>বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২,২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর দুই পলাতক আসামি আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ওই দুই কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ ১৭ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। দণ্ডিত ব্যক্তিরা কখনো আপিল করেননি। এই মামলার শুনানিতে সাক্ষীদের ভাষ্যে অনেক অজানা মর্মস্পর্শী তথ্য ও বিষয় উদ্ঘাটিত হয়। তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নথিপত্রের ভিত্তিতে কিছু বিষয় নির্বাচিত করেছেন। এর সবটাই মূলত শহীদদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি। পাঁচ কিস্তির এই নির্বাচিত অংশের দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হলো আজ।
[গতকালের পর]
শহীদ সাংবাদিক নিজামুদ্দীনের ছেলে সাফকাত নিজাম এই মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে সাফকাত নিজাম ওরফে বাপ্পী ছিলেন চার বছরের শিশু। তিনি বড় হয়ে তাঁর মা, নানা, নানি, মামা ও খালার কাছ থেকে তাঁর বাবার অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পারেন। শহীদ সাংবাদিক নিজামুদ্দীনের লাশটি তাঁরা খুঁজে পাননি। সাফকাত নিজাম এই ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তার কিয়দংশ:
‘আমার বাবা শহীদ সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে এ দেশের মানুষের অধিকার নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। ১৯৭১ সালে তিনি বিবিসি বাংলাদেশের সংবাদদাতা এবং পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (পিপিআই)–এর জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। এটি একটি সরকারি সংস্থা ছিল। তিনি সরকারি সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হয়েও ১৯৭১ পাক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বাঙালিদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সাফল্যগাথাও তাঁর বিবিসির রিপোর্টিংয়ে তুলে ধরতেন।
১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর কারফিউ ছিল। দুপুর আনুমানিক ১টা থেকে ২টার মধ্যে বাসার সবাই দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলাম। এই সময় একপর্যায়ে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। দরজা খোলামাত্রই আমাদের বাসায় দুজন অস্ত্রধারী প্রবেশ করে। তারা ভাঙা ভাঙা উর্দুতে আমার বাবার নাম ধরে খোঁজ করতে থাকেন। আমার বাবা পরিবারের সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে নিজেই খাবার টেবিল থেকে উঠে অস্ত্রধারীদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন “আমিই নিজামুদ্দীন আহমদ”। ওনার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য অস্ত্রধারীরা তাঁর কাছে পরিচয়পত্র চান। উনি একপর্যায়ে পরিচয়পত্র দেখান। তখন অস্ত্রধারীরা কালবিলম্ব না করে তাঁকে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যেতে থাকেন। আমার মা তখন আমার বাবার পিছু পিছু যাচ্ছিলেন, তখন অস্ত্রধারীরা মাকে পেছনে আসতে মানা করেন।
পরবর্তী সময়ে আমরা আমাদের এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পারি তাঁকে একটি কাদামাখা মিনিবাসে করে চোখ এবং হাত বেঁধে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এই সময় গাড়িতে পেছন দিকে হাত বাঁধা এবং চোখ বাঁধা অবস্থায় আরও অনেক ব্যক্তি ছিলেন।
