নারীর ক্ষমতায়নের যুগ চলছে। নারীর পেশা ও পুরুষের পেশা আর আলাদা করে ভাবা হচ্ছে না। নারী বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে। যে কাজ এতকাল পুরুষের একান্ত নিজস্ব বলে ধারণা করা হতো, সেখানেও নারী অংশ নিচ্ছেন। নিচ্ছেন না বলে নিতে বাধ্য হচ্ছেন বলা যেতে পারে। মানুষের ধারণাতে এটাই বদ্ধমূল ছিল, ঘরের কাজ, সন্তান প্রতিপালন ও বয়স্কদের সেবা করা নারীর কাজ। আর অর্থ উপার্জনমূলক বাইরের কাজ পুরুষের।
শিল্পায়ন, নগরায়ণ, শিক্ষা ও উন্নত জীবন পাশাপাশি চলে আসার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধেরও উন্মেষ ঘটেছে। নারীকে ‘নরকের দরজা’ বিবেচনা করার বদলে ‘উন্নয়নের সিংহদুয়ার’ ভাবা হচ্ছে। এ কারণেই নারী-পুরুষের মধ্যে জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে সিডও (কনভেনশন অন এলিমিনেশন অব অল ফরমস অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাগেইনস্ট উইমেন) গঠনের পাশাপাশি এ সনদে স্বাক্ষরকারী সব দেশে নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করার ছাড়পত্র অনেক দেশেই নেই। তাই এ দেশে নারীর অধিকার ঝোলে-অম্বলে মিলেমিশে আছে।
তারপরও নারীর অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৬২ শতাংশ নারী আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে যুক্ত। ৫০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এ হার সর্বোচ্চ। কৃষিক্ষেত্রেও বাংলাদেশের নারীরা পিছিয়ে নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী, এমনকি সেনাবাহিনীর ঝুঁকিপূর্ণ পেশাতেও নারী তাঁর যোগ্যতার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করছেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের একটি। একটি সভায় লেখক ও সাহিত্যিক গোলাম মুরশিদ বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে নারীর যে ক্ষমতায়ন হয়েছে, তা আংশিক।’ নারীরা এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কাজ করছেন। কিন্তু আজও ধর্মের দোহাই দিয়ে, সামাজিক ও পারিবারিক সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে নারীকে আটকে রাখা হচ্ছে। এই বলয় ভেঙে নারীদের এগিয়ে আসার ওপর জোর দেন তিনি।
কিন্তু নারীর একার পক্ষে সব বাধা অতিক্রম করা যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি আপাত-অসম্ভবও বটে। কারণ, দেশটা সুলতানার স্বপ্নের নারীস্থান নয়। এখানে পুরুষ তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের আধিপত্য নিয়ে সমানভাবে বিরাজমান। যতক্ষণ না পিতৃতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা জেন্ডার সমতার বিষয়টি বুঝছেন বা বোঝার চেষ্টা করছেন, ততক্ষণ নারী নিজে যতই ক্ষমতায়নের নিশান ওড়ান, ঘরে-বাইরে নারীর কাঙ্ক্ষিত সুদিন আসবে না। জেন্ডার বিষয়টি এখনো নারীবাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে অনেকে। যদিও আমাদের দেশে কোনো বিশেষ বিষয়ভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও পেশাজীবনকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা কমই রাখে, তবু পুরুষ শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজে পড়াশোনার পরিসংখ্যান নগণ্য। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা কেবল পাস বা ভালো ফলের জন্য মুখস্থবিদ্যার উপস্থাপন নয়, তার আত্মস্থতা ব্যক্তিজীবনেও প্রভাব ফেলবে, যদি তা মানবিক বা সামাজিক বিষয় হয়। কিন্তু জেন্ডার স্টাডিজের পুরুষ শিক্ষার্থীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা শুধু এ বিষয় পড়ার জন্যই পড়েন। ব্যক্তি বা সামাজিক জীবনে তার প্রয়োগ তেমন গুরুত্ব বহন করে না। এমনকি জেন্ডার বিষয়ে একটি প্রশিক্ষণের সময় এ দেশের একজন প্রশিক্ষক সমাজতাত্ত্বিককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘এত প্রশিক্ষণ, এত লেখাপড়া করার পরও পুরুষেরা কেন সেভাবে জেন্ডার সচেতন হচ্ছেন না?’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘কে আর নিজের অধিকার এত সহজে ছাড়তে চায়!’ বুঝুন। আরও কষ্ট লাগে যখন খ্যাতনামা পুরুষ কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় জেন্ডার চেতনা একেবারে শূন্যের কোঠায় পরিলক্ষিত হয়।
