বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষাশেষি নির্মিত হয়েছিল রুশ পরিচালক মিখাইল কোজিনৎসভের হ্যামলেট। সাদা-কালোয় নির্মিত এই ছবির অনেক দৃশ্যের চিত্রায়ণ ছিল অসাধারণ, যেমন পাথুরে সমুদ্র-উপকূলে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের সামনে বসে থাকা হ্যামলেটের স্বগতোক্তি, টু বি অর নট টু বি, ফুটে উঠেছিল গভীর ব্যঞ্জনা নিয়ে সর্বকালের মানুষের জীবনে আলোড়িত জিজ্ঞাসা উত্থাপনে। পূর্ববাংলার মানুষ তখন কাটিয়ে উঠতে চাইছে দ্বিধা, প্রত্যয়ী হয়ে উঠছে টু টেক আর্মস অ্যাগেইনস্ট এ সি অব ট্রাবলস, বিপদ-বাধা উপেক্ষা করে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রে তরি ভাসাতে উদ্গ্রীব। তরি তারা ভাসিয়েছিল এবং যে তরণির কান্ডারি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীনতার পর মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক-রাজনীতিক হীরেণ মুখার্জি এই ঘটনাধারা চিহ্নিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঙ্ক্তি ধার করে, ‘দেখি নাই কভু দেখি নাই আহা, এমন তরণী বাওয়া’।
বিশ্বব্যবস্থা তথা ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির কাছে বাংলাদেশ ছিল এক ধন্দ, তৃতীয় দুনিয়ার দরিদ্র পশ্চাৎপদ ভূখণ্ডের মানুষ কীভাবে বিশ্বের পরাক্রমী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ দৃঢ়পণ লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনল যুদ্ধের ময়দানে, সে এক অবাক করা ঘটনা। ফলে বাংলাদেশের উত্থান মান্য করা শক্তিধরদের জন্য সহজ ছিল না। সে জন্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অন্ত ছিল না তাদের। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রবেশের অধিকার পেয়েছিল ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে, একাত্তরের সুমহান বিজয়ের প্রায় তিন বছর পর। বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি প্রদান ও বিচারানুষ্ঠানের জন্য বিশ্বসমাজ তখন প্রস্তুত ছিল না, আন্তর্জাতিক কোনো প্ল্যাটফর্ম বা উদ্যোগ ছিল না, যেখানে জেনোসাইডের শিকার রক্তাপ্লুত জাতি বিচারের দাবি নিয়ে হাজির হতে পারে। বিশ্বসমাজের এই উদ্যোগহীনতার কালে বাংলাদেশ স্বীয় প্রচেষ্টায় প্রণয়ন করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ তথা জেনোসাইড, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইন। সদ্য-প্রণীত সংবিধানে প্রথম সংশোধনী এনে এই আইনকে সংবিধানের অংশ হিসেবে পরিগণিত করা হলো যেন প্রচলিত ফৌজদারি কিংবা অন্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্টই মান্য বিবেচিত হতে পারে এবং হবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যাত্রা শুরু করেছিল সত্তরের দশকে, যখন মানবাধিকার রক্ষায় মানবিক উদ্যোগ বলতে কোনো সংস্থা অথবা সম্মিলিত প্রয়াস বিশেষ ছিল না। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন থেকে জন্ম নিয়েছিল আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ সামাজিক শক্তি, যার ফলে জন্ম নেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার রক্ষায় ব্রতী সংগঠন, যারা পক্ষপাতমুক্তভাবে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ভূমিকা নিতে শুরু করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা এআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন শন ম্যাকব্রাইড, আয়ারল্যান্ডের মুক্তি আন্দোলনের প্রেরণাদীপ্ত