কয়েক দিন আগে গাজীপুরের শিমুলতলী থেকে বাসে চড়ে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন রওশন আরা (ছদ্মনাম)। তিনি উত্তরায় একটি ব্যাংকে কাজ করেন। বাসে ওঠার কিছুক্ষণ পরই তিনি বুঝতে পারেন পেছনের সিটে বসা তরুণ এক যাত্রীর চোখ তাঁকে অনুসরণ করছে। কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই তিনি ঢাকায় পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু আচমকা পেছনের সিটে বসা ছেলেটির হাত তাঁর পিঠে আঁচড় বসিয়ে দিল। আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। রাগে-দুঃখে নিজের ওপর যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন রওশন আরা। মুহূর্তেই শার্টের কলার চেপে ধরে কষে চড় বসালেন ছেলেটির গালে।
হঠাৎ বাসে এ দৃশ্যের অবতারণা দেখে এগিয়ে এলেন কেউ কেউ। রওশন আরা সবাইকে ঘটনাটি জানালেন। কিন্তু বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন, যখন দেখলেন বাসের একজন যাত্রীও তাঁর পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো সমর্থন করে বসলেন নির্যাতনকারী ছেলেটিকেই। কেউ বলল, ‘পাবলিক বাসে এক-আধটু এসব হয়েই থাকে’; কেউ বলল, ‘এই বয়সের ছেলেরা একটু দুষ্টামি করেই’; কেউবা বলল, ‘একটুতেই এত গায়ে লাগলে পাবলিক বাসে চড়েছেন কেন?’ এ রকম কত-কী! কেউ আবার প্রশ্ন তুললেন তাঁর পোশাক নিয়ে। এ ধরনের মন্তব্যে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে গেলেন রওশন আরা। এমনকি একজন নারীও তাঁর পক্ষে কথা বললেন না। নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় মনে হলো। রাগ, ভয়, আতঙ্ক আর অস্বস্তিতে কাঁপতে কাঁপতে তিনি অবশেষে অফিসে পৌঁছালেন।
রওশন আরা নামটি ছদ্ম হলেও অভিজ্ঞতাটি কিন্তু বাস্তব। প্রতিদিন হাজারো রওশন আরা গণপরিবহনে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। ব্র্যাকের প্রতিবেদন বলে, গণপরিবহন ব্যবহারকারী নারীদের ৯৪ শতাংশই কখনো না কখনো যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিছুদিন আগে গণপরিবহনে নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে একটি গবেষণার প্রয়োজনে বেশ কিছু নারীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছিলাম, যেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ নারীই গণপরিবহনে যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন, সেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ পুরুষই এ ধরনের ঘটনা নিজেরা ঘটাননি বলে জানিয়েছিলেন। এমনকি এ ধরনের ঘটনা নাকি তাঁরা কখনো প্রত্যক্ষও করেননি।
কেউ কেউ বলেছিলেন, নারী বাড়ির বাইরে ঘুরে বেড়ালে নির্যাতনের শিকার হবেন—এটাই স্বাভাবিক। কেউবা নারীর পোশাককে দায়ী করেছিলেন, কেউ আবার নারীদের জন্য পৃথক গণপরিবহনের সুপারিশ করেছেন। অর্থাৎ হয় পুরুষ নিজের অপরাধকে এড়িয়ে গেছেন, অথবা পরোক্ষভাবে নারীর প্রতি এ ধরনের নির্যাতনকেই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেছেন। শুধু গণপরিবহনে নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রেই যে ধারণাগুলো প্রচলিত, তা কিন্তু নয়। ঘরে–বাইরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে, প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতার মূলে কাজ করে অপরাধকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রবণতা, অপরাধী হিসেবে নিজেকে মেনে না নেওয়া এবং ভিকটিম ব্লেমিং কালচার।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে তাঁদের সুরক্ষা নিয়ে যত কথা হয়, পুরুষের আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে সেভাবে কথা বলতে শুনি না। অথচ সহিংস আচরণের প্রতি পুরুষের অজ্ঞতা ও নির্লিপ্ততা নারী নির্যাতনের সবচেয়ে বড় কারণ। সত্যিকার অর্থে নারীর প্রতি সহিংসতা তখনই কমতে শুরু করবে, যখন পুরুষ তাঁর সহিংস আচরণকে চিনতে শিখবেন এবং সেই আচরণের জন্য অনুতপ্ত হবেন।