অধিকার চেতনায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও স্বোপার্জিত সম্পদ নিয়ন্ত্রণে এখনো আপাত-ক্ষমতায় নারীরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নন। কারণ, এসব নারী নিজেরা জেন্ডার বৈষম্যের কুফল সম্পর্কে যথেষ্ট সজাগ হলেও তার পিতা-পুত্র-স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ বা জেন্ডার পক্ষপাতদুষ্ট কোনো মানুষই ওই সমাজতাত্ত্বিকের মতো বিনা যুদ্ধে নাহি ছাড়েন সূচ্যগ্র মেদিনী। তাই অর্থ উপার্জন করেও নারী স্বনির্ভর নন, উচ্চশিক্ষা লাভ করেও সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা নেই, ঘরের বাইরে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে এসেও তাঁকেই সাংসারিক কাজ সারতে হয়। ওদিকে পুরুষ ঘরের কাজ করলে তাঁর পৌরুষ আহত হয়, কিন্তু নারীকে দিয়ে তথাকথিত পুরুষালি কাজ (নির্মাণশ্রমিকের কাজ, কৃষকের কাজ) করিয়ে অবলা আখ্যা দিয়ে সমমজুরি থেকে বঞ্চিত করা হয়। যেসব নারী এসবের প্রতিবাদ করেন, তাঁরা সমাজ-সংসারে বিতর্কিত এবং বাঞ্ছিত নন। যাঁরা মেনে নিয়ে মনঃপীড়ায় দগ্ধ হতে থাকেন, তাঁরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবার জেন্ডার সংবেদনশীল পরিবার যে একেবারে নেই, তা নয়। তারা জেন্ডার প্রশিক্ষিত না হয়েও আচরণে সমতায় বিশ্বাসী। তবে শৈশব থেকেই পরিবারে জেন্ডার সামাজিকীকরণ হতে থাকলে বড় হয়ে শিশুদের আর নতুন করে প্রশিক্ষিত না হলেও চলবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১ নম্বরে। ২০১৬ সালের দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টের বিবেচনায়, নারী উন্নয়নে বিশ্বের ১৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪ নম্বরে।
অথচ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৭০৫ টি, ২০১৭-এর ১০ মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩৪ টি। এর মধ্যে গণধর্ষণ ১৩৯ থেকে ১৯৩ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ৩১ থেকে বেড়ে ৫২ টি। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, দেশে বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত। বাল্যবিবাহের হার শতকরা ৫৫ ভাগের ওপরে। এ ছাড়া পরিবার, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনপদ ইত্যাদিতে নারী নির্যাতন বাড়ছেই। তাহলে নারী উন্নয়নের সূচক নিয়ে আমাদের এত বাগাড়ম্বরের কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। শিক্ষা, রাজনীতি ও কর্মক্ষেত্রে নারীর উন্নয়ন দিয়ে আসলে নারীর অবস্থা ও অবস্থানের প্রকৃত চিত্রটি পরিষ্কার হয় না। নারী নির্যাতনেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে নারী শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত হচ্ছেন। আয়-উপার্জনেও ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে হাঁটছেন। কিন্তু তাঁর একার ক্ষমতায়ন নারী-পুরুষের অধিকারের সমতা আনতে সক্ষম হচ্ছে না। কারণ, পুরুষ তাঁর ক্ষমতার মধুর অচলায়তন ভাঙতে নারাজ। বেগম রোকেয়া সেই যুগে সমাজকে শকটের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যে শকটের দুটি চাকা-নারী ও পুরুষ। যত দিন না পুরুষ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বিসর্জন দিয়ে নারীকে তাঁর নিজের মতোই মানুষ বিবেচনা করবেন, তত দিন নারী উন্নয়নের সূচক এভারেস্ট স্পর্শ করলেও নারীর একলা চলার পথ কণ্টকমুক্ত হবে না।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক
muslima. umme@gmail. com