মতামত

নারী নিগ্রহের প্রতিবাদের ধারা বাংলাদেশে কেমন হওয়া উচিত?

নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাকের কারণে তরুণীকে হেনস্তার ঘটনায় ২০ জন তরুণ-তরুণীর একটি দল সেখানে গিয়ে প্রতিবাদ জানান
ছবি: প্রথম আলো

২০২২ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবের আসরে এক নারীর নগ্ন প্রতিবাদ বিশ্বের পত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল। প্রতিবাদটির লক্ষ্য ছিল সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ। নগ্নিকার উন্মুক্ত বক্ষে ও শরীরে ইউক্রেনের ম্যাপ আঁকা। স্লোগানে সরাসরি দাবি উৎকীর্ণ রয়েছে, ‘ইউক্রেনে ধর্ষণ বন্ধ করো’। এই একক প্রতিবাদের শক্তির দিকটি অসামান্য। বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে সভা-সমাবেশ-প্রতিবাদ ব্যানার ফেস্টুনে যে দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে গলদঘর্ম হতেন, একজন নারী তা কয়েক সেকেন্ডে বিশ্বের নজরে এনেছেন। এই সাহসী হৃদয়বৃত্তিক প্রতিবাদের আসর রাস্তাঘাটও নয়, কানের আলোঝলমল আসর। প্রতিবাদটির মাধ্যমে তারকাজগতের রথী মহারথীদেরও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ইউক্রেনে নারীর বিরুদ্ধে যৌনাপরাধের প্রতিবাদে তোমাদেরও দায় এবং দায়িত্ব আছে।

প্রতিবাদের ভাষার এমন সজ্ঞান স্থান-কাল-পাত্র ও উপস্থাপনের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে জনজোয়ারের বড় কৃতিত্ব নূর হোসেনের বুকে-পিঠে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। প্রতিবাদের ভাষার কী অসামান্য শক্তি! বক্তব্যটি বুঝতে কোনো শিশুরও কষ্ট হয়নি। যেমনটি বুঝতে কষ্ট হয়নি কানের ওই নারীর আর্তি-আর্তনাদে তুলে ধরা দাবি। দুটি প্রতিবাদেরই উদ্দেশ্য সহজ-সরল-অকপট। ফলাফল সার্থকতা।

স্থান-কাল-পাত্র ও উপস্থাপনা যথাযথ না হলে অনেক সময় আন্দোলন যথাযথ ফল দেয় না। যেমন ২০১৮ সালে বার্সেলোনায় ‘প্রাণী অধিকার সুরক্ষা’ আন্দোলনের কর্মীদের একদল গায়ে রং মেখে স্লোগান এঁকে নগ্ন প্রতিবাদ করে। শীতপ্রধান দেশে পশমি কোট বানানোর জন্য প্রাণী নিধন করা হচ্ছে। তারই রূপক প্রতিবাদে তাঁরা পোশাকমুক্ত দেহের প্রতিবাদে নামেন। বহুজাতিক পোশাক নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কথা বললেন। ন্যায্য দাবি হওয়ার পরও এই আন্দোলন তেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। পশ্চিমা দেশের টেলিভিশন-রেডিওর কমেডি শোতেও এ নিয়ে তির্যক হাস্যরস দেখেছিলাম। কানাডার এক রেডিও টকশোতে এসে একজন কোনোভাবেই মানছিলেন না যে এটা পশু রক্ষার পক্ষে প্রতিবাদ হয়েছে। তিনি বারবার একই কথাই বলছিলেন, এটি তো পোশাকের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। পশু নিধনের প্রতিবাদ হলো কীভাবে?

২০১১ সালের শুরুতে কানাডার টরন্টোতে এক পুলিশ অফিসার ধর্ষণ বন্ধ করার উপায় হিসেবে বলেন, নারীদের ধর্ষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেহপসারিণীদের (স্লাটস) মতো পোশাক পরা ছাড়তে হবে। ধর্ষণ সম্পর্কে এরূপ ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ বা ‘ক্ষতিগ্রস্তকে দোষারোপ’ একটি বিশ্বজনীন সমস্যা। এর প্রতিবাদে ২০১১ সালের এপ্রিলের ১১ তারিখ থেকে কানাডায় ‘স্লাটওয়াক’ (দেহপসারিনীদের সাজে হাঁটা-প্রতিবাদ) শুরু হয়। উদ্দেশ্য মহৎ। মানুষের এই ভুল ভাঙানো যে পোশাক সমস্যা নয়, ‘মেইল গেইজ’ বা পুরুষালি কুদৃষ্টিই সমস্যা। দেহপসারিণীরাও মানুষ, এই সম্মানবোধ তৈরি আরেক উদ্দেশ্য। প্রতিবাদকারিণীগণ দেহজীবীদের অনুকরণে সাজপোশাকের মাধ্যমে প্রতিবাদটি শুরু করেন।

প্রতিবাদে ব্যাপক জনসংযোগের ও জনসমর্থনের প্রয়োজন। জনসমর্থনের বদলে জনবিরাগ তৈরি করা হলে প্রতিবাদের মূলেই কুঠারাঘাত করা হয়। সমাজভাবনাহীন তত্ত্বীয় আদর্শবাদের বাড়াবাড়ি নারীবাদী আন্দোলনের ক্ষতির কারণ বলে মনে হয়।

এ ধরনের প্রতিবাদে কতটুকু সাফল্য মেলে বা আদৌ মেলে কিনা সে প্রশ্ন উঠেছে। ইস্যুটির প্রতি সমর্থন থাকলেও আন্দোলনের ধরনের কারণে সমর্থন কমে যায় কিনা সেই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, যে অসম্মানের প্রতিবাদ করা হচ্ছে, সাজগোজ ও দৃশ্যায়নের মাধ্যমে, সেই অসম্মানেরই পুনঃ উপস্থাপন (রিপ্রেজেন্টেশন) হয়ে যাচ্ছে না তো? ‘মেইল গেইজ’-এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেটিকেই উসকে দেওয়া হচ্ছে না তো?

১৯৯৯ সালে সিয়াটলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনকালে কী ঘটেছিল মনে করা যাক। সমাজতন্ত্রী ও মানবতাবাদী চিন্তার কর্মীরা বক্তৃতায়, গণসংগীতে, পোস্টার-প্ল্যাকার্ড-স্লোগানে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে দারুণ ইতিবাচক জনমত তৈরি করে ফেললেন। হঠাৎ একদল নারীর মনে হলো, বিশ্ব গণমাধ্যমে তোলপাড় তুলতে হবে। তৃতীয় বিশ্বের পোশাক কারখানায় নারীর শ্রমশোষণের প্রতিবাদে উন্মুক্ত বক্ষে বিক্ষোভ করা হলে নজর কাড়া যাবে। পুরুষ বিক্ষোভকারীরাও আইন ভাঙা, শো-অফ, শোডাউনে নেমে পড়লেন। ফল হলো একেবারেই উল্টো। সম্ভবত এমন একটি ছুতোর অপেক্ষাতেই ছিল পুলিশ বাহিনী। শৃঙ্খলা রক্ষার নামে তারা দানবের শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারল। বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ হলো। আন্দোলন মিইয়ে গেল। কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হলো। সবচেয়ে ক্ষতির বিষয় হলো ‘অসমর্থনযোগ্য’, ‘বিশৃঙ্খলা’ ও ‘উগ্র আচরণ’ মনে করে অনেকে এই আন্দোলন থেকে সরে গেল। টেলিভিশন-রেডিওর টকশোতেও হাওয়া ঘুরে গেল।

এসব অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে আমরা মনে হয়, প্রতিবাদে ব্যাপক জনসংযোগের ও জনসমর্থনের প্রয়োজন। জনসমর্থনের বদলে জনবিরাগ তৈরি করা হলে প্রতিবাদের মূলেই কুঠারাঘাত করা হয়। সমাজভাবনাহীন তত্ত্বীয় আদর্শবাদের বাড়াবাড়ি নারীবাদী আন্দোলনের ক্ষতির কারণ বলে মনে হয়। এ প্রসঙ্গে ব্রা পোড়ানো আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যায়।

