মতামত

না আছে খাওয়ার পানি, না আছে নাওয়ার

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয় বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার নারীদের।
ছবি : প্রথম আলো

শরণখোলা থেকে এক নিরুপায় মুক্তিযোদ্ধা অনেক রাতে ফোন করে জানালেন, পানির জন্য এমন হাহাকার তিনি আগে কখনো দেখেননি। তিনি বলছিলেন, তাঁদের এত কষ্ট, তারপরও আমরা কেন তাঁদের নিয়ে লিখি না। লিখলে কি পানীয় জলের অভাব দূর হবে? কেউ কি পড়বেন? পানির কষ্টের কথা পড়ার জন্য, লেখা ছাপার জন্য কর্তারা কেন অপেক্ষা করেন? জানি, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তারপরও জানতে মন চায়।

বাগেরহাটের শরণখোলায় টিউবওয়েল চলে না। মাটির নিচেও লবণজল। হয় আকাশের জল, না হয় পুকুরের পানি—এই ব্যবস্থা সেখানে চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। পুকুরের পানি হাতকলের মাধ্যমে উঠিয়ে ইট-বালুর ট্যাংকে রেখে পানি নিরাপদ করা হয়। এটাকে ছেলেমেয়ে-প্রবীণ সবাই বলে, পিএসএফ (পন্ড স্যানড ফিল্টার)। নিরাপদ পানীয় জল সংগ্রহের জনপ্রিয় আর সাশ্রয়ী এই ব্যবস্থা আমাদের উপকূলের প্রায় সব জেলা-উপজেলায় আছে। তবে ব্যবস্থাপনার কারণে অধিকাংশই অকেজো থাকে সারা বছর। তবে এ বছরের হিসাব অন্য রকম—বৃষ্টি একেবারেই নেই, তাই পুকুরে পানি নেই। ফলে পিএসএফগুলো চলছে না। গত বছরের মার্চ মাসে ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

করোনাকালে কষ্টেসৃষ্টে খাবার জোগানো গেলেও পানীয় জল মিলছে না দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের। শরণখোলায় পানি ব্যবসায়ীরা এখন ১০ লিটার পানি বিক্রি করছেন ৪০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি লিটার ৪ টাকা। অথচ লাভ রেখেও প্রতি লিটার পানি ১ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। শরণখোলার সাউথখালীর বগিতে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এই সাশ্রয়ী দরে পানি বিতরণের কাজ করছে। ‍রায়েন্দায় (উপজেলা সদর এলাকা) আরেকটি সংগঠন বাড়ি বাড়ি পানি পৌঁছে দিচ্ছে প্রতি লিটার ২ টাকা দরে। রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়ায় খাল-নালার লবণাক্ত পানিকে লবণমুক্ত করে এরা মানুষকে পানের পানি দিচ্ছে। পানের পানির বাইরেও নানা কাজে আমাদের লবণমুক্ত পানির প্রয়োজন হয়। এমনকি গবাদি প্রাণীও লবণাক্ত পানিতে অভ্যস্ত নয়।

পানিসংকটের কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে লবণমুক্ত পানির ব্যবহার সীমিত করে ফেলছে। অনেকে মাত্র ২ কলস বা বড়জোর ১০ লিটার পানি দিয়ে গোটা পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান অনুযায়ী একজন মানুষের এক দিনে পানের জন্য প্রয়োজন ৩ লিটার পানি। পরিবারে ৫ জন সদস্য থাকলে শুধু পানের জন্যই লাগবে ১৫ লিটার পানি। এই হিসাবের বাইরে আছে ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য, রান্নাবান্নার জন্য মানসম্মত পানি। সেই হিসাবে পাঁচজনের একটা পরিবারে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০ থেকে ৭৫ লিটার নিরাপদ পানির প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, সেই কপাল দক্ষিণের মানুষের নেই।

মাত্রাতিরিক্ত হারে লবণাক্ত পানি পান করা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। গবেষকেরা এখনো গবেষণা জারি রেখেছেন। আইসিডিডিআরবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজসহ আরও অনেক জানা-অজানা প্রতিষ্ঠান। ২০১৬ সালে এ রকম এক গবেষণার ফলাফল জানাতে গিয়ে ইম্পিরিয়াল কলেজের সাবসারফেস হাইড্রোলজির রিডার অ্যাড্রিয়ান বাটলার বলেছিলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫ গ্রাম লবণ খাওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু উপকূলের মানুষ কিছু ক্ষেত্রে এর ২০০ গুণ লবণ খায়। বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যদি উপকূলের মানুষ কম লবণাক্ত পানি (যেমন বৃষ্টির পানি) পান করে, তাহলে তাদের রক্তচাপ কমিয়ে আনা সম্ভব। আমরা জানি, খাওয়ার পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা গর্ভবতী মায়েদের উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির মূল কারণ। উচ্চ রক্তচাপ ও প্রি-একলাম্পসিয়ার মধ্যে সম্পর্ক আছে।

সাত মাসের বৃষ্টির এই দেশে উপকূলবাসী ভালো করেই জানে তাদের জন্য বৃষ্টির পানিই সহজ আর নিরাপদ। গবেষকদের উপসংহারও তাই। তবে তাঁদের বাতলানো ঢঙে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তা ব্যবহার করার খরচ অনেক সময় সাধারণের নাগালের বাইরে থাকে যায়। কিন্তু কমিউনিটি বা সামাজিক ব্যবস্থাপনায় এটা সম্ভব। শরণখোলার

