কিছুদিন আগে উদ্যাপিত হলো আন্তর্জাতিক মা দিবস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেয়ে গেছে মায়েদের ছবিতে। মায়ের প্রতি শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হৃদয়গ্রাহী নানান পোস্ট দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের মতো সমাজব্যবস্থায় মা দিবসের মতো দিবসগুলো ঘটা করে উদ্যাপনের পক্ষে-বিপক্ষে আছে নানা যুক্তিতর্ক। মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের এই উৎসবকে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকলেও স্ট্যাটাসে ফুটে ওঠা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বিষয়টি হয়তো মিথ্যা নয়। মা দিবসে স্ট্যাটাস দেওয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর মধ্যে যেমনি নারী আছেন, তেমনি আছেন পুরুষ।
অবাক লাগে, যে নারী ‘মা’ হিসেবে পুরুষের কাছে এতটাই শ্রদ্ধেয় ও আদরণীয়, সে নারীই স্ত্রী কিংবা অন্য অনেক ভূমিকায় অধিকাংশ পুরুষের কাছে নিগৃহীত, অপমানিত আর অসম্মানিত। তা না হলে ৭০ শতাংশ নারী আজ পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হতেন না, হাজারো নারী প্রতিবছর ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হতেন না। যে পুরুষ মায়ের ভূমিকায় থাকা একজন নারীকে সম্মান জানিয়ে প্রায় দেবীর আসনে বসাচ্ছেন, সেই একই পুরুষ নারীকে বিবস্ত্র করছেন, ধর্ষণ করছেন, শারীরিক আঘাতে জর্জরিত করছেন।
পুরুষের কর্তৃত্ববাদী আচরণের মূলটি এতটাই গভীরে প্রোথিত থাকে যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ পুরুষই এর চর্চা করেন জ্ঞাতসারে কিংবা নিজের অজ্ঞাতে। ‘প্রকৃতিগতভাবেই কর্তৃত্বের অধিকারী’ হিসেবে জানা আত্মবিশ্বাসী পুরুষের পক্ষে যোগ্যতাসম্পন্ন নারীকে মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব।
ফেসবুক ওয়ালে মাকে ভালোবেসে পোস্ট দেওয়া কোনো পুরুষই হয়তো ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় নারীর প্রতি ছুড়ে দিচ্ছেন সহিংস, নোংরা ও কদর্য মন্তব্য। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এই প্রকাশের মধ্যেও লুকিয়ে আছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজসৃষ্ট কোনো রাজনীতি, যার সুফল ভোগ করছেন পুরুষ?
নারীর প্রতি পুরুষের নেতিবাচকতা, এমনকি প্রচণ্ড ঘৃণা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় সহিংসতার নানা খবরের শিরোনামে, গণপরিবহনে কিংবা উন্মুক্ত স্থানে যৌন হয়রানির ঘটনায়, অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদের মন্তব্যের ঘরে কিংবা নারীর ছবির সঙ্গের ক্যাপশনে আর মন্তব্যে। এমনকি যে ছবি কিংবা লেখার সঙ্গে নারী প্রসঙ্গ অবতারণার কোনো কারণ নেই, সেখানেও অবলীলায় নারীকে গালিগালাজ করা হয়, নারীর প্রতি অশ্লীল মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া হয়।
এর কারণ কি নারীর প্রতি পুরুষের অবদমিত বিকৃত কামনা নাকি নারীর প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা? সমাজে নারীর প্রতি ঘৃণার মানসিকতা লালন ও তা প্রকাশের প্রচলিত ধারণাকে ইংরেজিতে ‘মিসোজিনি’ বলে; যেখানে নারীরা শুধু নারী হওয়ার অপরাধে ঘৃণা কিংবা বৈরিতার মুখোমুখি হন। যাঁরা মিসোজিনিস্ট তাঁরা মনের গভীরে শুধু নারীর জন্য ঘৃণাই পোষণ করেন না, তাঁরা একাধারে নারীর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেন, নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, এমনকি নারীকে অভিসম্পাত দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।
শুধু পুরুষেরাই যে এই ধারণার লালন এবং চর্চা করেন, তা কিন্তু নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোতে অনেক নারীও একই ধারণার ধারক, বাহক এবং প্রচারক। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ভূমিকার ব্যতিক্রমী কোনো ভূমিকায় কিংবা বেশভূষায় নারীর উপস্থিতি দেখলেই নিজেরা নারী হয়েও তারা অন্য নারীর জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন এমনকি প্রতিহিংসাপরায়ণও হয়ে ওঠেন।
