দুর্গোৎসব শুরু হতে না হতেই নারীর গুণকীর্তন চতুর্গুণ বৃদ্ধি পেতে থকে। সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমে শোরগোল ওঠে ‘নারী কী না পারে’! প্রথমে দুই হাতের কারিশমা বর্ণিত হয়। বলা হয় নারী এক হাতে সংসার সামলায়, আরেক হাতে রোজগার করে। মা দুর্গার যখন নাইওরের সময় ঘনিয়ে আসে তখন আপামর নারীকে দুর্গা মায়ের প্রতিমূর্তি কল্পনা করা হয়।
নারী তো দশভূজারই প্রতীক। নারীর কাজ, নারীর শ্রমকে তখন পুরুষ প্রশংসা করে। বলে নারী দশ হাতে সব সামলাতে পারে। টেবিলভরা খাবার দেখে আমন্ত্রিত অতিথি বিস্ময়ে বলে ওঠেন, ‘কী সব্বোনাশ! ভাবী একা হাতে এর সবগুলো করেছেন?’ ভাবীর স্বামী শার্টের কলার নাড়িয়ে জবাব দেন, ‘দেখতে হবে না বউটা কার?’
নারী হচ্ছে দশভুজা। এ যজ্ঞ তারা দৃশ্যমান দুহাতে সামলান কিন্তু আরও আটখানা হাত ওদের অদৃশ্যে কাজ করে যায়। তার মানে আরও চারজন গৃহপরিচারিকা আছেন? না মশাই, ওদের পিঠেই ওগুলো লুকানো আছে।
একজন কর্মজীবী নারী নটা-পাঁচটা অফিস করেন। স্বামী কলেজশিক্ষক। নারী অফিস থেকে ফিরেই দেখতে পান তাঁর বসার ঘর ভরা স্বামীর ইয়ারবন্ধু। অফিসের কাপড় না ছেড়েই তাঁকে চা, জলখাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। কেউ কেউ সন্ধ্যায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাত্রোত্থান করেন। কর্তার পছন্দের আরও তিন-চারজন মধ্যরাত অবধি তাস পেটান। বলা বাহুল্য তাদের রাতের খাবারও নারীকে বিশেষভাবে রান্না করতে হয়। বন্ধুরা কৃত্রিম ইতস্তত করলে গৃহকর্তা বিগলিত হয়ে বলেন, আরে ওরা হলো গিয়ে মা দুর্গার অবতার। টেবিলে দেখবে চলো দশ হাতের কারবার!
আর এক কীর্তিমান পুরুষ। স্ত্রীও রাজজোটক। আমেরিকায় ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ এল ছেলেটির। স্ত্রী দোনামনা। তাকে ভালো চাকরি ছেড়ে যেতে হবে। দুই পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা সিদ্ধান্ত নিলেন, বিদেশ–বিভুঁইয়ে পুরুষমানুষের একা থাকা ঠিক হবে না। তা ছাড়া সে তো রান্না করে খেতে পারবে না। সুতরাং স্ত্রী চাকরিতে পদোন্নতি পেয়েও সব ছেড়ে–ছুড়ে স্বামীর সেবায় সহযাত্রী হলেন। দীর্ঘদিন পর যখন তাঁরা দেশে ফিরলেন তখন নারীর আর চাকরির বয়স নেই। পুরোদস্তুর গৃহকর্ত্রী বনে গেলেন। পুরুষটির অসামান্য সাফল্যে সবাই নারীটিকে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। তার আরও ভালো বউ হওয়ার বাসনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। ভদ্রলোকের অতিথিপরায়ণ হিসেবে খুব নামডাক। তাঁর বাসায় বারো মাসে তেরো পার্বণ। গৃহপরিচারিকা থাকা সত্ত্বেও নারী নিজের হাতে রান্না ও পরিবেশনে সদা নিয়োজিত। শরীরের ভেতরের অসুস্থতাকে আমলে না নিয়ে দশ হাতে কাজ করেছেন। কিন্তু করোনার কালসাপ কখন যেন অসাবধানতার সুযোগে তার দুর্বল ক্ষতে আঘাত হেনেছে। উন্নত চিকিৎসা, স্বামী সন্তান আত্মীয়-স্বজনদের প্রাণান্ত চেষ্টাতেও তিনি আর ফিরলেন না।
তাই দশভুজা বলে নারীকে মাথায় তুলে রাখলেও নারীর এতে আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই। নিজের শরীর, নিজের পেশা, নিজের অবসর, নিজের বিনোদনকে তুচ্ছ করলে চলবে না। আমরা কেবল মা দুর্গার দশ হাত দেখি। ধরে নিই তার হাতগুলো বুঝি হাতা, খুন্তি, ঝাড়ু, ঝুড়ি, কোদাল, দা, বটি, কমণ্ডলু ইত্যাদি সেবা যন্ত্রের সমাহার। অনেকে জানিও না যে তার হাতের অস্ত্রগুলো কী কী। জেনে রাখা ভালো যে দুর্গা দেবীর দশ হাতে ধরা দশটি অস্ত্রের মধ্যে ত্রিশূল—তিনটি ফলায় আছে তমঃ রজঃ ও সত্য; গদা—আনুগত্য, ভালবাসা ও ভক্তি; বজ্রাস্ত্র—দৃঢ়তা ও সংহতি; সাপ—বিশুদ্ধ চেতনা; অগ্নি—জ্ঞান ও বিদ্যা, শঙ্খ—জীবজগতে প্রাণের সৃষ্টি; চক্র—সৃষ্টি ও জগতের কেন্দ্রে অধিষ্ঠান, তির-ধনুক—ইতিবাচক শক্তি; পদ্ম—অন্ধকারেও আলোর আবির্ভাব; তলোয়ার—বুদ্ধি যা বৈষম্য ও অন্ধকার দূর করে।
দেবী দুর্গার হাতের অস্ত্রগুলোর তাৎপর্য ঢাক, ঢোল, কাশর, ধূপ-ধূনো, অঞ্জলি, প্রসাদ, হইচই, বিসর্জনের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। দেবী মূর্তিমাত্র। জলে ভাসিয়ে দিলেই ভাটির মেয়ে মাটিতে মিশে যায়। কিন্তু অস্ত্রগুলো সম্পর্কে নারী-পুরুষ সবারই সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক। এগুলোর মধ্যে যেমন আনুগত্য, ভালবাসা ও ভক্তি আছে তেমনি চেতনা, বুদ্ধি, আলো ও বৈষম্য দূর করার বাণীও নিহিত আছে। পরার্থে নিজেকে ক্রমাগত বিলিয়ে দেওয়ার কথা কোথাও নেই বরং তিনি দুর্গতিনাশিনী। ঘরে-বাইরে নারীর ঘাড়ে কাজের বোঝা চাপিয়ে কেউ তাকে দশভূজায় মহিমান্বিত করতে এলে বজ্রাস্ত্র (দৃঢ়তা ও সংহতি) নিয়ে মোকাবিলায় নামতে হবে। এটাই হোক আমাদের এবারের দুর্গোৎসবের অঙ্গীকার।
উম্মে মুসলিমা লেখক
muslima.umme@gmail.com