ব্যক্তিত্ব। তিনি আইনজীবী হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, তাঁর মামলা লড়ার জন্য শন ম্যাকব্রাইড উদ্যোগী হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে বাংলাদেশে মানবাধিকারের চরম বরখেলাপ ঘটে এবং বিচারের প্রহসন ঘটিয়ে গোপন সামরিক আদালতে সংক্ষিপ্ত শুনানির পর সন্দেহভাজন সামরিক অফিসার ও সৈনিকদের পাইকারি হারে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এই ঘটনায় শন ম্যাকব্রাইড বিশেষভাবে পীড়িত হয়েছিলেন এবং ওই বৃদ্ধ বয়সে ঢাকা এসে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পরে লন্ডন ফিরে সহকর্মীদের কাছে তাঁর ঢাকার অভিজ্ঞতা তিনি মেলে ধরেছিলেন। শন ম্যাকব্রাইডের ব্রিটিশ যে সহকর্মীর কাছ থেকে এই ঘটনার কথা জেনেছিলাম, তাঁর নাম এখানে ঊহ্যই রাখলাম। তিনি জানান, ওই বয়সেও যে শন ঢাকা ছুটে গিয়েছিলেন ফাঁসিতে বহু মানুষের জীবন হরণ ঠেকাতে, তার পেছনে ছিল ব্যক্তিগত এক দুঃখ-অভিজ্ঞতা, শন ম্যাকব্রাইডের পিতামহ ছিলেন আইরিশ বিপ্লবী, ফাঁসিকাষ্ঠে তাঁর জীবনাবসান ঘটেছিল। জেনারেল জিয়ার সঙ্গে শন ম্যাকব্রাইডের একান্ত সাক্ষাৎ ঘটেছিল মধ্যরাতের পর, অনেক কথা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে। কেমন মনে হয়েছিল জেনারেল জিয়াকে, এমন প্রশ্নের উত্তরে শন ম্যাকব্রাইড জানিয়েছিলেন, জেনারেল জিয়াকে তাঁর মনে হয়েছিল যেন রাজা ম্যাকবেথ, স্মেলিং ডেথ অল অ্যারাউন্ড হিম। যে কারণেই হোক এই সাক্ষাতের পর ঢালাও ফাঁসিদান বন্ধ হয়েছিল। আর মৃত্যুগন্ধ অচিরেই সর্বগ্রাসী হয়ে আলিঙ্গন করেছিল জেনারেল জিয়াকে, ম্যাকবেথের মতোই।
দুই.
বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটনের জন্য দায়ী এ দেশীয় সহযোগীরা দীর্ঘকাল ধরে ছিল আইনের আওতার বাইরে, তারা জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল বিচার থেকে অব্যাহতি, ফোর্সড ইমপিনিউটি। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা এবং এর বিরুদ্ধে জাতির যে দীর্ঘ সংগ্রাম তার কোনো পর্বেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে সহায়তা অথবা বক্তৃতা-বিবৃতি পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনী রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ আবার বিচারের শক্তি ফিরে পেল, স্বীকৃত হলো বিচারের অধিকার এবং ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু হলো বিচার-প্রক্রিয়া। সেই সঙ্গে শুরু হলো অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ধারাবাহিক বিবৃতি প্রদান, যার মোদ্দাকথা গণহত্যার বিচারে বাংলাদেশের উদ্যোগ চ্যালেঞ্জ ও প্রশ্নবিদ্ধ করা, অভিযুক্তদের রক্ষা করা। তাদের এই একাদিক্রম ও একনিষ্ঠ প্রয়াসের সর্বশেষ উদাহরণ ২৭ অক্টোবর ২০১৫ প্রদত্ত বিবৃতি, যেখানে ফাঁসির দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত গণহত্যাকারী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বাঁচাতে নিজেদের ভূমিকা অ্যামনেস্টি উন্মোচন করে এবং মহৎ আদর্শের পতাকাবাহী এক আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মান ধুলোয় নামিয়ে দেয়।
