এক বছরের বেশি সময় আগে লন্ডনে অনুষ্ঠিত রোজি অ্যালেনের প্রদর্শনী দেখেছিলাম। তিনি কিছু জনপ্রিয় গল্প (সিন্ডারেলা, বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট, স্নো হোয়াইট, স্লিপিং বিউটি ইত্যাদি) নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন এবং রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যে নিপীড়ন, সম্মতির প্রয়োজনীয়তা, নারীদের জীবনে শারীরিক সৌন্দর্যের মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব, বার্ধক্যের ভীতিসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
শুধু যে ডিজনির গল্পগুলোই সমস্যাজনক তা নয়। বাংলাসহ বেশির ভাগ ভাষার রূপকথাই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক। এ ছাড়া বর্তমানে জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান, পত্রিকা, সিনেমা, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি এমনভাবে নারীদের তুলে ধরছে; যেন সাজগোজ, ঘরের সব কাজ একা সামলানো এবং সন্তানের যত্ন নেওয়াই তাদের জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তবতা খুব আলাদা। সব বাধা পেরিয়ে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। খেলাধুলা থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক গবেষণা—সর্বত্রই তঁাদের দৃপ্ত পদচারণ। গণমাধ্যমে বিভিন্ন পেশায় সফল নারীদের উপস্থাপনের সময়ও বৈষম্য চোখে পড়ে। তাই খেলোয়াড় নারীদের ফ্যাশন আর গুণী সংগীতশিল্পীর রান্নার ওপর প্রতিবেদন হয়। পুরুষদের সাধারণত দেখানো হচ্ছে ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী হিসেবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভেসে যাচ্ছে নারীসম্পর্কিত অপমানজনক কৌতুক আর মন্তব্যে।
বাংলাদেশে নারীরা নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। নারী নির্যাতনের অবসান ঘটাতে হলে সঠিক আইন ও নীতিমালা তৈরি এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন না ঘটলে আইন ও নীতি তেমন কোনো কাজে আসে না। শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা যেসব বই পড়ে, সিনেমা বা কার্টুন দেখে, গেমস খেলে এবং পরিবারে নারী-পুরুষের মাঝে যে ধরনের সম্পর্ক দেখে, তা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমরা যদি ঘরে-বাইরে নারীর দুর্বল, নির্ভরশীল অধস্তন ভাবমূর্তিই তুলে ধরি, তাহলে কী করে তারা একটি সম্পর্কে পারস্পরিক মর্যাদা ও সমতার গুরুত্ব শিখবে?
২০২০ সালের অক্টোবরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ কর্তৃক পরিচালিত ‘মেল ইয়ুথ অ্যান্ড দেয়ার সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস (এসআরএইচআর) ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশ করে। ৬২ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, কোনো কোনো সময়ে স্ত্রীরা ‘মার খাওয়ার উপযুক্ত কাজ করে’। শহর ও গ্রামাঞ্চলের প্রায় ৬৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, ‘স্বামীর সঙ্গে মিলিত হতে অস্বীকৃতি জানালে স্ত্রীকে পেটানো যেতে পারে’। গবেষণাটিতে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ১১ হাজার ১০২ জন পুরুষ অংশগ্রহণ করেন এবং এটি ৬৪ জেলায় পরিচালিত হয়।
এ বিষয়ে নারীদের ভাবনা কী? ২০১৪ সালের নভেম্বরে ‘ভায়োলেন্স অ্যান্ড জেন্ডার’ প্রকাশিত ‘ওয়াইফ বিটিং: পপুলেশন বেইজড স্টাডি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় জানা যায়, স্বামী কর্তৃক প্রহারকে মেনে নেওয়া নারীদের মধ্যে ২৩ শতাংশ তর্ক করার কারণে, ১৮ শতাংশ সন্তানের অযত্ন করায়, ১৭ শতাংশ স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাইরে যাওয়ায়, ৮ শতাংশ স্বামীর সঙ্গে মিলিত হতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে এবং ৪ শতাংশ খাবার পোড়ানোর কারণে এই নির্যাতনকে গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। ১৭ হাজার ৮৪২ জন নারী এ গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন।
কেন আমাদের সমাজের অসংখ্য নারী-পুরুষ নারী নির্যাতনকে স্বাভাবিক মনে করেন? এর জন্য দায়ী পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, যা নারীকে সমান মানুষের মর্যাদা দেয় না এবং নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণের ওপর গড়ে ওঠা পৌরুষকে উৎসাহিত করে। তাই পুরুষদের অনেকেই নারীকে বন্ধু এবং সহযোদ্ধা হিসেবে দেখতে পারেন না, তঁাদের মর্যাদা দিতে শেখেন না।
সম্প্রতি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দৃঢ়চেতা নারী ও মেয়েদের গল্প, নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চিত্রিত করার বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন কিছু নারী চরিত্র নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিতে সক্ষম, কোনো ‘রাজপুত্র’ এসে উদ্ধার করবে—তাদের এই প্রয়োজন নেই। এই ধরনের গল্প আরও বেশি লেখা উচিত। পাশাপাশি মানবিক এবং সন্তান বড় করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যত্নকারীর ভূমিকায় পুরুষ চরিত্র তৈরি করা দরকার।
নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন অর্জনের যাত্রাটা খুব দীর্ঘ। আমাদের মেয়েদের এমনভাবে বড় করতে হবে, যাতে তারা আত্মবিশ্বাসী, শক্তিশালী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সাহসী, স্বাধীনচেতা ও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। ছেলেদের অবশ্যই মেয়ে ও নারীদের সম্মান করার শিক্ষা দিতে হবে। লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা বাস্তবধর্মী এবং অনুপ্রেরণামূলক গল্প ও নারী চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেন। মা-বাবাকে খুব সতর্কতার সঙ্গে শিশুদের জন্য বই, কার্টুন, খেলনা ইত্যাদি বাছাই করতে হবে; মেয়ে ও ছেলেশিশুকে সমানভাবে বড় করাটা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সম্পর্ক থাকা জরুরি। গণমাধ্যমকে অবশ্যই এমন নারীদের তুলে ধরতে হবে, যারা ইতিবাচক রোল মডেল। প্রত্যেক নাগরিকের সমমর্যাদা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী