারী মনে করেন, তাঁরা এনটিআরসিএ কর্তৃক প্রতারিত হয়েছেন। অন্যদিকে তাঁদের রিটের কারণেই বিষয়টা একটা শৃঙ্খলার মধ্যে এসেছে। এখন নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থী মাত্রই সরাসরি নিয়োগ পাচ্ছেন। কিন্তু যে নিবন্ধনধারীদের কারণে এনটিআরসিএর শৃঙ্খলায় ফেরা, তাঁরাই আজ দিকহারা।
২.
বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগুলোতে ৬৬ হাজারের মতো জাল সনদধারী আছেন বলে প্রচার আছে। দুদকের বিভিন্ন অভিযানে সেই সত্যতাও মিলছে। তা ছাড়া নতুন-পুরোনো এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো মিলেও একই সংখ্যা দাঁড়াবে। ফলে একদিকে লাখ লাখ পদ শূন্য থাকছে, অন্যদিকে সনদ বগলে নিয়ে কোর্টের বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন ১৭ হাজার মেধাবী।
অতীতে সরকারি বিদ্যালয়ে ‘পুল শিক্ষকে’রা স্থায়ীভাবে নিয়োগ পেয়েছেন, রেজিস্টার্ড স্কুলের শিক্ষকেরা লিখিত পরীক্ষা পাস করেই নিয়োগ পেয়েছেন। সরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে এ এক বিরল ঘটনা। কিন্তু ১৭ হাজার রিটকারী নিবন্ধনধারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এনটিআরসিএকে নিয়মের মধ্যে আনলেন তাঁরা, কিন্তু নিজেদেরই ঘর আজ অন্ধকার।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) চার নম্বরটি হচ্ছে শিক্ষাবিষয়ক। সেখানে ৭টি সূচক অর্জনের টার্গেট ঠিক করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, ‘আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সব বালক-বালিকা যাতে ফ্রি, বৈষম্যহীন ও মানসম্মত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত সমাপ্ত করতে পারে এবং প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর শিখনফল অর্জন করে, তা নিশ্চিত করা।’ যোগ্য তরুণেরা যখন চাকরির আশায় ছয়-সাত বছর ধরে কোর্টের বারান্দায় ঘুরে বেড়ান, তখন কি টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে?
নাহিদ হাসান: শিক্ষক ও সামাজিক সংগঠক
nahidknowledge@gmail.com