আমার বাবাকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পূর্বেই তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, তাঁর সহকর্মী সাংবাদিক জনাব সিরাজুদ্দীন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, আ ন ম গোলাম মোস্তফাসহ আরও কয়েকজন সাংবাদিককে আলবদররা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি এ ব্যাপারে একটি নিউজ করেছিলেন বলে শুনেছি। আমরা অন্য অপহৃতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার পরিবারের সদস্যরা আমার বাবাসহ অন্যদের খোঁজ করতে থাকে। কিন্তু আমার বাবার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।’
প্রগতিশীল মুক্তবাক একজন মানুষ ছিলেন শহীদ সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদ। স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের ঠিক কদিন আগেই নির্মমতার শিকার হন তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে চলমান বর্বরতা অসীম সাহসে তিনি তুলে ধরেছেন বিশ্বের কাছে। এটিই কি ছিল তাঁর অপরাধ? কী নির্মমভাবে আক্রমণ ও হত্যা করা হয় তাঁকে! অসহায় স্বজনদের সামনে থেকেই তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এসবই উঠে এসেছে শহীদের সন্তান এই সাক্ষীর বেদনাবৃত উচ্চারণ থেকে। ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখের দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় “স্বাধীনতার সূর্যোদয় তিনি দেখে যেতে পারেননি” শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখতে পাই:
‘খুনে রাংগা সোনার বাংলায় স্বাধীনতার সূর্য দেখার সৌভাগ্য যাদের হয়নি সাংবাদিক জনাব নিজামুদ্দীন আহমদ তাঁদের অন্যতম।...জনাব আহমদকে ১২ ডিসেম্বর বিকেল দুটায় কুখ্যাত আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। গেস্টাপো আলবদর আলশামস বাহিনীর কলঙ্কিত বধ্যভূমি ও সম্ভাব্য স্থানে খোঁজ করেও তাঁর কোনো পাত্তা পাওয়া যায়নি।’ [রায়ের পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫ এ উদ্ধৃত]
সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের অপহরণ ও হত্যা
শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের ছেলে সুমন জাহিদ এই মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেন। এই অভিযোগটি প্রমাণের জন্য রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে ফিরে আসা একমাত্র মানুষ দেলোয়ার হোসেনও সাক্ষ্য প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে সুমন জাহিদের বয়স ছিল আট বছর। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ শহীদ সেলিনা পারভিনের পরিবারের সদস্যরা রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাঁর লাশ শনাক্ত করেন এবং তা উত্তোলন করে আজিমপুর কবরস্থানে সমাধিস্থ করেন। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের ছেলে সুমন জাহিদ বুকে একরাশ কান্না নিয়ে ট্রাইব্যুনালে বলেন:
‘১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ৮ বছর। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আনুমানিক দুপুর ১.৩০ মিনিট সময় আমি এবং আমার এক মামা (উজির) দুপুরের গোসল সেরে বাসার ছাদে অবস্থান করছিলাম। সে সময় মা রান্না করছিলেন। আমরা বুঝতে পারলাম বাসার সামনে কিছু গাড়ি এসে থেমেছে। তখন আমরা ১১৫, নিউ সার্কুলার রোডে (বর্তমানে ২৯ নম্বর শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিন সড়ক) থাকতাম।... কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাসার কলাপসিবল গেটে কড়া নাড়ানোর আওয়াজ পাই। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে তখন জাতীয় পরিষদ সদস্য (সংসদ সদস্য) অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সৈয়দ সালাউদ্দিন সাহেব থাকতেন। তখন তিনি কলাপসিবল গেটটির দরজা খুলে দেন। আগন্তুকেরা আমার মায়ের ফ্ল্যাট কোনটি জানতে চাইলে তিনি আমাদের ফ্ল্যাটটি দেখিয়ে দেন।...তখন আমাদের বাসার কড়া নাড়াবার আওয়াজ পাই। মা তখন দরজা খুলে দেন, তারা তখন মা’র পরিচয় জানতে চায়। আগন্তুকদের মধ্যে একজন তখন আমাদের দেখে ফেলে এবং বন্দুক তাক করে বলে হ্যান্ডসআপ। আমি এবং উজির মামা তখন হাত তুলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসি। তারা আমাদের পরিচয় জানতে চায়। মা তখন আমাকে দেখিয়ে বলে, “এ আমার ছেলে”, উজির মামাকে দেখিয়ে বলে, “আমার ছোট ভাই”। আগন্তুকেরা উজির মামাকে দেখিয়ে বলে, “ইয়ে মুক্তি হ্যায়।” এ সময় আমি মায়ের কাছে গিয়ে তাঁর আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন আগন্তুকেরা আমার মাকে বলে আপনাকে আমাদের সঙ্গে সেক্রেটারিয়েটে যেতে হবে। মা তখন বলেন, “আমার সঙ্গে তো কারফিউ পাস নেই, আমি কীভাবে যাব।” আগন্তুকেরা বলে, “আমাদের কাছে কারফিউ পাস আছে, অসুবিধা হবে না।” আমি মায়ের সঙ্গে যেতে চাইলে তারা বাধা দেয়, এদের মধ্যে একজন বলে, “বাচ্চা লোক নেহি জায়েগা, অন্দর মে যাও।” আগন্তুকেরা যারা এসেছিল তাদের মুখ মাফলার দিয়ে ঢাকা ছিল এবং হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তাদের ধমকে আমি এবং মামা ভয় পেয়ে দরজার কাছে চলে যাই। এই সময় মা আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন যে, “সুমন, তুমি মামার সঙ্গে খেয়ে নিয়ো, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসব।” এটাই ছিল আমার মায়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা। তখন আগন্তুকেরা মায়ের হাতে থাকা একটি গামছা দিয়ে মায়ের চোখ বেঁধে ফেলে এবং ওদের হাতে থাকা মাফলার জাতীয় একটি জিনিস দিয়ে মাকে পিঠমোড়া করে বাঁধে। এই অবস্থায় আগন্তুকেরা আমার মাকে কাদামাখা গাড়িটিতে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। আমরা তাঁর আর কোনো খবর পাইনি।
এরপর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে শহীদ মুনীর চৌধুরী ও কবীর চৌধুরীর ভাই শমসের চৌধুরীর কাছ থেকে আমার মেজ মামা এবং উজির মামা জানতে পারেন, রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে আমার মায়ের লাশ পড়ে আছে। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সেই লাশ সেখান থেকে উজির মামা এবং মহসিন মামা শনাক্ত করে তা উত্তোলন করে আজিমপুর নতুন কবরস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের পাশে দাফন করেন।’
এই সাক্ষীর সাক্ষ্যে যে নির্মম সত্য উঠে এসেছে তা হলো একজন নারী যিনি মাতৃজাতির একজন, তাঁকেও বর্বররা রেহাই দেয়নি। শিশুপুত্র অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখেছে তার মা’কে বেঁধে নিয়ে যেতে। কদিন পর সেই অসহায় শিশুর মায়ের লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে খুঁজে পাওয়া যায়। কী নির্মমতা! ট্রাইব্যুনাল রায়ে পর্যবেক্ষণ দেন যে, এটি কেবল সেলিনা পারভিনকে হত্যা ছিল না, এটি ছিল মাতৃজাতি হত্যা যা ‘ম্যাট্রিসাইড’। মানব বিবেককে এটি আঘাত করেছে। আজ এই নির্মম সত্যটি সবাই জানুন। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের প্রতি চরম নির্মমতার প্রতিফলন দেখতে পাই ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। এখানে বলা হয়—
“বেগম সেলিনা পারভিনের লাশ মোহাম্মদপুর রায়েরবাজারের বিলের বধ্যভূমিতে তাঁহার ক্ষতবিক্ষত লাশ গত শনিবার পাওয়া গিয়াছে। গত ১৪ ডিসেম্বর বেলা ২টায় বেগম সেলিনা পারভিনকে জামায়াতে ইসলামীর গুন্ডা বাহিনী আলবদরের জল্লাদেরা তাঁহার সিদ্ধেশ্বরীর বাসভবন হইতে ধরিয়া নিয়া যায়।...বেগম সেলিনা পারভিনের ডান চোয়ালে দুটি গুলির আঘাত ও পেটে বেয়নেটের আঘাত রহিয়াছে।” [রায়ের পৃষ্ঠা-১০৮ এ উদ্ধৃত]
আগামীকাল ছাপা হবে: শিক্ষকদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান: হাইকোর্টের বিচারপতি