বাংলাদেশে জন্য নারীবাদ ইস্যুটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান কারিগর নারী। শুধু পোশাকশিল্পেই নয়, কৃষি ও অকৃষি খাতে ক্রমবর্ধমান হারে নারীর কর্মে নিযুক্তি বাংলাদেশে এ উন্নয়ন এনে দিয়েছে। কিন্তু এ দেশে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে—এ কথা যাঁরা বলেন, ভুল বলেন। তাঁরা জানেন না ক্ষমতায়ন বলতে কী বোঝায় আর নারীর ক্ষমতায়নই নারীবাদের মূল কথা। নারীর ক্ষমতায়ন হয়নি—বিষয়ে আপাতত দুটি উপাদানের কথা বলি। এক. নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরি-বৈষম্য। দুই. পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র ও রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। বস্তুত, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাই ক্ষমতায়নের মাপকাঠি। দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে।
ইংল্যান্ডপ্রবাসী ভারতীয় বাঙালি নীরদ সি চৌধুরী যখন লেখেন ‘বাঙালী জীবনে রমণী’, তখন বোঝা যায় সহস্র বছর প্রাচীন পুরুষবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এ শিরোনাম। কারণ, এমন শিরোনামের অর্থ দাঁড়ায় বাঙালি মানে শুধুই পুরুষ এবং এই পুরুষদের জীবনে ‘রমণী’ যেন একটা উপকরণমাত্র। বাংলাদেশে নারীবাদ শব্দটির সঙ্গে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ও নারীবাদী সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে দুটি নাম উল্লেখ করতেই হবে। এক হুমায়ুন আজাদ, দুই তসলিমা নাসরিন। তসলিমার লেখায়, পুরুষের ওপর নারীর কর্তৃত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু নারীবাদের মূল প্রতিপাদ্য মোটেই তা নয়। নারীবাদের মূল প্রতিপাদ্য হলো সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা স্থাপন। একের ওপর অন্যের কর্তৃত্ব নয়। তবে পুরুষের ওপর নারীর কর্তৃত্বের আকাঙ্ক্ষাকে পুরুষ কর্তৃক নারীর ওপর সহস্র বছরের নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেখতে হবে।
নারীমুক্তি বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, কমিউনিস্ট ব্যবস্থাও নারীর মুক্তি নিশ্চিত করে না। তার মানে হলো তিনি মার্ক্সবাদ পড়েননি আর পড়লেও বোঝেননি। সত্য হলো কমিউনিস্ট ব্যবস্থা জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাম্য নিশ্চিত করে। যদি না করে, ধরে নিতে হবে মার্ক্সীয় তত্ত্ব সেখানে যথাযথ অনুসরণ করা হয়নি। সোভিয়েত ব্যবস্থা নারী-পুরুষের সমতা বিধানের কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিল। করতে পেরেছে কিউবাও।
নারীবাদ শব্দটি বস্তুবাদী ও দেহাত্মবাদী অর্থের ব্যঞ্জনাই বেশি ধারণ করে, অর্থাৎ নারী কী পোশাক পরেন, কীভাবে কথা বলেন, কীভাবে আহার করেন, কীভাবে যৌনমিলন করেন ইত্যাদি। নারীবাদের উদ্দেশ্য হলো এককথায় রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সমতা। তিনিই নারীবাদী, যিনি বিশ্বাস করেন, নারী লিঙ্গবৈষম্যের শিকার, অর্থাৎ শুধু লিঙ্গের কারণে নারী বৈষম্যের শিকার, নারী হওয়ার কারণে তাঁর ন্যায্য পাওনা সমাজ দিতে অস্বীকার করে এবং এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সমাজের মধ্যে আমূল পরিবর্তন তথা বিপ্লব দরকার।