অনেক ধর্মস্থানে এবং পবিত্রস্থানে নারীর প্রবেশাধিকারের ওপর আছে নিষেধাজ্ঞা কিংবা নিয়ন্ত্রণ। নারীর প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ ও উদাসীন একটি সমাজে কম গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অনুভূতি নিয়ে বেড়ে ওঠেন নারীরা। এখানে নারীর প্রতিটি কাজের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয় সমাজনির্ধারিত ভালো-মন্দের মানদণ্ডে। নারীর যে কাজ পিতৃতন্ত্রকে উপেক্ষা কিংবা চ্যালেঞ্জ করে সে কাজেই আসে বাধা, সে কাজই হয়ে ওঠে মন্দ কাজ। আর সে নারীটিই সমাজে ঘৃণা কিংবা বৈরিতার মুখোমুখি হন, প্রতিপন্ন হন মন্দ নারী হিসেবে।
আর যে নারীটি প্রত্যাশিত চিরাচরিত ভূমিকায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন এবং পিতৃতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন, তিনি ভালো নারীর স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি সমাজের কাছে প্রত্যাশিত এবং সম্মানিত। ভালো মা কিংবা ভালো স্ত্রী হওয়ার তাগিদটির উৎপত্তি হয় মূলত সমাজ প্রত্যাশিত ভালো নারীর বৈশিষ্ট্যগুলো থেকেই। নারীর ভালো হওয়া এবং মন্দ হওয়া সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে আমরা কীভাবে তাঁদের মূল্যায়ন করি এবং আমরা কোন ভূমিকায় কীভাবে তাঁদেরকে দেখতে চাই।
সমাজের চোখে প্রথাগত ভালো নারী-পুরুষের আরাম-আয়েশের পথটি প্রশস্ত করেন এবং তাঁর কর্তৃত্ববাদকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হন। প্রশ্ন হলো, এই মানসিকতার থেকে উত্তরণের উপায় কী? আসলে অনেক সমস্যার সোজাসাপটা সমাধান দেওয়া কঠিন। আর সমস্যাটি যখন মানুষের বিশ্বাস আর সামাজিক প্রথার ওপর ভিত্তি করে আবর্তিত হতে থাকে, তখন সমস্যা থেকে উত্তরণের সন্ধান দেওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়ে। সমাজ ও সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল।
আশার কথা, এখন অনেক ভূমিকায় নারীর অংশগ্রহণকে মেনে নেওয়া হচ্ছে, স্বীকৃতিও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তারপরও অনেক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যখন পুরুষের কর্তৃত্ববাদকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় তখন নারীর এই অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার নানা চেষ্টা করা হয়। আর সহিংসতাই হয়ে ওঠে নারীকে থামানোর একমাত্র হাতিয়ার।
সেই সহিংসতা হতে পারে শারীরিক, মৌখিক কিংবা লেখার হরফে। পুরুষের কর্তৃত্ববাদী আচরণের মূলটি এতটাই গভীরে প্রোথিত থাকে যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ পুরুষই এর চর্চা করেন জ্ঞাতসারে কিংবা নিজের অজ্ঞাতে। ‘প্রকৃতিগতভাবেই কর্তৃত্বের অধিকারী’ হিসেবে জানা আত্মবিশ্বাসী পুরুষের পক্ষে যোগ্যতাসম্পন্ন নারীকে মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই ক্ষমতা বণ্টনের মুখোমুখি হয়ে অনেক পুরুষ অসহিষ্ণু ও মারমুখী হন এবং ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তাঁরা অধিকতর কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন।
সময় বলে নারীর এই অগ্রযাত্রা অনিবার্য ও অবধারিত। তাই এই বাস্তবতায় নারীর পরিবর্তিত ভূমিকা ও অংশগ্রহণকে মেনে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সহিংসতা শুধুই জন্ম দেবে সহিংসতার, ঘৃণা ছড়াবে শুধুই প্রতিহিংসা। তাই সুখের দেখা পেতে চাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং নারীর অস্তিত্বের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সম্মানের মধ্যে। কারণ, ভালোবাসা দিয়েই ভালোবাসা জয় করতে হয়, অন্যকে শ্রদ্ধা করেই শ্রদ্ধা আদায় করতে হয়।
নিশাত সুলতানা, লেখক ও উন্নয়নকর্মী। purba_du@yahoo.com