নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলাকারীরও কিন্তু একটি তত্ত্ব লেগেছে, একজন তাত্ত্বিক লেগেছে। ফ্রান্সে তত্ত্বটির জন্ম। নাম “Grand Remplacement” বা ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ যাকে হামলাকারী ব্রেন্টন তারান্ত তার মেনিফেস্টো বানিয়েছে।
‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ তত্ত্বটির জনক জঁ রেঁনো ক্যামু। বিপদের কথা, লোকটি একজন সাহিত্য ও শিল্পতত্ত্ব বিশারদ; টিভি-রেডিওতে শিল্প-সাহিত্য আলোচনা করেন, গ্যালারিতে শিল্প প্রদর্শনী করেন। অর্থাৎ শিল্প-সাহিত্যের মানুষরাও ভালোই ‘ডেঞ্জারাস আইডোলজি’র জন্ম দিচ্ছেন। [পশ্চিমে ‘ডেঞ্জারাস আইডিওলজি’ শব্দটি দিয়ে মূলত ‘ইসলাম’কে ইঙ্গিত করা হয়]
‘ফাইজলামি নয়’ (Parti de L’In-Nocence বা No Nuisance) নামে একটি রাজনৈতিক দল বানিয়ে রাজনীতিও করেন ক্যামু। কয়েক বছর আগে ‘মুসলিমরা সবাই দুর্বৃত্ত ও সশস্ত্র; এরা সহসাই ফ্রান্স দখল করে নেবে’ বললে আদালত তাকে ৪০০০ ইউরো জরিমানা করেন। তিনি হেসে-খেলে তা দিয়েও দেন। তাঁকে উসকে দিতে থাকা অত্যন্ত ধনী ইহুদি বন্ধুরাই জরিমানার টাকা জোগান দিয়েছেন মনে করা হয়। ফ্রান্সের কিছু ইহুদি যদিও তাঁর তত্ত্বকে সন্দেহ করে যে এরপর কিন্তু তিনি ইহুদিদের বিরুদ্ধেও ঘৃণা উসকে দেবেন।
বিপদের কথা, হামলাকারীর ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট মেনিফেস্টো’ মাসের পর মাস অনলাইন-ফেসবুকে-সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরেছে। গোয়েন্দা, পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী, চিন্তক, ভাবুক, এফবিআই, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ইত্যাদি কেন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল? এই মুসলিম-নিধন মেনিফেস্টোটির আদলে একই রকম একটি অমুসলিম-নিধন মেনিফেস্টো অনলাইনে এলে এরাই কি হাজারগুণ সক্রিয় প্রতিক্রিয়া দেখাত না? যদি কোনো মুসলিম এ রকম মেনিফেস্টো দিত? প্রতিক্রিয়া কী হতো ভাবতেই গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।
ক্যামু লোকটি সমকামী এবং সমকামিতাবাদের পক্ষে এত বেশি উদারতাবাদের প্রসঙ্গ টানেন যে তাঁকে অনেকেরই প্রশ্ন করার কথা, উদারতার কথা বলেও মুসলিম বিষয়ে চরম উগ্র ডানপন্থী রক্ষণশীলতা প্রচার সীমাহীন ভণ্ডামি নয় কি? কিন্তু প্রশ্নটি সাংবাদিকেরাও তাঁকে কেন করেননি, সামান্য চিন্তা করলে বুঝতে পারা কঠিন নয়।
নিউজিল্যান্ড এমনই শান্তিপূর্ণ দেশ যে পুলিশ অস্ত্রশস্ত্রই সঙ্গে রাখে না। সেখানেও হোয়াইট সুপ্রিম্যাসির ক্যামু তত্ত্ব পৌঁছে গেছে। বন্দুকধারী আবার অস্ট্রেলীয়, নিউজিল্যান্ডারও নয়। ফ্রান্সে জঁ রেঁনো ক্যামুকে কেউ বিশেষ পাত্তা দিত বলে শোনা যায়নি। তিনিই কিন্তু সীমান্ত ছাড়িয়ে হোয়াইট সুপ্রিম্যাসিস্টদের গুরু হয়ে উঠছেন। সাদা সরকারগুলোর এবার নিজেদের ঘরের কুলাঙ্গারগুলোর দিকে নজর ফেরানো দরকার।