ষাটের দশকে সারা পৃথিবীতেই সমাজ পরিবর্তনের ও সমাজভাবনার উদ্দাম জোয়ার তৈরি হয়েছিল। অসংখ্য পুরুষ নারীবাদী আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে সহযোদ্ধা হতে এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু উগ্র পুরুষবিদ্বেষ নারীবাদী আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিষয়ে অনেককে সন্দিহান করে তুলল। দেখা গেছে পুরুষদের এক বড় অংশ নারীবাদী আন্দোলনের সহযোদ্ধা হতে নিরুৎসাহিত হয়।
সেই প্রতিবাদে শামিল নারীগণ প্রচার করলেন, বক্ষবন্ধনী নারীর বন্দিত্বের চিহ্ন, অধস্তনতা ও পুরুষের ভোগের বস্তু হয়ে থাকার প্রতীক। নারী-পুরুষের চোখে কাম লালসা ও ভোগের বস্তুমাত্র। ব্রা নারীর বক্ষকে সুডৌল রাখে। তাতে শুধু পুরুষেরই মনোরঞ্জন ও দৃষ্টিরঞ্জন হয়। তাই বক্ষবন্ধনী পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে একধরনের প্রতিবাদের দৃশ্যায়ন করা যেতে পারে।

১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে মিস আমেরিকা প্রতিযোগিতাকালে আন্দোলনটি ‘ফ্রিডম ট্র্যাশ ক্যান’ (স্বাধীনতার ময়লা-ঝুড়ি আন্দোলন) নাম নিয়ে আরও বাড়বাড়ন্ত হয়। আসরস্থলের বাইরে ২০০ নারী ও মানবাধিকারকর্মী ব্রা পুড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও নারীর মেকআপ বা সৌন্দর্য বর্ধনের সব তৈজসপত্র ময়লার ঝুড়িতে ফেলতে থাকেন। প্রতিবাদটি ছিল রূপক। পেছনের তাত্ত্বিক বোধও মন্দ ছিল না। কিন্তু প্রতিবাদের মতো জনসম্পৃক্ত বিষয়ে এটা মনে রাখা জরুরি যে সাধারণ মানুষের বিদ্যাবুদ্ধিতে সহজে কুলায় তেমন প্রতিবাদ ছাড়া জনসমর্থন জোটানো কঠিন।

সম্প্রতি নরসিংদী রেল স্টেশনে পোশাকের কারণে নারী হেনস্তার ন্যক্কারজনক যে ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে যে মাত্রায় প্রতিবাদ হওয়ার কথা ছিল দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। এ ধরনের ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি বলে মনে করি। একটি গ্রুপ নরসিংদীতে গিয়ে ফটোশুটের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছে। তাঁদের উদ্দেশ্য মহৎ এবং তাঁরা যে প্রতিবাদ করেছেন সে জন্য সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে নিরাপদ ও প্রদর্শনমুখী এ ধরনের প্রতিবাদ বাংলাদেশের নারী আন্দোলনকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যাবে সে প্রশ্ন থেকে যায়।

আমি মনে করি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এখনো পশ্চিমা ধারার রূপক আন্দোলনের উপযোগী হয়ে ওঠেনি মোটেও। বরং নরসিংদীর মতো ঘটনায় বাংলাদেশের প্রচলিত পদ্ধতির প্রতিবাদই বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে যদি ব্যানার-প্ল্যাকার্ড-বক্তৃতা বা মানববন্ধন করা যেত তা হলে জনমনে প্রভাব বিস্তারের কাজটি ভালোভাবে হতো। তা ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ধর্মালয়ে সচেতনতা তৈরির কর্মসূচি শুরু করা যেত। খোদ পশ্চিমেই যখন রূপকাশ্রয়ী প্রতিবাদগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে তখন আমাদের উচিত প্রতিবাদের বাস্তবানুগ স্বদেশি ধারা ও ধরন নির্ধারণ করা।

  • হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।