বন্দুক হাতে ঢুকে পড়ল এক লোক...। পাঠক, এখন শূন্যস্থানে একেকটি জায়গার নাম লিখব আর দেখব কীভাবে ঘটনার মানে বদলে যায়। এই অদল ও বদলের বিষয়টি এখন বহুল আলোচিত। আমি শুধু বলাটা ধার করছি এখানে।
বন্দুক হাতে লোকটি ঢুকল স্কুলে, চালাল নির্বিচার গুলি। শ্বেতাঙ্গ ও খ্রিষ্টান এই লোকটিকে তখন বলা হবে মানসিক ভারসাম্যহীন। সমাধান: ওকে আটকে রেখে চিকিৎসা করো।
বন্দুক হাতের লোকটি মুসলমান? তাহলে এটা নির্ঘাৎ এক ‘জেহাদি’ সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্র। সমাধান: মুসলমান খেদাও।
বন্দুক হাতে লোকটি যদি ইসরায়েলি অথবা মার্কিন সেনা হয়, তাহলে তার পরিচয় হবে সভ্যতার প্রহরী। তাদের বীরের খেতাব দাও।
বিশ্বের এমন কোনো রাষ্ট্রনেতা আছেন, যিনি বন্দুক হাতে ছবি তোলার পোজ দেননি? গায়ে চড়াননি সামরিক পোশাক? তাঁরা এসব করেন একদিকে যুদ্ধব্যবসায়ীদের হাতে রাখতে অন্যদিকে অক্ষম জনতাকে চেতিয়ে ভোট বাড়াতে।
বন্দুকের পরিচয় নেই কে বলল? বন্দুক বানায় কোম্পানি, বন্দুক হলো লোভনীয় ব্যবসা। বেশির ভাগেরই মালিক পশ্চিমা। এসব কোম্পানির মালিকেরা হয়তো খালি হাতে একটা মশাও মারেন না, তাঁদের অনেকেই মস্ত বড় দানবীর, টেলিভিশন ছাড়া আর কোথাও তাঁরা যুদ্ধ-হত্যা দেখেনও না। রক্তপাত সয় না বলে এঁরা প্রায়শই নিরামিষ ভোজন করেন। কিন্তু বন্দুক হাতে যারা মানুষ মারতে আসে, তারা ওই সব ব্যবসারই ভ্রাম্যমাণ ক্রেতা-বিক্রেতা। যারা ইরাকে-আফগানিস্তানে-সিরিয়ায়-সোমালিয়ায়-ইয়েমেনে বা রাখাইনে মানুষ হত্যা করে আসছে, তাদের পেছনে পাওয়া যাবে ওইসব কোম্পানি ও ওইসব মহান নেতাদের লম্বা লম্বা হাত।
অথচ শিকড়ের দিকে না, লতাপাতায় জড়ায়ে যায় আমাদের মন ও মগজ। তাই ‘সন্ত্রাসী’ পরিচয় কেবল মুসলমানদের জন্যই বরাদ্দ। অথচ এফবিআই ডেটাবেইস থেকে বের হওয়া একটা প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ১৯৮০-২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ঘটা মাত্র ৬ শতাংশ সন্ত্রাসী ঘটনায় মুসলিম সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল। যুদ্ধাক্রান্ত সিরিয়াকে বাদ দিলে ২০১৬-১৭ সালেও বিশ্বের মোট সন্ত্রাসী ঘটনার বেশির ভাগই ঘটেছে অমুসলিমদের দ্বারা (গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স ২০১৮)।
ব্রেইভিকের দায় সব সুইডিশকে নিতে হয়নি। ২০১১ সালে অ্যান্ডার্স বেহরিং ব্রেইভিক নামের এক ব্যক্তি নরওয়েতে গুলি ও বোমা ফাটিয়ে এক ঘণ্টা ধরে মোট ৭৭ জনকে হত্যা করেন। এর আগে নিজের ব্লগে তিনি মুসলিমবিদ্বেষী কথাবার্তা লেখেন। নরওয়ের মতো নিউজিল্যান্ডও শান্তির দেশ বলে পরিচিত। কিন্তু এই শান্তি সাম্প্রদায়িক ঘাতক মানসিকতা তৈরি ঠেকাতে পারেনি। ব্রেইভিককে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী বলেননি সে দেশের আদালত। নিয়মিতভাবে পাখির মতো করে স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের হত্যা করা মার্কিন ঘাতকেরাও নিতান্তই ‘অসুস্থ’। মুসলমান হলে নিরাপত্তা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক ও সামরিক প্রশ্ন, আর অন্য ধর্মের হলে হয়ে দাঁড়ায় মানসিক সমস্যা। ফ্রান্সের শার্লি হেবদোতে গুলি করে কয়েকজন হত্যার পর জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, দায়ী করা হয় মুসলমান জনগোষ্ঠীকে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের এত বড় ঘটনার পর বিশ্বের বস্ত্রহীন সম্রাট ট্রাম্প সাহেব এখনো নির্বিকার।
ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার জন্য ইউরোপে গণহত্যার শিকার হওয়া ইহুদি যুবকেরা যখন ফিলিস্তিনে বোমা ফাটাচ্ছিলেন, বন্দুক হাতে নাশকতা করছিলেন, তখন তাঁদের বলা হলো মুক্তিযোদ্ধা। আর ফিলিস্তিনিরা যখন তাদের হারানো জীবন ও জমি ফিরে পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ চালাচ্ছে, তখন তাদের নাম দেওয়া হলো ‘সন্ত্রাসী’। ১৯৭১–এ পাকিস্তানের চোখে যারা ‘সন্ত্রাসী’, তারাই বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা। কারও সন্ত্রাসী, কারও মুক্তিযোদ্ধা; কিন্তু যারা মারা যায় তারাও মানুষ। মসজিদে বা মাজারে, স্কুলে বা বাসে, ঘরে বা হাসপাতালে মানুষেরই মৃত্যু ঘটে চলেছে। এবারেও অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেনন
কিন্তু সব মৃত্যু নয় সমান। বন্দুক হাতের লোকটি যদি শ্বেতাঙ্গ না হয়ে কালো বা বাদামি হতো, হতো মুসলমান বা হিন্দু; তবে তাদের ধর্মোন্মাদ বলায় কোনো কসুর করত না অধিকাংশ পশ্চিমা গণমাধ্যম। যদি বন্দুক হাতের লোকটি কোনো কৃষক মাওবাদী হতো, তখনো ‘সন্ত্রাসী’ খেতাব আর দেখামাত্র গুলির নির্দেশ তাদের প্রাপ্য হতো। তাই সব বন্দুকবাজও নয় সমান।
ব্রেইভিকের মতো নিউজিল্যান্ডের বন্দুকধারীরা জানে, আইন তাদের ধরলেও পাশ্চাত্যের ডানপন্থীদের কাছে তারা হবে ‘বীর’। ঠিক এমন আশ্বাসে ভর করেই মুসলমান তরুণদের কেউ কেউ যোগ দেয় আল–কায়েদা কিংবা আইএস-এ।
ইরাক-সিরিয়া-লেবানন-আফগানিস্তান-সোমালিয়া-আরাকান—যেখানেই যুদ্ধ ও সহিংসতা চলেছে, গণহত্যা চলেছে, বিতাড়িত হয়েছে লাখো মানুষ; সবখানেই পাওয়া যাবে পশ্চিমাদের ভূরাজনৈতিক লীলাখেলা। তেলের জন্য, বন্দরের জন্য, সামরিক সুবিধার জন্য চালানো এসব যুদ্ধের প্রধান শিকার ওই সব দেশের মানুষ। আপনি সুবিধা নেবেন, কিন্তু শরণার্থী নেবেন না, তা হয় না। আপনি বিশ্বায়নের নামে দেশে দেশে প্রভাব বাড়াবেন, বাজারে দাপট চালাবেন, কিন্তু বেকার অভিবাসীদের জন্য সীমান্তে বন্দুক উঁচিয়ে রাখবেন, তা হয় না। দ্বিতীয়ত, মুখে উদারতার কথা বলে নিজ নিজ সমাজকে কেবলই একটি ধর্মের মানুষের জন্য সংরক্ষিত রাখাও সভ্যতা হতে পারে না। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা বহুজাতিক ও বহুধর্মীয়। অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা কেন তা হবে না?
বিশ্বায়ন, অসম উন্নয়ন, পরাশক্তি দিয়ে চালানো বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর সম্পদখেকো যুদ্ধ ছাড়া আজকের সন্ত্রাসবাদ ও শরণার্থীর ঢল কল্পনা করা যায় না। এই দায় তাদের নিতে হবে। শরণার্থীদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেওয়ার দায়ও তাদের। বাংলাদেশের মতো দেশ যদি ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়, তুরস্ক যদি বিপুলসংখ্যক সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়, তাহলে সিরিয়ায় অশান্তির হোতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেন দায়মুক্তি পাবে?
এদিক থেকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া খেয়াল করার মতো। তিনি বলেছেন, ‘এই গুলিবর্ষণের ঘটনায় যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নিউজিল্যান্ডে অভিবাসী, এমনকি তাঁদের মধ্যে শরণার্থীরাও আছেন। তাঁরা নিউজিল্যান্ডকে তাঁদের স্বদেশ করে নিয়েছেন এবং এটা তাঁদের দেশ। তাঁরা আমাদের। কিন্তু যে ব্যক্তি (অথবা ব্যক্তিরা) সহিংসতা চালিয়েছে, তারা আমাদের কেউ নয়।’
সুন্দর সূক্ষ্ম প্রতিক্রিয়া। তিনি হত্যাকারীকে জঙ্গি বর্ণবাদী সন্ত্রাসী বলেননি বটে, তবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আপন করে নিতে চেয়েছেন।
২০১২ সালে নাফিস নামে এক বাংলাদেশি তরুণকে সন্ত্রাসী সাজিয়ে মাঠে নামিয়েছিল এফবিআই। তারপর আমেরিকায় বাংলাদেশিরা খুব সংকটে পড়েছিল। আজ নিউজিল্যান্ডের নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে পাচ্ছি বাংলাদেশিদের নাম। আক্রান্ত হয়ে আমরা কি আরও সহানুভূতি পাব? নাকি শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীর দেখানো নিশানা আরও বেশি করে আমাদের ওপর আসবে?