অতীতের নারী আন্দোলন থেকে বর্তমান সময়ের নারীদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। শিক্ষাটা হলো হোলিস্টিক তথা সর্বাত্মক আন্দোলনের শিক্ষা। যেমন জার্মানির ক্লারা জেটকিন মূলত একজন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী ছিলেন; কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তিবাদী আন্দোলনে যোগ দিলেন। যুদ্ধ সমর্থন করার জন্য জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে তুলাধোনা করলেন, যুদ্ধের বিরুদ্ধে পুরুষদের নিষ্ক্রিয়তাকে একহাত নিলেন আর বললেন, ‘পুরুষেরা যদি হত্যা করে, নারীরা শান্তির জন্য লড়বে। পুরুষেরা যদি নীরব থাকে, নারীরা সেখানে চড়া গলায় কথা বলবে।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগেই, আঠারো শতকের শুরু থেকেই, ভোটাধিকার, শ্রম অধিকার, টেম্পারেন্স মুভমেন্ট (মিতাচার আন্দোলন), শান্তিবাদী আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনে নারীর আলাদা অংশগ্রহণ চোখে পড়ে। নারীর জন্য ভোটাধিকার আন্দোলনের ব্রিটিশ নেত্রী এমেলিন পেট্রিক-লরেন্স যুক্তি দেখান, ‘মানবজাতির ভিত্তিমূল হলো মাতৃত্ব। পুরুষের পরস্পরবিরোধী অনেক আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, কিন্তু শ্রেণি-পেশানির্বিশেষে নারীর একটাই মাত্র প্রেষণা আর তা হলো সৃষ্টি। তাঁর প্রেষণা হলো জীবনচক্র ধরে রাখা।’ ব্রিটিশ শান্তিবাদী ও ভোটাধিকার আন্দোলনের নেত্রী হেলেনা স্বনউইক মনে করেন, ‘নারীরা নয়, পুরুষেরাই যুদ্ধ বাধায়। নারী স্বভাবগতভাবেই শান্তিপ্রিয়, কারণ তারা সতত মাতৃত্ব দ্বারা তাড়িত।’
অতীতের নারী আন্দোলন থেকে বর্তমান সময়ের নারীদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। শিক্ষাটা হলো হোলিস্টিক তথা সর্বাত্মক আন্দোলনের শিক্ষা। যেমন জার্মানির ক্লারা জেটকিন মূলত একজন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী ছিলেন; কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তিবাদী আন্দোলনে যোগ দিলেন। যুদ্ধ সমর্থন করার জন্য জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে তুলাধোনা করলেন, যুদ্ধের বিরুদ্ধে পুরুষদের নিষ্ক্রিয়তাকে একহাত নিলেন আর বললেন, ‘পুরুষেরা যদি হত্যা করে, নারীরা শান্তির জন্য লড়বে। পুরুষেরা যদি নীরব থাকে, নারীরা সেখানে চড়া গলায় কথা বলবে।’ একই কাজ করেছেন ইলিয়নোর মার্ক্স ও নাদেঝদা ক্রুপস্কয়া। জীবনীকার র্যাচেল হোমজ, ইলিয়নোর মার্ক্স সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, তিনি সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করেছেন নারীবাদ, যা শ্রমজীবী নারীর মুক্তি নিশ্চিত করে।
ক্রুপস্কয়া তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন কারখানার শ্রমিকদের শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে, তারপর যোগ দেন আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পাঠচক্রে। গড়ে তোলেন কারখানার শ্রমিকদের সংগঠন। ১৮৯৯ সালে লিখে ফেলেন ‘দ্য উইম্যান ওয়ার্কার’ শিরোনামে এক বিখ্যাত পুস্তিকা। ধারণা করা হয়, এ পুস্তিকাই রাশিয়ায় রুশ নারীর অবস্থার অনুপুঙ্খ বর্ণনার সর্বপ্রথম মার্ক্সীয় ও নারীবাদী লেখা। তিনি মূলত শিক্ষাবিস্তারে আজীবন নিরলস কাজ করে গেছেন, সরকারের উচ্চ পদে আসীন ছিলেন, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির পতাকার নিচে।
নারীবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিতর্ক চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। নারী যদি সাম্যবাদী আন্দোলনে যুক্ত হন, তাহলে আলাদাভাবে নারী অধিকারের জন্য আন্দোলনের দরকার আছে কি? কারণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা হলে শ্রেণি-বর্ণ-লিঙ্গনির্বিশেষে সবাই ন্যায্য অধিকার পাবে। এ বিষয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, সর্বক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার না হওয়া পর্যন্ত যুগপৎ নারীবাদী আন্দোলন চলতে পারে।