এলসিনোর দুর্গপ্রাকারে হেঁটে হেঁটে বই পড়ছিলেন হ্যামলেট, কী পড়ছেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, শব্দ, শব্দ আর শব্দ। শব্দ দিয়েই বোঝা যায় বইয়ের অন্তর্নিহিত নির্যাস। একই কথা অ্যামনেস্টির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই বিবৃতির ভাষ্য ও শব্দ ব্যবহার থেকেই তাদের ভূমিকা প্রকাশ পায়, যার কিছু উদাহরণ এখানে পেশ করা যেতে পারে। একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য অভিযুক্তদের অ্যামনেস্টি সর্বদা পরিচিত করে এসেছে ‘ইসলামি নেতা’ হিসেবে। ঘৃণ্য অপরাধে অভিযুক্তরা এমন অভিধা লাভের যোগ্য কি না, সেই প্রশ্নের বাইরেও থাকে প্রচলিত রীতির প্রশ্ন, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ব্যক্তিরা গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত হিসেবেই গণ্য, বিচারে অপরাধ প্রমাণিত হলে তাঁরা ‘গণহত্যাকারী’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যবসায়ী, নাকি কলেজশিক্ষক, নাকি ওয়াজ-নসিহতকারী, নাকি জমির দালাল, নাকি দ্বিতীয়বার দার-পরিগ্রহণকারী—এসব পরিচয় তো অবান্তর। সেই অবান্তর পরিচিতি অ্যামনেস্টির কাছে হয়েছে গুরুতর এবং তার চেয়েও বড়ভাবে তারা হয়েছে কেবল রাজনীতিক নেতা নন, ইসলামি রাজনৈতিক নেতা। তবে সাকা ও মুজাহিদের ক্ষেত্রে অন্তত সাকাকে ‘ইসলামি রাজনীতিবিদ’ বলা অ্যামনেস্টির পক্ষেও দুষ্কর হয়েছিল, আর তাই এবারের বিবৃতিতে তাদের বলা হয়েছে ‘বিরোধী নেতা’, কখনোই গণহত্যার দায় বহনকারী নয়।
বিবৃতিতে সেই গৎবাঁধা অভিযোগ অ্যামনেস্টি আবারও উত্থাপন করেছে যে, বাংলাদেশের বিচার আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হচ্ছে না, তবে এবারও আন্তর্জাতিক মান বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, কোথায় মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে সেটা তারা কখনো বিশদ করেনি। সম্প্রতি আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কার্যক্রম নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, এই আদালত বিচার পরিচালনায় যে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে তার ফলে বিচারের বাণী অনেক ক্ষেত্রে নিভৃতে কেঁদে ফিরছে। আরও যেসব ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে আইসিসি, সেই তালিকা দীর্ঘ। বড় অভিযোগ উঠেছে যে, আইসিসি আফ্রিকা-দুষ্ট, তারা এই মহাদেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অপরাধের আর কোনো নিদর্শন খুঁজে পাচ্ছে না। জাতিসংঘের সম্পৃক্তিতে প্রতিষ্ঠিত ক্যাম্বোডীয় আদালতের জটিলতাও কম নয়। সেখানে সময় ও অর্থ দুইয়েরই শ্রাদ্ধ ঘটছে, বিচার কবে শেষ হবে কেউ সঠিক বলতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক আদালতের তুলনায় যখন বাংলাদেশের অপরাধ আদালত অনেক কার্যকরভাবে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিচার সম্পন্ন করছে, তখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যে অবস্থান নিয়েছে তা গর্হিত অপরাধ এবং এর জন্য জবাবদিহি তাদের করতে হবে।
সবচেয়ে বড় যে অন্যায় অ্যামনেস্টি ধারাবাহিকভাবে করে চলেছে তা একাত্তরে বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত জেনোসাইড ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ অস্বীকার করা। জেনোসাইড অস্বীকার করার প্রবণতা গণহত্যার ঘটনার অঙ্গাঙ্গি অংশ। জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরি স্ট্যানটন গণহত্যার যে ধাপগুলো চিহ্নিত করেছিলেন, তার সর্বশেষ সোপান হচ্ছে গণহত্যার অস্বীকৃতি। গণহত্যাকারীরা তাদের বর্বরতা নানাভাবে আড়াল করতে চাইবে সেটা বোধগম্য, তবে এর চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে জেনোসাইড ডিনাইয়াল একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া এবং দেখা