এই ছয়–সাত দশক আগেও রাজধানী ঢাকায় অনেক বাসাবাড়িতে ছিল খাবার ও ব্যবহারের পানির জন্য চাপকল, ইঁদারা, জ্বালানির জন্য লাকড়ি, কেরোসিনের স্টোভ ও আলোর জন্য হারিকেন। এখন পাইপে পানি, রান্নায় গ্যাস আর এসেছে বিজলি বাতি। নিঃসন্দেহে আমাদের জীবন সহজ ও সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বানের জলে যেমন পলির সঙ্গে আসে আবর্জনা, তেমনি নগরবাসীর জীবনে দুঃস্বপ্ন হয়ে এসেছে ওয়াসা, তিতাস আর ডেসকোর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো।
নিজের কিছু সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা আপনাদের জানাচ্ছি, যার সঙ্গে আপনারা অনেকেই সহমর্মিতা জ্ঞাপন করবেন।
ফ্ল্যাটে থাকি, হঠাৎ করে ওয়াসার পাঁচ বছর আগের মোটা অঙ্কের বকেয়া বিল, পরিশোধ না করলে সাত দিনের মধ্যে লাইন কেটে দেওয়া হবে। এ ধরনের বাসাবাড়িগুলো সিকিউরিটি কোম্পানির সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবী মালিকদের সমিতি পরিচালনা করে। কোনো স্থায়ী অফিস বা দলিলপত্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। কোথায় পাবে পাঁচ বছর আগের দেওয়া বিল? সমিতির খাতায় বিল পরিশোধের হিসাব দেখানো আছে। তবু লাইন কাটার ভয়ে জরিমানাসহ বিল পরিশোধ করেই নিস্তার। সব দায় কি কেবল গ্রাহকের? যত দূর মনে পড়ে, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত আছে প্রতিবছরের শেষে নাগরিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাওনা বা না দাবিপত্র জারি করতে হবে। তাহলেই তো আর পাঁচ বছর আগের বকেয়ার প্রশ্ন আসে না।
তার ওপর আবার মাসের বাড়তি বিল, প্রায় দেড় গুণ বেশি। আবার ওয়াসার কাছে আবেদন। না, সব ঠিক আছে। বাড়তি বিল দিতেই হবে। অথচ করোনার শুরু থেকেই প্রায় ১০টি বাসা খালি। এটাও দিলাম। করোনায় সাবান দিয়ে হাত ধুতে কি বিল বেড়েছে!
আমাদের গ্যাসের মিটারটি জমির মালিকের নামে। ভদ্রমহিলা প্রয়াত হয়েছেন কয়েক বছর। ভাবলাম, নিজেদের নামে করে নিই। তিতাস গ্যাসের একজন সাবেক এমডির পরামর্শে কারওয়ান বাজারে জিএম নর্থের কাছে ২৪ আগস্ট আবেদন করি। তিনি সেদিনই তা কুড়িল এলাকার ডিজি এমকে (সেলস) হাতে হাতে দেন। এর মধ্যে আমার প্রতিনিধি আটবার তাদের দপ্তরে গেছে। আমি নিজে কথা বলেছি বার পাঁচেক। আজ সে কাগজ, কাল অন্য কাগজ, সবই দিই। সবশেষে আবার বকেয়া আবিষ্কৃত হয়। বকেয়ার টাকা পাঠাই। না আরও টাকা লাগবে, সিকিউরিটি ডিপোজিট। তবে কি ২২ বছর ধরে সিকিউরিটি ডিপোজিট ছাড়াই আমরা গ্যাস ভোগ করেছি? এখন আবার প্রি-পেইড মিটার হয়েছে। সেটাও জমা দিলাম। নামজারির কাগজ হাতে পেতে প্রায় এক মাস সময় লাগল।
বিদ্যুৎ কোম্পানি বাদ যাবে কেন। বাড়তি বিল দিয়েছে গত মাসের দ্বিগুণ। বাসায় আমরা কুল্লে তিনজন মানুষ। করোনার ভয়ে পারতপক্ষে এসি চালাই না। কেবল বাতি, পাখা, ফ্রিজ আর কম্পিউটার। আমরা টিভি দেখি না। গৃহকর্মী দিনের কাজের শেষে এক ঘণ্টা সিরিয়াল দেখে। এবার প্রতিবাদ বা আবেদন করিনি লজ্জায় ও ক্লান্তিতে। আমি একসময় বিদ্যুৎ বিভাগে কাজ করতাম!
এখন আবার ডিজিটালাইজেশনের নামে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। কর্মকর্তার বসার টেবিলে মনিটর আর লেজার প্রিন্টারে ছাপা মানে ডিজিটালাইজেশন নয়। এক মাসের কাজ এক সপ্তাহে, এক সপ্তাহের কাজ এক দিনে, এক দিনের কাজ এক ঘণ্টায় না হলে সেটা কোনো ডিজিটালাইজেশন নয়। একজন গ্রাহকের নাম বদলাতে এক মাস লাগানো এটা ডিজিটাল সুইসাইড!
একবার ম্যাসাচুসেটসের এমহার্স্ট শহরে বাংলাদেশের এক সাবেক প্রধান বিচারপতির কন্যা আমাকে ও আমার মেয়েকে তার বাসায় দিনযাপনের নেমন্তন্ন করে। সে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের স্নাতক। গাড়িতে আমাদের বাসায় নামিয়ে মেয়ের সঙ্গে রেখেই ছেলেকে খেলার মাঠে নিতে বেরিয়ে পড়ল। আমি ঘরে থাকতেই রান্নাবান্না সারতে সারতে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে চার–পাঁচবার ঘর–বাহির করল। এদের দেশে বাড়ি, গাড়ি, ড্রাইভার, মালি কত কিছু। খাবার টেবিলে ছোট বোনটিকে জিজ্ঞেস করি তুমি আমেরিকায় এত কষ্ট করছ কেন? ভাই, তাতেও শান্তি! আপনি বুঝবেন না। একদিন ব্যাংকে যান, পোস্ট অফিসে, ওয়াসায় যান তাহলে বুঝবেন। হ্যাঁ, এখন আমি ঠিকই বুঝতে পারছি!
আমি নিজেও পাঁচ বছর আমেরিকা ও তিন বছর সিঙ্গাপুরে থেকেছি। এক দিনও পানি, গ্যাস বা বিদ্যুৎ অফিসে যেতে হয়নি। ব্যাংক হিসাব থেকে বিলের টাকা কেটে নিয়েছে। বাড়তি নিয়ে থাকলে পরের মাসে সমন্বয় করেছে! এসব অফিস কোথায়, তা–ও অনেকেই জানে না। একবার বাসে একজন বন্ধু বলেছিল, এটা সিঙ্গাপুরের পিইউবি বিল্ডিং। এরা আমাদের পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করে। একটিই অফিস সব মিলিয়ে।
আমাদের সব সরকারি দপ্তরের মতো ওয়াসা, তিতাস ও ডেসকোতে ও অন্তত অর্ধেক বাড়তি লোক আছে। জনবল বাড়াতে গিয়ে এগুলো অকার্যকর সংগঠনে পরিণত হয়েছে। কুড়িল তিতাস অফিসের কথাই ধরুন, সেখানে দুজন ডিজিএম (সেলস) ও ডিজিএম (রেভিনিউ) আছে। আসলে সেখানে প্রয়োজন একজন ম্যানেজার ও কয়েকজন সহকারী। কম্পিউটারে সেবার তালিকা থাকবে, সেখানে কী কী কাগজ জমা দিতে হবে ও প্রদেয় ফির তালিকা থাকবে। গ্রাহক নিজের বাড়ি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে কাগজ ও ফি জমার রসিদ কম্পিউটারে জমা দেবেন। সহকারী তা সঠিকতা যাচাই করে ম্যানেজারের অনুমোদন নিয়ে গ্রাহককে কম্পিউটারে জানিয়ে দেবে। কাগজপত্র অসম্পূর্ণ থাকলে বা অর্থ জমা না হলে তা–ও গ্রাহককে কম্পিউটারে জানিয়ে দেবে। এর ফলে গ্রাহককে এখনকার মতো এ টেবিল থেকে সে টেবিল, স্যার সিটে নেই, হেড অফিসে মিটিং, দিনের পর দিন ঘুরতে হবে না। জনবল কমলেই দুর্নীতি কমবে।
