আবহাওয়ার কিছুই ঠিক থাকছে না। শীতকালে শীত নেই, চৈত্র মাসে ঠান্ডা, বৈশাখে বন্যা! ২০১৭ সালের মার্চের শেষের দিকের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের ১৪২টি হাওরের সব তলিয়ে যায়। স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্য, গত ৪৬ বছরে তাঁরা চৈত্র মাসে এমন বন্যা ও পাহাড়ি ঢল দেখেননি।
কারণ? জলবায়ুর পরিবর্তন। সেই সঙ্গে চলছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন। বনাঞ্চল উজাড় করে, কৃষিজমি নষ্ট করে, খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট করে ঘরবাড়ি, শিল্পকারখানা, ইটের ভাটা ইত্যাদি নির্মাণ করা হচ্ছে। এসবের মধ্যে ৩ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এক রায়ে তুরাগ নদকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
ওই রায়ে তুরাগ নদসহ দেশের সব নদ–নদী রক্ষায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে অভিভাবক ঘোষণা করা হয়। আদালত বলেন, নদী দখল করা ব্যক্তি সব ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য হবেন। এ ধরনের অপরাধে জড়িত ব্যক্তি ব্যাংকঋণ পাবেন না। এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।
শিল্পায়ন–নগরায়ণ ও প্রকৃতি-বৈরী উন্নয়ন ও বিশ্বায়নে প্রকৃতির আজ কী হাল হয়েছে, তা বাঙালিরাও ঢের টের পাচ্ছে। বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য ও জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বাড়লে বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
কয়েক দশক আগেও জলবায়ু পরিবর্তনকে অনেকেই ‘মিথ’ বা কল্পকাহিনি মনে করতেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো জলবায়ু পরিবর্তনকে কল্পকাহিনি মনে করেন এবং সে জন্য তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে এসেছেন। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি যে এখন কতটা বাস্তব, তা বৈজ্ঞানিক তথ্য–প্রমাণ দিয়ে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। প্রকৃতির ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা এবং বিশ্বব্যাপী নির্বিচার নগরায়ণ-শিল্পায়ন ও বিশ্বায়নের ফলে পরিবেশের ওপর যে চাপ পড়েছে; তার ফলে দেখা দিয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ন, গ্রিনহাউস এফেক্ট, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয়সহ পরিবেশের সব মহাদুর্যোগ। ২০১৭ সালে মাত্র চার দিনে কানাডায় হারিয়ে গেল প্রাচীন এক নদী।
সম্প্রতি নাসার ছবিতে ধরা পড়েছে গ্রিনল্যান্ডের পিটারম্যান হিমবাহের কেন্দ্রে বড় এক ফাটল। পৃথিবীর এক বিস্তৃত অংশ যখন খরায় চৌচির হচ্ছে, তখন অনেক দেশ ভাসছে বন্যায়। বিশ্বের অনেক এলাকা যখন তুষারে চাপা পড়ছে, ঠিক তখনই দাবানলে অঙ্গার হচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশের বনাঞ্চল।
২০১৭ সালের ১৫ নিউজিল্যান্ডের সংসদ দেশটির হোয়াংগানুই নদীকে ‘মানুষের মর্যাদা’ দিয়ে আইন পাস করে। ওটি ছিল পৃথিবীতে কোনো নদীকে মানুষের মর্যাদা দেওয়ার প্রথম ঘটনা। ১৪০ বছর ধরে নিউজিল্যান্ডের মাওরি উপজাতি হোয়াংগানুই নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’র মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল।
মাওরি উপজাতির পক্ষ থেকে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী গেরার্ড আলবার্ট বলেন, ‘আমরা এই নদীকে আমাদের পূর্বপুরুষ বলে মনে করি।’ মাওরি উপজাতি নিজেদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অংশ বলে মনে করে। তারা মনে করে, পাহাড়, নদী ও সাগরের সঙ্গে মাওরি উপজাতি এক ও অভিন্ন। হোয়াংগানুই নদীকে ‘মানুষের মর্যাদা’ দিয়ে আইন পাস করার পর ওই নদীর জন্য দুজন অভিভাবক নিয়োগ করা হয়, একজন রাজার তরফে, অন্যজন উপজাতিদের প্রতিনিধি।
নিউজিল্যান্ডের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ভারতের উত্তরাখন্ড প্রদেশের একটি আদালত গঙ্গা ও যমুনা নদীকে ‘জীবন্ত মানবীয় সত্তা’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ রায় প্রদান করেন। গঙ্গার চারপাশে পাথর খনন নিয়ে একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরাখন্ড প্রদেশের আদালত ওই রায় প্রদান করেন। যদিও ওই বছরের জুলাই মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট উত্তরাখন্ড আদালতের রায় নাকচ করে দিয়ে বলেন যে নানা ধরনের আইনি জটিলতার কারণে নদীকে ‘জীবন্ত মানবসত্তা’ বলা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনা হয়।
আমাদের প্রিয় ঢাকা এখন সারা বিশ্বের মধ্যে ‘বসবাসের অযোগ্য’ শহরের তালিকায় দ্বিতীয়। যানজট, জলজট, নোংরা, বর্জ্য, অব্যবস্থাপনা ও দস্যুপনায় নগরবাসীর জীবন জেরবার। ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটস গ্লোবাল লিভঅ্যাবিলিটি র্যাঙ্কিং’সহ কয়েকটি র্যাঙ্কিংয়ে কয়েক
বছর ধরেই ঢাকা সারা বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য দ্বিতীয় শহর। অথচ ঢাকার চারপাশে রয়েছে চারটি নদী—বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ। কিন্তু এ নদীগুলোর অবস্থা ভালো নয়। শুকনো মৌসুমে বুড়িগঙ্গার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্যের পর্যায়ে নেমে আসে। ফলে ওই পানিতে কোনো মাছ বা জলজ প্রাণী বাঁচতে পারে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে শীতলক্ষ্যার অবস্থাও এ রকম শোচনীয় হয়ে উঠবে।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর দ্য ডেইলি স্টার-এ তুরাগ নদ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামের মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন তুরাগ নদের সব ধরনের মাটি ভরাট, দখল ও নির্মাণকাজ বন্ধের ব্যাপারে নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। ওই মামলার রায় পাওয়া গেল ৩ ফেব্রুয়ারি। মামলার রায় প্রদানের ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ড ও ভারতের উত্তরাখন্ড আদালতের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা হলেও বাংলাদেশের ‘লিগ্যাল লিটারেচার’, ‘জুরিসপ্রুডেন্স’ ও পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
তবে আইনের একজন ছাত্র ও মানবাধিকার এবং পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আমি মনে করি, নদ-নদী শুধু জীবন্ত মানবসত্তা নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। কেননা, নদ-নদী, বনাঞ্চল ও প্রকৃতি বিপন্ন হলে শুধু মানুষ নয়, সমগ্র পৃথিবীর অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
শেখ হাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক