‘ইনট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তিস্তা নদীর ভেতরে ৩০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করছে। এ জন্য নদীর ওপর আড়াআড়িভাবে প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর পাড় থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো। জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কেউই এ কাজে বাধা দেননি। নদীর ভেতরে এ রকম স্থাপনা কীভাবে গড়ে উঠছে, সেটি বিস্ময়কর।
সম্প্রতি বর্ষা শুরু হওয়ার আগে প্রকল্পটি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নের শৈলামারী গ্রামে তিস্তা নদীর পাশে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল একটি সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা আছে ‘ইনট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড, প্রস্তাবিত ৩০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প’। এই সাইনবোর্ডের সামনেই নদীর মধ্যে আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করার কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। সাইনবোর্ডের পাশেই তিস্তা নদীর বুকে একটি ছোট সেতু বানানোর কাজ চলছে। সড়কটির প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে আরও একটি সেতু বানানোর পরিকল্পনা আছে বলে স্থানীয় একজন জানালেন। এ সড়কের পাশ দিয়ে স্থাপন করা হয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি।
নির্মাণাধীন সড়কের নিচে বালুর বস্তা, ওপরে বালু, কোথাও কোথাও কংক্রিট দেওয়া হয়েছে। সড়কের ৫০ থেকে ৬০ ফুট পরপর পানি বের হওয়ার জন্য একটি করে সরু পাইপ বসানো আছে। বালু ধূসর পথে প্রায় দেড় কিলোমিটার হাঁটার পর পৌঁছাই ইনট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেডের অফিসে। যাওয়ার সময় লক্ষ করলাম, ছোট ছোট সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডগুলো মূলত জমি কেনার বায়নাপত্রের ঘোষণা। যেমন একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘বায়নাসূত্রে এই জমির মালিক ইনট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড’। সাইনবোর্ডে বিআরএস দাগ নং, বিআরএস খতিয়ান নং ও জমির পরিমাণ উল্লেখ আছে; যদিও অনেক সাইনবোর্ডে দাগ নং, খতিয়ান নং ও জমির পরিমাণ উল্লেখ নেই। ইনট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেডের দুর্গম চরের কার্যালয়ে নিরাপত্তা সহকারী জহুরুল হকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর কাছেই জানতে পারি, ইনট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড দ্রুতই উৎপাদনে যাবে।
নদীর ভেতরে বিশাল এ অবকাঠামো এবং সোলার প্রজেক্ট সম্পর্কে কতটুকু জানেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুর অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী, তা জানার চেষ্টা করি। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ বলেন, ‘নদীতে যেকোনো প্রকল্প করতে হলে আমাদের জানাতে হবে। এখন পর্যন্ত আমাদের কিছুই জানায়নি। আমি নিজে ওই স্থান পরিদর্শনে যাব।’ পরিবেশ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কথা বলি। তিনি জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এখনো দেওয়া হয়নি। উপপরিচালক মেজবাউল আলম বলেন, ‘ইনট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে। আমরা বেশ কিছু কাগজপত্র চেয়েছি। এখনো তারা কোনো কাগজ আমাদের কাছে দেয়নি। নদীতে আমরা কোনো প্রকল্পের জন্য ছাড়পত্র দিই না।’ ছাড়পত্রের আগে এ কাজ ওই প্রতিষ্ঠান করতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে উপরিচালক এক কথায় সাফ জানিয়ে দেন, ‘ছাড়পত্র ছাড়া এ কাজ তারা করতেই পারেন না।’ আর ছাড়পত্র পেলেই যে নদীতে প্রকল্প স্থাপন করা যাবে, এমন কোনো আইন নেই।
ইনট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেডের বিষয়ে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফরের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ইনট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড অন্যের জমি কিনে প্রকল্প করছে। কার্যত, যেদিন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আমার কথা হয়, সেদিন পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠান কোনো জমি কেনেনি। প্রতিষ্ঠানটির অপারেশনাল ইনচার্জ আবদুল হালিম মুঠোফোনে বলেন, ‘নদীর ভেতরের চরে ব্যক্তিগত জমিতে আমরা সোলার প্রজেক্ট করছি। নদীর ভেতরে স্থানীয় লোকজন রাস্তা করছে। এ রাস্তা আমরা তৈরি করিনি। আমরা দুটি ব্রিজ তৈরি করে দিচ্ছি। নদীর ভেতরের চরে আমরা শুধু এখন কয়েকটি ঘর করেছি।’ নদীর ভেতরে সেতু নির্মাণের সরকারি অনুমতি আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘লিখিত অনুমতি নেই, মৌখিক অনুমতি আছে। আমরা এখনো জমি কিনিনি। জমি কেনার পর পরিবেশ অধিদপ্তরের অনাপত্তির জন্য আবেদন করব।’
২০১৯ সালের জুলাই মাসে নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন উচ্চ আদালত। সেই রায়েরই নির্দেশনা আছে, নদীতে যেকোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অনাপত্তি নিতে হবে। ইনট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছে এখনো কোনো অনাপত্তি গ্রহণ করেনি।
নদীর দুই পারের মানুষ অপেক্ষা করে আছে সরকারের মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখার জন্য। ২০১৬ সাল থেকে ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’ নামক একটি সংগঠন তিস্তা নদী নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছে। আমিও এ সংগঠনের স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য। গত বছর ১ নভেম্বর এ নদীর দুই তীরে আমরা ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন করেছি। বিজ্ঞানসম্মত খনন, তিস্তা চুক্তি, নদীতীরবর্তী কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষার দাবিতে আরও অনেক কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। একই দাবিতে প্রায় এক লাখ মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানো হয়েছে। তিস্তা নদীর তীরবর্তী সমস্ত হাটবাজারে গত ২৪ মার্চ ১০ মিনিট স্তব্ধ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। রিভারাইন পিপলের উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে তিস্তা নদী সুরক্ষার দাবিতে সভা-সেমিনার-মানববন্ধন-লংমার্চ করে আসছি। বিভিন্ন দেশেও আমরা তিস্তা নদী সুরক্ষার দাবিতে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে সভা-সেমিনার করে আসছি। দেশের নদীবিষয়ক তথা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও কাজ করে চলেছে। তিস্তা নদী সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তৎপর।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ‘এই সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প মহাপরিকল্পনা গ্রহণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। নদীর ক্ষতিকর কোনো প্রকল্পই নদীতে হওয়া উচিত নয়। আমরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চাই, বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করা হোক।’
তিস্তা নদী থেকে ইনট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেডের সমস্ত কার্যক্রম অনতিবিলম্বে অপসারণ করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো নদীতে নদীর জন্য ক্ষতিকর কোনো প্রকল্প গড়ে উঠতে না পারে, সে বিষয়ে সরকারের সচেষ্ট থাকা জরুরি। তবে স্থানীয় ব্যক্তিদেরও সচেতনতার প্রয়োজন আছে। নদীর ওপর যেকেউ জুলুম করলে স্থানীয় ব্যক্তিদেরই স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে প্রতিহত করতে হবে।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক।
ই-মেইল: wadudtuhin@gmail.com