নানা কারণেই, তবে বিশেষত পুরুষ জাত্যভিমানের কারণে ভারতীয় সংসদে উইমেন রিজার্ভেশন বিল পাস হয়নি। ১৯৯৬ সালে যখন দেব গৌড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন এই খসড়াটি সংসদে প্রথম পেশ করা হয়। এই খসড়াটি সংসদে যতবার পেশ করা হয়েছে, ততবারই ব্যাপক নাটক হয়েছে এবং প্রতিবারই এটি বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এরপর ২০১০ সালে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রথম আইনি বাধা দূর করা হয়। এই খসড়ায় লোকসভাসহ সব আইনসভায় নারীদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছিল। খসড়ায় বলা হয়েছিল, নারীদের জন্য ওই আসন পালাক্রমে বরাদ্দ রাখা হবে এবং দৈবচয়নের ভিত্তিতে তাঁদের বাছাই করা হবে। আর এটা এমনভাবে করা হবে, যাতে পরপর তিনটি সাধারণ নির্বাচনে একটি আসন কেবল একবারই সংরক্ষিত থাকবে। খসড়ায় বলা হয়েছে এই সংশোধনীর ১৫ বছর পর এই সংরক্ষিত আসনের বিধান বাতিল হবে।
১২ সেপ্টেম্বর এই ১০৮তম সংবিধান সংশোধনী বিল বা উইমেনস রিজার্ভেশন বিলের ২১ বছর পূর্ণ হলো। এই এত বছরে শুধু রাজ্যসভা এতে সম্মতি দিয়েছে। গত দুই দশকে ভারতীয় সংসদের উভয় আসনে এই বিল নিয়ে অনেক নাটক হয়েছে। এমনকি রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হামিদ আনসারি যখন বিলটি পেশ করার চেষ্টা করেছেন, তখন রাজ্যসভার অনেক সদস্য তাঁকে শারীরিকভাবে আক্রমণের চেষ্টা করেছিলেন।
সংসদ এই বিলে সম্মতি দেয়নি। পরবর্তীকালে যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে এটি পাঠানো হয়। এই কমিটি ১৯৯৮ সালে লোকসভার কাছে প্রতিবেদন পেশ করে। এরপর অটল বিহারি বাজপেয়ি পুনরায় এই বিল লোকসভায় পেশ করেন। তৎকালীন আইনমন্ত্রী এম থামবিডুরি লোকসভায় বিলটি পেশ করলে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের এক সাংসদ স্পিকারের কাছ থেকে বিলটি কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেন। এরপর প্রতিবার সংসদ ভাঙলেই বিলটি তামাদি হয়ে যেত এবং ১৯৯৯, ২০০২ ও ২০০৩ সালে বিলটি পুনরায় পেশ করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিগত বছরগুলোতে অনেক পুরুষ সাংসদ এই বিল পাসের বিরোধিতা করেছেন, যার কারণে বিলটি বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। যদিও সংসদে কংগ্রেস, বিজেপি ও বামদের এর প্রতি সমর্থন দিতে শোনা গেছে, লোকসভায় এটি পাস করানো যায়নি। সন্দেহ নেই, ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ি সরকার গঠনের জন্য অন্যান্য দলের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, এ কারণে তাঁর পক্ষে বিলটি পাস করানো সম্ভব হয়নি।
তবে ১৯৯৯ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর বাজপেয়ি আবার ক্ষমতায় এলেও সেটা ছিল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (এনডিএ) ক্ষমতায় ফিরে আসা। এই জোট সেবার লোকসভার ৫৪৪ আসনের মধ্যে ৩০৩টি আসন জিতেছিল। সেবার বাজপেয়ির এমন অবস্থা হয়েছিল যে তাঁকে সব দলকে একত্র রাখতে হয়েছিল। তারপরও কংগ্রেস ও বাম দলের সমর্থনের কারণে বিলটি হয়তো পাস হয়ে যেত, যদি সেটার ওপর আনুষ্ঠানিক ভোট গ্রহণ হতো। কিন্তু সেটা হয়নি।
২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে এই বিল স্থগিত করার জন্য বাজপেয়ি কংগ্রেসকে দোষারোপ করেন। তিনি বলেন, ২০০৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হলে তাঁর দল মিত্রদের নিয়ে এই বিল পাস করবে। ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচিতে এটি অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এতে বলা হয়, ‘ইউপিএ সরকার লোকসভা ও বিধানসভায় নারীদের এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের জন্য বিল পেশের নেতৃত্ব দেবে’। ২০০৫ সালে বিজেপি এই বিলে পূর্ণ সমর্থন দেয়।
২০০৮ সালে মনমোহন সিং সরকার রাজ্যসভায় এই বিল পেশ করে। দুই বছর পর ২০১০ সালের ৯ মার্চ রাজ্যসভায় অনেক নাটকীয়তা ও সদস্যদের মধ্যে বচসার পর এটি পাস হয়। ফলে এক বড় রাজনৈতিক বাধা অতিক্রম করা সম্ভব হয়। বিজেপি, বামসহ অন্য দলগুলো সংসদের উচ্চকক্ষে এটি পাস করার জন্য ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের পাশে এসে দাঁড়ায়।
সাত বছর আগে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি উদ্যাপনে তিন বড় দলের তিন নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, সুষমা স্বরাজ ও বৃন্দা কারাত পরস্পরের হাত ধরে সংসদ থেকে বেরিয়ে আসেন, যেটি আলোকচিত্রীদের জন্যও ছিল বিরল এক ক্ষণ। কিন্তু আজ ২০১৭ সালে এসেও এটি আলোর মুখ দেখল না। কারণ, এটিকে আইনে পরিণত করার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, সংসদের নিম্নকক্ষের সেটি ছিল না। লোকসভায় দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের ২৬২টি আসন থাকলেও তারা এটি পাস করতে পারেনি। তারাও একই কারণ দেখিয়েছে, জোটের রাজনীতি।
সৌভাগ্যের কথা, বিজেপির সামনে সেই বাধা নেই। এই দলের সেই শক্তি আছে এবং তারা বিলটি পাস করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বিলটি পেশ করতে চান। কিন্তু এটি আইনে পরিণত হলে আমি বিস্মিত হব। সব দলের পুরুষ সাংসদেরা নারীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে চান না। তাঁরা তো ঘরেই নারীদের মর্যাদা দেন না এবং বিশ্বাস করেন, একটি পর্যায়ের পর নারীদের ক্ষমতায়ন হওয়া ঠিক নয়। এটা সত্য, এই প্রথমবারের মতো মোদি একজন নারীকে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বানিয়েছেন। এটা অতীতের সঙ্গে এক বড় ছেদ। এমনকি সর্বক্ষমতাময়ী ইন্দিরা গান্ধীও একজন নারীকে শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা উভয় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নারীকে নিযুক্ত করে মোদি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এটা তাঁর ইতিবাচক চিন্তার নজির।
আমার একমাত্র আশা হলো সংসদে বিলটি পাস করানোর ক্ষেত্রে মোদি এখনকার মতোই সংকল্পবদ্ধ থাকবেন। অনেকেই বলবেন, ২০১৯ সালের নির্বাচনে নারী ভোট আকৃষ্ট করতেই মোদি এটা করছেন। কারণ যা-ই হোক না কেন, লোকসভায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লে তাঁরা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।