গণপরিবহনে যৌনবিকারে ভোগা পুরুষের আচরণ থেকে নারীকে নিরাপদ রাখার চিন্তাভাবনা থেকে বেসরকারি উদ্যোগে মহানগরীতে এসেছে নতুন বাস সার্ভিস ‘দোলনচাঁপা’। ভারি সুন্দর নামটি! ‘দোলনচাঁপা’ নামটি শুনলেই মনে আসে স্নিগ্ধ সুবাস ছড়ানো শুভ্র সৌন্দর্যের অধিকারী কমনীয় ফুলটির কথা। নারীদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিসের বিষয়টি প্রায়ই আমার মনে একটি ছবির জন্ম দেয়। সেই ছবিতে আমি দেখতে পাই, সিংহরূপী পুরুষে পরিপূর্ণ ‘মহানগর’ নামক একটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে হরিণরূপী নারী বহনকারী চলমান একটি খাঁচা। ভয় হয়, এই খাঁচার দুয়ার কোনোভাবে সামান্য আলগা হলেই নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না তো কতিপয় বিকৃত পুরুষের দল?
মহানগরীতে নারী বাস সার্ভিস নতুন কোনো বিষয় নয়। বিআরটিসি বেশ কয়েক বছর আগেই চালু করেছে এই সার্ভিস। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, রাজধানীতে বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার বাস চলাচল করে। এই সাত হাজার বাসের মধ্যে নারীদের জন্য রয়েছে মাত্র ১৭টি বাস! নিতান্তই হাস্যকর একটি সংখ্যা। ১৩টি রুটে দ্বিতল বাসসহ যে মোট ১৭টি বিআরটিসি নারী বাস রোজ চলাচল করে, তার সব কটির গন্তব্যই মতিঝিল। তবে বাংলাদেশে এই প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে নারী বাস সার্ভিস চালু হলো; যার ব্যবস্থাপনায় রয়েছে র্যাংগস গ্রুপ। আপাতত ১০টি বাস নিয়ে সার্ভিসটি চালু হলেও ধীরে ধীরে বাসের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে কর্তৃপক্ষের। এই উদ্যোগ নিশ্চিতভাবেই ভুক্তভোগী নারীদের আপাত স্বস্তি দেবে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে মনে, বাসের সংখ্যার বৃদ্ধি গণপরিবহনে নারীর প্রতি হয়রানির মূল জায়গাটিতে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে তো! বাস্তবতা এই যে সরকারি কিংবা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় নারীর জন্য পৃথক পরিবহনের চাহিদাকে পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। এই যদি হয় বাস্তবতা, তবে শুধু শুধু কেন এই আয়োজন! বরং নারী-পুরুষের পাশাপাশি অবস্থানের মধ্যেই সমাধান খোঁজাটা জরুরি নয় কি? বাংলাদেশ উদারপন্থী ও প্রগতিশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নারী ও পুরুষের এই ধরনের পৃথক যাতায়াতব্যবস্থা দেশের ভাবমূর্তির জন্য কতটুকু অনুকূল, সেটিও তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। অন্যদিকে, সংবেদনশীল এবং বিবেকবান পুরুষের কাছে এই ধরনের উদ্যোগ যে কী লজ্জা ও অপমানের, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুবাদে লক্ষ করেছি সেসব দেশের গণপরিবহনে নারী-পুরুষের সহযাত্রা। বিশেষ করে তুরস্কে জনাকীর্ণ বাসের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। সেখানে দেখেছি নারী ও পুরুষকে গণপরিবহনে ঠাসাঠাসি করে যাতায়াত করতে। কিন্তু এই ধরনের হয়রানির আশঙ্কা নিজের বেলায় যেমন অনুভব করিনি, ঠিক তেমনি তা চোখে পড়েনি নারী যাত্রীদের আচরণে বা চলাফেরায়।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে ‘এডুকেশন ওয়াচ-২০১৭’ গবেষণা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। ‘বিদ্যালয়ে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ: শিক্ষায় প্রাণের উজ্জীবন’ শিরোনামে এই গবেষণার একটি তথ্য ছিল উল্লেখ করার মতো। সেখানে বলা হয়েছে, পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে ছেলে ও মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই প্রস্তুত করতে হলে বিদ্যালয়ে সহশিক্ষার ব্যবস্থা থাকা দরকার। অর্থাৎ, প্রতিবেদনটিতে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক স্কুলব্যবস্থার পরিবর্তে সহশিক্ষাদানের ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তথ্যটি আমাদের পরিষ্কারভাবেই ধারণা দেয় যে নারী আর পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা নারী আর পুরুষের পারস্পরিক ও স্বাভাবিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরির ক্ষেত্রে অন্তরায়। এই সমাধান শুধু যে শিক্ষাক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা কিন্তু নয়; বরং নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জীবনের প্রতিটি স্তরে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োজন নারী-পুরুষের সহাবস্থান। গণপরিবহনের বেলায়ও বিষয়টি আলাদা নয়। নারী ও পুরুষের পৃথক যাতায়াত ব্যবস্থা অপরাধের দৃষ্টান্ত সাময়িকভাবে কমালেও সমস্যার মূলে পৌঁছাতে পারবে না। ফলে তা সমস্যার সমাধান না করে বরং এড়ানোরই নামান্তর।
সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৯৪ শতাংশ নারী গণপরিবহনে কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রয়োজনীয় রুটে বাসের অভাব আর অফিস সময় বাদে অন্য সময়ে নারী বাস সার্ভিসের গণসার্ভিসে রূপান্তরের বাস্তবতা মাথায় রেখেই ঢাকায় বসবাসরত মোট নারীর প্রায় ২১ শতাংশ রোজ গণপরিবহন ব্যবহার করছেন। এই বলিষ্ঠ, দৃঢ়চেতা ও হার না-মানা নারীদের জন্য আলাদা খাঁচা তৈরির কোনো প্রয়োজন আছে কি? বরং প্রয়োজন সেই সব বিকৃত পুরুষ পশুর আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন। নতুন করে নারী বাস সার্ভিস সংযোজনের বদলে প্রয়োজন চলমান বাসগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ এবং বাস অবকাঠামোর সংশোধন করা, যেন তা অধিকতর নারীবান্ধব হয়ে উঠতে পারে। এ ছাড়া প্রয়োজন সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং সন্ধ্যায় বাসে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা। অধিক হেল্পলাইন নম্বরের ভিড়ে ভুক্তভোগীকে বিভ্রান্ত না করে গণপরিবহনে নারীর হয়রানির অভিযোগ জানানোর জন্য প্রয়োজন একটি মাত্র কার্যকর হেল্পলাইন নম্বরের প্রচলন করা। শুধু দোলনচাঁপা বাস নয়, প্রয়োজন প্রতিটি বাসে সিসি ক্যামেরার উপস্থিতি।
পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তনই পারে গণপরিবহনকে নারীবান্ধব করে তুলতে। আইনের কঠোর প্রয়োগ এ সমস্যা সমাধানে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে বটে, তবে সমস্যার মূল উৎপাটনে পুরুষের মানসিকতার ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া আরও প্রয়োজন যৌন হয়রানির ঘটনায় নীরব না থেকে বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ জানানো। নারীর নিরাপদ পথচলা পুরুষের দয়ার দান নয়, বরং এটি নারীর অধিকার।
নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক।
purba_du@yahoo.com