নারীমুক্তি বিষয়ে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। পুরুষের অংশগ্রহণ ছাড়া নারীবাদী আন্দোলন সফল হতে পারে না। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, নারীকে বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে পুরুষেরা সংঘবদ্ধ, যা কখনো চোখে পড়বে না। আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত। প্রশ্ন উঠতে পারে, নারীর অধিকার আন্দোলনে পুরুষ কেন অংশগ্রহণ করবে? নীতি-আদর্শের কথা যদি বাদও দিই, পুরুষের নিজের স্বার্থেই নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত। একটি দেশের মোটামুটি ৫০ শতাংশই নারী থাকেন। ক্ষমতায়নের একটি প্রধান উপাদান হলো লেবারফোর্স পার্টিসিপেশন তথা কর্মে নিযুক্তি। এ হার যত বেশি হবে, দেশের উৎপাদন তত বেশি হবে। নিজের পরিবারের স্ত্রী, কন্যা বা ভগ্নির কর্মে নিযুক্তি থেকে সরাসরি যে উপকার আসবে, তার বাইরে রাষ্ট্রের নেট গেইন, তথা নিট লাভ থেকেও পুরুষ উপকৃত হবেন। আর নীতি-আদর্শের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, যে সমাজে পুরুষের সমান মর্যাদা নারী পান না, সে সমাজ পশ্চাৎপদ সমাজ। যে ব্যক্তি নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করেন না, তিনি এখনো মানবিকবাদী হতে পারেননি।
নারী-পুরুষের সম্মিলিত আন্দোলন সম্ভব রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং আন্দোলনটি হতে হবে সাম্যবাদী আন্দোলন, কারণ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া, বিচ্ছিন্নভাবে শুধু নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড বা জাপানের মতো দেশ, যেখানে পুঁজিবাদী পন্থায় উন্নয়ন ঘটেছে, নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেখানে একই পদে চাকরি করেও নারীর চেয়ে পুরুষ বেশি বেতন পায়। হলিউডে, এমনকি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে মেয়েরা পরিচালক, সহ-অভিনেতা ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন। জাপানে গণপরিবহনে পুরুষ কর্তৃক নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা মহামারির আকার ধারণ করেছে।
নারীর অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, সংখ্যালঘুর অধিকার মানুষের অধিকারেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ এবং একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সমাজে যদি শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, শ্রমিক যদি তাঁর ন্যায্য পাওনা পান, নারীর অধিকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এ কথা বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি প্রযোজ্য। কারণ পোশাকশিল্পে, গৃহকর্মে, এমনকি কৃষি ও অকৃষি খাতেও সর্বত্র নারীর উপস্থিতি।
আটলান্টিকের ওপারে একটি বর্ণবাদী সমাজে জন্ম নেওয়া আমেরিকান কবি মায়া অ্যাঞ্জেলো যেন নারী নিগ্রহের জ্বলন্ত উপমা। তিনি একাধারে নারী, কৃষ্ণাঙ্গ, শ্রমজীবী, শৈশবেই ধর্ষণের শিকার এবং তারপর যৌনকর্মী, কিন্তু অবশেষে বিশ্বের সেরা সাহিত্যিকদের একজন। আমাদের সময়ের নারীদের জন্য এক অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। তাঁর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিসংবলিত গ্রন্থ ‘খাঁচার পাখিটি কেন গান গায়, আমি তা জানি’র নিজেই খাঁচার পাখি। আসলে অনুবাদটা হবে ‘খাঁচার পাখিটি কেন কাঁদে’। কারণ, তাঁর এই জীবনীগ্রন্থ পড়ে আমরা আজও শুনতে পাই তাঁর কান্নার সুর।
আমাদেরও এ রকম একজন কবি ছিলেন। নাম তাঁর কাজী নজরুল। বহুদিন হলো তাঁর মতো কেউ বলে না:
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর
ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com