যায় পরবর্তী যুগে এসে এই অস্বীকৃতির রূপবদল ঘটে। খুব আগ্রহোদ্দীপকভাবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের বিবৃতিতে সচেতনভাবে কখনো ‘জেনোসাইড’ এবং ‘ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেনি। ২৭ অক্টোবরের বিবৃতিতে একাত্তরের গণহত্যাকে তারা অভিহিত করেছে নিছক ‘স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সংঘটিত অপরাধ’ হিসেবে, অপরাধের ধরন যে ‘ক্রাইম অব দ্য ক্রাইমস’ বা মানবজাতিকে স্তম্ভিত করে দেওয়া নিষ্ঠুরতা, সেটা স্বীকার করতে অ্যামনেস্টি সদা কুণ্ঠিত। বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি নিরপেক্ষতার ভান করে বলেছে, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধকালে সংঘটিত অপরাধ ছিল ভয়ংকর (হোরিফিক), তবে মৃত্যুদণ্ড ভায়োলেন্সের আবর্তন তৈরি করবে।’ এখানেও অপরাধকে ভয়ংকর বলা হয়েছে, কিন্তু ‘জেনোসাইড’ বলাটা নৈবচ নৈবচ।
তারা বিবৃতিতে যেসব শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছে, যে-ভাষায় একাত্তরের ইতিহাস বিবৃত করেছে, কেবল সে দিকটাতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেও আমরা জেনোসাইড অস্বীকৃতির নিষ্ঠুর আচরণ লক্ষ করে স্তম্ভিত না হয়ে পারি না। একবারই কেবল অ্যামনেস্টি আইসিটি-বিডির বরাতে বলেছে যে, উভয়কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে যুদ্ধাপরাধ এবং জেনোসাইডের অভিযোগে। তবে নিজেদের বরাতে অ্যামনেস্টি বারবারই বলেছে, বিচার হচ্ছে একাত্তরে সংঘটিত ‘ক্রাইম’-এর জন্য, কখনো-বা ‘সিরিয়াস ক্রাইম’ শব্দ তারা ব্যবহার করেছে, কিন্তু কখনোই ‘জেনোসাইড’ নয়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘জেনোসাইড’ অস্বীকৃতি ছাপিয়ে এখন আরও গুরুতর অবস্থান নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচারের দাবি তুলে, একাত্তরে তাদের ‘ক্রাইমের’ জন্য। অ্যামনেস্টির দৃষ্টিভঙ্গির কদর্য রূপ এখানে ফুটে উঠেছে এবং তারপরও তারা এমন বলার ধৃষ্টতা পায়নি যে মুক্তিযোদ্ধারা জেনোসাইড অথবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। কেননা, তারা জানে জেনোসাইডের সংজ্ঞা, কোনো জাতি বা ধর্মগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার প্রয়াস, সেটা পাকিস্তানিরা ও তাদের দোসররা করেছিল, তাহলে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের একই কাতারে দাঁড় করিয়ে অভিযুক্ত করা যায়।
উত্তর-আধুনিক যুগে শব্দ ব্যবহার দ্বারা বিশ্লেষণ করা হয় রচয়িতার মন ও মানস। অ্যামনেস্টির বিবৃতির শব্দ-ব্যবহার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সুকুমার রায়ের শব্দকল্পদ্রুম, ‘ঠাস ঠাস ফোটে ফুল ভয়ে কান বন্ধ/ সাঁই সাঁই ছুটে যায় সে-ফুলেরই গন্ধ’।
ফুল ফোটানোর কথা ছিল অ্যামনেস্টির, কিন্তু তাদের ফুল ফুটছে ঠাস ঠাস করে বোমার মতো, ফুলের গন্ধ ছুটে যাচ্ছে সাঁই সাঁই করে গুলির মতোই। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তৃতীয় বিশ্বের গণহত্যার শিকার এক দুর্ভাগা জাতির বিচার-ধারাকে নিন্দিত করতে চেয়ে নিজেকেই করল চিহ্নিত ও নিন্দিত।
বাংলাদেশের গণহত্যার বিচার নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল স্বীয় অবস্থানের জন্য দায়ী থাকবে ইতিহাসের কাছে, গণহত্যার শিকার অগণিত মানুষের কাছে, জেনোসাইড মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী মানবতার সংগ্রামের কাছে।
মফিদুল হক: লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।