মানসিক নির্যাতন তো দূরের কথা, নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা যে একটি গুরুতর অপরাধ, এ ব্যাপারে ধারণাই নেই অনেক পুরুষের, এমনকি অনেক নারীরও। স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক বলে মনে করেন অনেক নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাল্টিপল ইন্ডিকেটর সার্ভে ২০১৯-এ উঠে এসেছে, দেশের প্রতি চারজন বিবাহিত নারীর একজন স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক বলে মনে করেন। অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের এ মানসিকতা যে শুধু পুরুষকেই অপরাধী হিসেবে গড়ে তুলছে, তা কিন্তু নয়; বরং তা নারীর মধ্যেও পুরুষের অপরাধকে যৌক্তিক বলে মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করছে।
সরকারি হিসাবেই বাংলাদেশের ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ নারী পারিবারিক পরিসরে স্বামী বা ঘনিষ্ঠজন কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হন। এ নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতন। অবাক করা বিষয় হলো নির্যাতনকারী পুরুষের অধিকাংশই এসব নির্যাতনকে নির্যাতন হিসেবে স্বীকারই করেন না; বরং যেকোনো উপায়ে স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণে রাখাকেই তাঁরা তাঁদের অধিকার বলে মনে করেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের এ ধরনের অপরাধের জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিবছর এ দেশের হাজার হাজার নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট অপরাধ করার পরও অধিকাংশ ধর্ষকই অনুতপ্ত হয় না। ধর্ষণের জন্য ধর্ষণের শিকার নারীকেই অভিযুক্ত করে এবং তার নিজের অপরাধের পক্ষে সাফাই গায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজের অনেককেই ধর্ষকের পক্ষে অবস্থান নিতে দেখি এবং পুরুষকে প্রলুব্ধ করার জন্য উল্টো নারীকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
অবাক লাগে, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে তাঁদের সুরক্ষা নিয়ে যত কথা হয়, পুরুষের আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে সেভাবে কথা বলতে শুনি না। অথচ সহিংস আচরণের প্রতি পুরুষের অজ্ঞতা ও নির্লিপ্ততা নারী নির্যাতনের সবচেয়ে বড় কারণ। সত্যিকার অর্থে নারীর প্রতি সহিংসতা তখনই কমতে শুরু করবে, যখন পুরুষ তাঁর সহিংস আচরণকে চিনতে শিখবেন এবং সেই আচরণের জন্য অনুতপ্ত হবেন। কোন আচরণটি ক্ষতিকর, এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে কখনোই পুরুষের মনে জন্ম নেবে না অপরাধবোধ। আর অপরাধকে চিনতে না শিখলে অপরাধমুক্ত থাকার চিন্তা জন্ম নেবে কীভাবে! তাই নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে খুব বেশি প্রয়োজন নারীর প্রতি সহিংস আচরণ সম্পর্কে পুরুষের সঠিক ধারণা।
নারীর প্রতি পুরুষের সহিংস আচরণ কীভাবে পুরুষকে অমানবিক ও হিংস্র করে তুলছে, সে সম্পর্কেও তাঁদের জানাতে হবে; জানাতে হবে কোনটি তাঁর অধিকার আর কোনটি অপরাধ। সহিংস আচরণের জন্য পুরুষকে লজ্জিত ও অনুতপ্ত করানোই হতে পারে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের প্রথম সোপান। তাই আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি পুরুষের মানসিকতা আর আচরণগত পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা ও কর্মতৎপরতা প্রয়োজন। নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণগত পরিবর্তনে একযোগে কাজ করতে হবে। কাজটি কঠিন, সন্দেহ নেই। তবে অবিলম্বে কাজটি শুরু করাটা খুব জরুরি।
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
purba_du@yahoo.com