আজ (কানাডার ১৫ তারিখ) উইনিপেগে একটি কনফারেন্সে যুক্ত আছি। কনফারেন্সটির শিরোনাম ‘স্ট্রাইভিং ফর হিউম্যান ডিগনিটি: রেইস, জেন্ডার, ক্লাস অ্যান্ড রিলিজিয়ন—আ কানাডিয়ান কনভার্সেশন’। একটি প্যানেলে পাকিস্তান থেকে কানাডায় আসা এক যুবক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, পাকিস্তানের মতো দেশে তাঁকে শুধু একটি সমস্যা ‘হোমোফোবিয়া’র শিকার হতে হয়েছিল। স্বপ্নের দেশে এসে রেসিজম, জেনফোবিয়া, অ্যান্টি-এশিয়ানিজম, অ্যান্টি-ইসলামিজম, অ্যান্টি-ইমিগ্রেশনিজম—এত কিছুর মুখোমুখি হতে হচ্ছে যে মনে হচ্ছে কোথাও আর ‘সেফ স্পেস’ থাকছে না। যুবক প্যানেলিস্ট জানালেন, ২০১৬ সালে অরল্যান্ডো শুটিং-এর পর তিনি টের পান যে সমকামী সমাজের সদস্যদের তিনি আপনজন ভেবেছিলেন, তাঁরাও হিংস্র ও হিংসাত্মক মন্তব্যের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হামলে পড়েছে মুসলিমবিরোধী প্রচারণায়। তাঁকেও মুহূর্তেই বর্জন করতে তাঁদের বাধেনি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, মিডিয়া যদিও হামলাকারী সন্ত্রাসী সম্পর্কে জানাচ্ছিল যে তাঁর জন্ম আমেরিকায়, স্কুলজীবন থেকেই তিনি বখাটে, তাঁর ঘরে বা ব্যক্তিজীবনে ইসলাম ধর্ম চর্চার ছিটেফোঁটাও ছিল না; নিজেরও সমকামী সম্পর্কের এবং বল্গাহীন উদ্দাম জীবনযাপনের তথ্য আছে এফবিআইয়ের কাছে। নাইন-এলিভেন ঘটনার পর তাঁর উল্লাস প্রকাশ, নিজের জিহাদে নামার ঘোষণা দেওয়া, বাগদাদিকে নেতা মানা—এসব আচরণের কারণে তিনি এফবিআইয়ের ছাঁকনি তালিকায় পড়লেও এফবিআই তাঁকে ২০১৩ সালে তালিকা থেকে বাদ দেয়। তার পিতামাতার নিত্য কলহকে, অমুসলিমের জীবনযাপনকে এবং উন্মত্ত খামখেয়ালিপনাকে আমলে নিয়েই এফবিআই তাঁকে তালিকামুক্ত করেছিল কি না, এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যথেষ্ট বিতর্কও হয়েছিল। সে যা-ই হোক, তাঁর মুসলিম নামটিই ঘৃণার আগুন উসকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। মুসলিমবিদ্বেষীদের জন্য মুসলিম নাম মেলাটাই আসল কথা। সঙ্গে যদি কোনো তাত্ত্বিক সমর্থন মেলে, তাহলে তো পোয়াবারো।
‘দ্য কনভার্সেশন’ অনলাইন জার্নাল-এর অতি সাম্প্রতিক সংখ্যায় একটি বারগ্রাফে ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ধর্ম পরিচয়ের কারণে আক্রমণের শিকার হওয়া বেড়ে যাওয়া দেখানো হয়েছে। ১৪ তারিখের কনফারেন্সের কি-নোট স্পিকার সন্ত্রাসবাদ গবেষক ড. বারবারা পেরি ‘দ্য ফার-রাইট ইন কানাডা’ শিরোনামের গবেষণা প্রবন্ধে দেখালেন ‘হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি’ এতটাই বাড়ন্ত যে কানাডার মতো দেশেই এক দশকে ‘হেইট ক্রাইম’ বা ঘৃণাসঞ্জাত আক্রমণ বেড়েছে ১২০ গুণ। নানা রকমের তত্ত্বের পাশাপাশি উসকে দেওয়া প্রযুক্তিও বাড়ছে। প্রসঙ্গক্রমে, ‘চীনের ফেসবুক’ নামে পরিচিত ‘উইচ্যাট’ নামের অ্যাপটির উদাহরণ আনেন শ্বেতাঙ্গবাদীরা। তাঁদের যুক্তি, চীনারা তো সাদা নয়, তাহলে ‘উই চ্যাট’-এ কেন মুসলিমবিদ্বেষী মিম, ট্রল, ব্যঙ্গ-কৌতুক, উপহাস এবং গল্প-নাটিকার ছড়াছড়ি? দৃশ্যত, শ্বেতাঙ্গবাদীরা দ্রুত শক্তিশালী দল হয়ে বেড়ে ওঠার উদ্দেশ্যে যেকোনো ছুঁতাকেই আঁকড়ে ধরছে, যেকোনো সহযোগী ধারণাকেই ব্যবহার করছে। কিন্তু সব দেশেরই খামখেয়ালি ছেড়ে সতর্কতার পথে হাঁটা বাঞ্ছনীয়। নইলে একসময় শ্বেতাঙ্গদের নিজেদের ঘরই বিপদাপন্ন হয়ে উঠবে।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।