এ রকম সময়ে শুধু সত্য জানা ও জানানোই যথেষ্ট নয়, দরকার সঠিক বিশ্লেষণ ও নির্দেশনা। ইউরোপ বলি বা বলি বাংলাদেশ, অধিকাংশ মানুষ সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিপক্ষে। সব দেশে সব রঙে, সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই শান্তিবাদী মানুষ আছেন। আমরা যদি আমাদের মাটিতে শান্তি ও সম্প্রীতিকে গভীর করতে পারি, তাহলে তার বাতাস বিশ্বের গায়েও লাগবে। নিউজিল্যান্ড ও বাংলাদেশের আজ সহব্যথী, সহভাগী হওয়ার দিন। ঘৃণার বিপক্ষে ভালোবাসার শক্তি তখনই বড় হয়, যখন ভালোবাসা দায়িত্ব নিতে শেখায়। মানুষ যখন মানুষকে এভাবে মারে, তখন মানুষকেই মানুষ থেকে দায়িত্ব নিতে হবে বাঁচানোর—নিজ দেশে, সব দেশে।
এক জাত বা ধর্মের নামে অপর জাত বা ধর্মের মানুষকে যারা ঘৃণা করে; পোকামাকড়ের মতো হত্যা করতে চায়, হয় তাদের এতে ধনদৌলতের লাভ হয় নয়তো তারা অজ্ঞানতার সাধক। যে অস্ট্রেলিয় নাগরিক প্রায় ৫০ জনকে হত্যা করলেন তিনি পশ্চিমা জগতে মুসলমান অভিবাসী চান না। কিন্তু এই নির্বোধ কীভাবে অস্বীকার করবে যে আজকের অস্ট্রেলিয়া–আমেরিকা–কানাডার সংখ্যাগুরুরা নিজেরাও মূলত অভিবাসী ছিল? যারা ইউরোপকে সভ্য আর বাদবাকিদের অসভ্য ভাবছে তারা জানে না আরবের রেনেসাঁ থেকেই আলো নিয়েছিল ইউরোপীয় আধুনিকতা। প্রাচীন সংস্কৃত, লাতিন ও গ্রিক ভাষা টিকে গিয়েছিল মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়, ইউরোপীয় সংস্কৃতির শোভা যে কফি ও কমলা, উইন্ডমিল ও কলম এসেছে আরব থেকে, কাগজ এসেছে চীন থেকে, গণিতের শূন্য এসেছে ভারত থেকে। ইউরোপের জাতীয়তাবাদী নেতারা কেউ বিশুদ্ধ ‘স্বজাতীয়’ নন। নেপলিয়ন ছিলেন ইতালির কর্সিকার সন্তান, স্ট্যালিন ছিলেন জর্জিয়, ক্রমঅয়েল খাঁটি ব্রিটিশ ছিলেন না, ধর্মরাষ্ট্র ইসরায়েলের স্বপ্নদ্রষ্টা থিওডর হার্জেল ছিলেন ঘোষিত নাস্তিক। রোমান সাম্রাজ্যের আসল চেহারা ছিল মূলত জার্মানিক আর গ্রিস একসময় এশিয়ার অংশ বলেই গন্য হতো। পৃথিবীতে কোনো বিশুদ্ধ জাতি নেই। সব ধর্মই পরস্পরের কাছে ঋণী। একার জোরে মহান হতে চাইলে ইউরোপীয়রা আজও বনজঙ্গলেই থাকতো। অপরের থেকে না শিখতে চাইলে আরব বেদুইনেরা মরুভূমিতেই ঘুরে বেড়াতো।
ঘৃণার জন্ম ভয় থেকে। ভয়ের জন্ম অজ্ঞানতা ও অক্ষমতা থেকে। ভয় জাগিয়ে মানুষকে অক্ষম করে হিংসার পরিখা দিয়ে ঘিরে রাখা যায়। ঘৃণা আর ভয় হলো সবচেয়ে বড় কারাগার, যার মধ্যে আটক বেশিরভাগ মানুষ। ভয়ার্ত মানুষকেই সহজে বশে রাখে কূটিল নেতারা, আকংককে পুঁজি করে মুনাফা বানায় যুদ্ধব্যবসায়ীরা। সংস্কৃতির–কারখানা (Culture Industry) পয়দা করে বিস্তর সিনেমা ও গল্প, জ্ঞানপীঠ ছড়ায় আতংকের ভাবাদর্শ; যেখানে ভিনগ্রহের মানুষ থেকে শুরু করে পোকামাকড় এমনকি শিশুদেরও দেখানো হয় ভয়ংকর বিপদজনক হিসেবে। ভয় আর বিদ্বেষের কারখানা জারি রাখব আর পৃথিবী ফুলের বাগিচা হবে; এমন আশা গরল ভেল হতে বাধ্য।
বাঁচতে হলে জানতেও হবে, ভালবাসতেও হবে।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.com