রায়েন্দাবাজারের কাছে ছোট্ট সামাজিক সংগঠন অগ্রদূত ক্লাব সেটা করে দেখিয়েছে। ২০০৭ সালে সিডরের পর এলাকার এটাই ছিল একমাত্র নিরাপদ পানির উৎস। সেই উৎস এবার শুকিয়ে গেছে। তাদের এক বিঘা জমির পুকুরে পানি নেই। অগ্রদূত ক্লাবের আইয়ুব জানালেন, এত দিন তিনি সবাইকে পানি দিয়েছেন, এখন তাঁদেরই পানির জন্য ট্যাঁকের পয়সা নিয়ে ছুটতে হচ্ছে দিগ্‌বিদিক।

মিষ্টি বা সামান্য লবণাক্ত পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বহমান নদীগুলোতেও লবণের মাত্রা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শরণখোলার ভোলা নদী শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলেও বলেশ্বর নদের তেজ এখনো আছে।

বলেশ্বর নদ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরগুনা, পিরোজপুর, শরণখোলা হয়ে ১৪৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুন্দরবন ডিঙিয়ে সাগরে মিশেছে। বলেশ্বরের মিষ্টি পানির একটা প্রধান উৎস ছিল মধুমতী নদী। মধুমতী নাজিরপুর উপজেলার ঝনঝনিয়া থেকে পিরোজপুর হয়ে বলেশ্বরে মিশেছে। ফারাক্কার কারণে মধুমতী, গড়াই আর তাদের মা নদী পদ্মা এখন হাড়-জিরজিরে পানিপ্রবাহ মাত্র। তাই জোয়ারে আসা সাগরের নোনাপানি আবার ভাটার সময় সাগরে ফিরিয়ে দেওয়ার শক্তি নদীগুলো হারিয়ে ফেলেছে। তারপরও বলেশ্বরের উজানে দেশের ভেতরে নানা রকমের বাঁধ দিয়ে মিঠাপানি আটকানো হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বছর বলেশ্বর নদে হঠাৎ লবণাক্ততা বেড়ে গিয়েছিল। পরে দেখা যায়, শাখানদী দিয়ে উজানের পানি আসায় বাধা তৈরি হওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছিল। ওই বাধা সেবার অপসারণ করার পর পানির লবণাক্ততা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে এ বছর আবার সেই অবস্থা ফিরে এসেছে।

সম্প্রতি উজানের আরও অনেক নদীতে লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার খবর আসছে। কীর্তনখোলার পানিতে স্বাভাবিকের চেয়ে চার গুণ বেশি মাত্রার লবণ পাওয়া গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় অফিসের সহকারী বায়োকেমিস্ট মুনতাসির রহমানের উদ্ধৃতিতে দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় এসেছে, নদীর চরকাউয়া, লঞ্চঘাট ও দপদপিয়া পয়েন্টে গত ৭ মার্চ পানি পরীক্ষা করে ইলেকট্রিক্যাল কন্ডাকটিভিটি (ইসি) পাওয়া গেছে ১৩৬০ মাইক্রো সিমেন্স পার সেন্টিমিটার, যা স্বাভাবিক সময়ে ৩০০ থেকে ৪০০ মাইক্রো সিমেন্স পার সেন্টিমিটার পাওয়া যেত। সাধারণত ইসি ১২০০ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য ধরা হয়ে থাকে।

অনেক আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, শরণখোলায় পুকুরভিত্তিক ১৮টি পানি পরিশোধনব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। উপজেলা কমপ্লেক্সেরটা চালু হলেও বাকিগুলোর খবর নেই। কোথাও বিদ্যুৎ-সংযোগের অপেক্ষায় আবার কোথাও অপেক্ষার কারণ জানা নেই। ‘ন্যানোফিল্টার’ বসে গেছে অনেক জায়গায় কিন্তু চালু হচ্ছে না। বাংলাবাজার বা দমকল অফিস লাগোয়া প্ল্যান্ট দুটি অবিলম্বে চালু করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনগণ। প্রকল্প দুটির লাগোয়া পুকুরগুলো বড় হওয়ায় এখন যথেষ্ট পানি আছে।

খাতা-কলমে শরণখোলা উপজেলায় ষাটের বেশি খাসপুকুর আছে। এর অর্ধেকও যদি পুনরুদ্ধার করে স্বয়ংক্রিয় (যা ন্যানোফিল্টার নামে পরিচিত) পরিশোধনের আওতায় আনা যায়, তাহলে পানীয় জলের অন্তত আকাল থাকবে না। এগুলোতে বিদ্যুৎ নয়, বরং সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় এটাই প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত।

রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়ায় যাঁরা পানি পরিশোধনের ব্যবস্থা করেছেন, তাঁদের উৎপাদন ও বণ্টনে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এসব সহযোগিতার লক্ষ্য হবে মান নিয়ন্ত্রণ ও সাশ্রয়ী মূল্য বজায় রাখা। চিন্তা করতে হবে গৃহভিত্তিক বৃষ্টির পানি ধরে রাখার সহজ-সাশ্রয়ী প্রক্রিয়া নিয়েও।

প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পানির ন্যায্য হিস্যার আলোচনার পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে, আমরা নিজেরাও নদীর স্বার্থ মানছি কি না। দেশের ভেতরেও নদীর পানি প্রত্যাহারে আমাদের পরিকল্পনায় নদী যেন বঞ্চিত না হয়। নদী যেন সারা বছর সাগরের দেখা পায়।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
nayeem5508@gmail.com