এ প্রসঙ্গে ১৯৮৪ সালে লন্ডনে আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার ছোট বোনের স্বামী মারা গেলে আমি তার ওয়ারিশের কাগজপত্র নিয়ে তাদের সামাজিক সুরক্ষা অফিসে যাই। আগেই ফোন করে জেনে নিই কী কী কাগজ লাগবে। কাগজপত্র জমা দিতে অফিসে গিয়ে দেখি একটা পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় বড় খোলা কক্ষে দুই পাশে সারি ধরে কাউন্টার। এক পাশে জমা, অন্য পাশে ডেলিভারি। অফিসের বাইরের কারও ভেতরে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। অফিস শেষে ছাড়া কর্মকর্তা বা কর্মচারীদেরও বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিটি সেবার জমা দেওয়ার কত দিন পর সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে, তা উল্লেখ আছে (১ থেকে সর্বোচ্চ ৫ দিন)। আমার কাগজ জমা নিল ও পাঁচ দিন পর ডেলিভারির সিল দিয়ে দিল। আরেকটু তাড়াতাড়ি সম্ভব কি না, বললে জানাল, আমার কাগজপত্র ম্যানচেস্টারে হিসাব নিরীক্ষার জন্য যাবে। তিন দিন পর বাসায় ফোন করে আমাকে পরদিন অফিসে দেখা করতে বলল। আমি গেলে কাউন্টারের পাশ দিয়ে তালা খুলে আমাকে একটা রুমে নিয়ে গেল। খালি রুমে একটি বসার চেয়ার।
একজন তরুণ কর্মকর্তা এলেন। আমি তাঁকে বললাম, আপনি বসুন। তিনি বললেন, ওটা করদাতার বসার চেয়ার! তিনি দাঁড়িয়েই আমার দেওয়া কাগজের সমস্যার কথা বলে সমাধান বাতলে দিলেন। কথা শেষ হয়ে আমি রুম থেকে বের হতেই দরজাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। আমি তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী কাগজ জমা দিয়ে পরদিনই অনুমোদন পেয়ে যাই। প্রাক্–কম্পিউটার যুগের প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা। আমাদের কর্মকর্তারা খিচুড়ি রান্না না শিখে এসব শিখতে বিদেশ যেতে পারেন না?
এখন আবার ডিজিটালাইজেশনের নামে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। কর্মকর্তার বসার টেবিলে মনিটর আর লেজার প্রিন্টারে ছাপা মানে ডিজিটালাইজেশন নয়। এক মাসের কাজ এক সপ্তাহে, এক সপ্তাহের কাজ এক দিনে, এক দিনের কাজ এক ঘণ্টায় না হলে সেটা কোনো ডিজিটালাইজেশন নয়। একজন গ্রাহকের নাম বদলাতে এক মাস লাগানো এটা ডিজিটাল সুইসাইড! এসব যন্ত্রণার কারণেই বিদেশিরা এখানে বিনিয়োগ করেন না। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এসে পালিয়ে যান।
মোটা দাগে, এসব অফিসে জনবল কমাতে হবে, কর্মীদের অফিসে আবদ্ধ করে ‘স্যার সিটে নেই’ সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে, হেড অফিসের সভা কমাতে হবে আর প্রকৃত ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ৯০ শতাংশ কাজ গ্রাহকের সাক্ষাৎ ছাড়াই এবং সব কাজ এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
শেষ করি জগজিৎ ও চিত্রা সিং দম্পতির ‘ওহ কাগজকা কিশতি’ গানের কথা বলে। গানে বলা হচ্ছে, ‘আমার যৌবন ফিরিয়ে নাও, কিন্তু আমার ছেলেবেলার কাগজের নৌকা ও বর্ষার পানি ফিরিয়ে দাও।’ আমাদেরও গানের অনুকরণে বলতে হয়, ওয়াসা, তিতাস ও ডেসকো নাগরিকদের জুলুম বন্ধ করুক, না হলে এসব অফিস বন্ধ করে আমাদের চাপকল, লাকড়ি এবং হারিকেন ফিরিয়ে দেওয়া হোক!
lমুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব